Spread the love

বর্ম

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

 

অমল ও আসিক দুই জনে বাল্যবন্ধু: খুব গরীব ঘরে জন্ম ওদের। পাঠশালা থেকে হাইস্কুল অবধি দু’জনে একই সঙ্গে পড়েছে। তারপর নানান ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে অমল একটা প্রাইমারী স্কুলে প্যারা টীচারের চাকরি পেয়েছে। কিন্তু আসিক কিছুই পায়নি। শেষ পর্যন্ত লোকের জমিতে ভাগচাষ করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করে।

একই গ্রামে ওদের বাস। অমলের স্কুলটাও ওই একই গাঁয়ে: তার পাশে মোল্ল্যাবাবুদের তিন বিঘা একটা জমিতে আসিক বর্গাদার। ধান-পাট-সবজি, অনেকগুলি চাষ হয় ঐ জমিতে। ফলে সারা বছরই আসিককে লেগে থাকতে হয় তাতে। ঝড়-জল-রোদ্দুর মাথার উপর দিয়ে চলে যায় তার। টিফিনের ফাঁকে অমল এসে আলের পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করে বন্ধুর সাথে।

আজ আর সে অবকাশ নেই। সকাল থেকেই প্রচণ্ড বাজ পড়ছে এবং বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে: সেই সঙ্গে শিলাবৃষ্টি। তাই আসিক মাঠে কাজ বন্ধ করে স্কুলের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। এই দুর্যোগে কোন ছাত্রছাত্রী কিংবা অন্য কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকাও আসেননি। তাই দুই বন্ধু সুখ দুঃখের গল্প করতে থাকে। কথায় কথায় অমল বললে–আমার খুব কষ্ট হয়, আবার অবাকও লাগে ভেবে যে এত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও তুই আপন মনে তোর চাষের কাজ করে যাস কি করে? এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে তো আর বাবুরা কেউ ঘর থেকে বাইরে বের হন না–এমনকী আমিও এখন অনেকটা অমন হয়ে গেছিরে।

–সে তোর দোষ নয় ভাই; এটা তোর পেশাগত অভ্যাসের দোষ। হয়তো আমিও চাকরি পেলে এমনই হয়ে যেতাম রে। থাক ওসব কথা। শোন, এই যে রোদ-বৃষ্টি-বজ্রপাতের মধ্যে কাজ করে চলি, এতে তোর মনোকষ্টের কি আছে? আসলে কাজটাই আমার বর্ম রে। ছেলে বেলায় আমরা বইতে পড়েছি, ছবিতেও দেখেছি যে রাজ রাজারা যুদ্ধক্ষেত্রে বর্ম ব্যবহার কোরতো যাতে অস্ত্রের কোনো আঘাত তাঁদের গায়ে না লাগে। প্রতিদিন আমি যে জীবনযুদ্ধ করছি সেই যুদ্ধে আমার কাজটাই আমা

র বর্ম। এটাই আমায় রক্ষা করে। বাইরের কোন আঘাত স্পর্শ করে না আমাকে। আমি চাষ করে যাই একমনে।

বৃষ্টি একটু কমে আসে — বাজ পড়াও বন্ধ হয়েছে। আসিক পুনরায় নামে ক্ষেতে। অমল তাকিয়ে থাকে বন্ধুর খালি গায়ের দিকে, অদৃশ্য বর্মের তাগিদে। ভাবে এই যুদ্ধ আসিকরা করে বলেই সবার মুখে অন্ন জোটে এই দেশে।

 


 

লেখক পরিচিতি

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।

পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

ফোন-৯৪৩৪৩৮৫৪৮৩

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *