Spread the love
অন্তরদহন

শ্রাবন্তী মিশ্র


রিমঝিম ছেলে অনুভবের স্কুলে গেছে পেরেন্টস্- টিচার Meeting এ। অনুভব বেশ দুষ্টু, ছটফটে। রিমঝিম তাই খুব চিন্তায় আছে, ছেলের নামে যদি কোনো অভিযোগ শুনতে হয় তাই।
Meeting শুরু হয়েছে, এক একজন অভিভাবককে ডেকে নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষিকারা তাদের সন্তানের ভালো মন্দ, দোষ-গুন বলছেন। রিমঝিমের মধ্যেও একটা চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে।কারন শেষ পরীক্ষায় অনুভবের নম্বর মোটামুটি হয়েছে ঠিকই,তবে হাতের লেখাটা ভালো হয়নি।তাছাড়া ছটফটে ছেলে তার, স্কুলে সারাদিন কি করে সে তো তা জানে না ।তবে ছেলে তার খুব বেশি অবাধ্যও নয়, রিমঝিমের কথা মেনে চলেও, এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে, হঠাৎ অনুভবের নামটা কানে গেলে যেন সম্বিত ফিরে পায়।
তাকিয়ে দেখে অংকের শিক্ষক হেসে বললেন – নমস্কার, শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বলতে শুরু করলেন অনুভব ভালো তবে বড্ড অন্যমনস্ক, আর চঞ্চল, খুব অধৈর্য্য, বাচ্চাদেরকে খুব Disturb করে। অপরাধীর মত কথাগুলো শোনে সে।খুব অপমানিত লাগে নিজেকে।
এরপর ড্রয়িং শিক্ষক, তিনি প্রথমেই বললেন এত অধৈর্য আর slow বলেই অনুভব অন্যদের থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে , ড্রয়িংটা ভালো করতে পারছে না।এই পরীক্ষায় যেখানে সকলেই প্রায় A++ পেয়েছে , সেখানে অনুভব পেয়েছে শুধু A, তাছাড়া সামনে একটা Drawing competition আছে ওর বয়সী অনেকেই chance পেলেও ওকে পাঠাতে পারলাম না, Next year এও chance পাবে কিনা তাও ঠিক নেই।
এইসব শুনতে শুনতে রিমঝিম ভাবতে থাকে তার ছেলের কি ভালো কোনোও দিকই নেই? কেমন যেন অসহায় লাগে নিজেকে তার। ভাবতে থাকে তাহলে ছেলেকে সে মনের মতো করে মানুষ করছে বলে যে বিশ্বাস তার মনের কোনায় জমা করছিল তা সবই মিথ্যে? সে আদৌও ছেলেকে মানুষ করতে পারেনি। তার মন ভাঙতে থাকে।
এরপর বাংলার শিক্ষিকার কথায় তাকিয়ে দেখে মিটিং-এর মাঝে চা বিরতিতে তাকে চা নেওয়ার অনুরোধ করছেন একজন দিদি । রিমঝিমের মাথাটা যেন যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, তাই ভাবলো চা খেলে যদি একটু কমে… চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষন, একচুমুক দিয়ে আর গলা থেকে চা যেন আর নামতেই চায় না, সবকিছু যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে।
সে ভাবতে থাকে Meeting এ না এলে তার ভুল ধারনা গুলো ভাঙতোই না। চা বিরতির পর বাংলার শিক্ষিকা বলেন- আপনার হয়তো শুনতে ভালো লাগছে না, কিন্তু আমরা আজ Meeting এ বসেছি প্রতিটি student -এর ভালো-মন্দ দিক গুলো অভিভাবক, অভিভাবিকাদের জানানোর জন্য। তাই খারাপ লাগলেও আমাদের বলতে হবে। অনুভব বাংলা পড়া class এ পারলেও পরীক্ষার সময় অন্যমনস্কতার জন্য কম নাম্বার পায়। পরীক্ষা চলাকালীন পাশের ছেলের সাথে কথা বলে, এতে অন্য studentsএর অসুবিধা হয়। ওর প্রতি আপনাদের একটু যত্নবান হওয়া দরকার।
এই বলে বাংলা শিক্ষিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে অন্য টেবিলে অন্য কোনো ছাত্রের অভিভাবকের সাথে কথা বলতে এগিয়ে যান।
রিমঝিমও উঠে দাঁড়ায়। আর কিছু শোনার ইচ্ছে বা মনের জোর তার আর নেই। সে মনে মনে ছেলের উপর খুব রেগে যায়। ভাবতে থাকে বাড়ি ফিরে ছেলেকে খুব শাস্তি দেবে আজ। কোনোদিন ছেলেকে সে মারেনি। ছোটো বাচ্চাদের মারধোর করা সে পছন্দ করে না। তাই ভালোবেসে, স্নেহে ছেলেকে বড় করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু সে তো মানুষ করার পরিবর্তে অমানুষ করে ফেলেছে । মাত্র ছয় বছর বয়সেই ছেলের সম্বন্ধে এত অভিযোগ শুনতে হবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি । মনে মনে ঠিক করে নেয় বাড়ি ফিরে আজ ছেলেকে শাস্তি দেবেই…. সে উঠে দাঁড়িয়ে, এগিয়ে যায়।
মনে মনে ঠিক করে নেয় বাড়ি ফিরে আজ ছেলেকে সে শাস্তি দেবেই ।
রিমঝিম উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে যায়, সেই সময় স্কুলের নতুন শিক্ষক পিছন থেকে ডেকে বলেন-নমস্কার , আমি অনুভবের ইংরাজী ও শরীরচর্চার শিক্ষক । আপনার সাথে আমার ঠিক পরিচয় হয়নি। আমি গত এগারো মাস এই স্কুলে পড়াচ্ছি । আপনি অনুভবের মা, তাই তো?
রিমঝিম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। চোখ তুলে তাকাতেও যেন তার লজ্জা করে । সে জানে এখানেও অনেক অভিযোগ জমা হয়ে আছে । তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার চেয়ারে বসে পড়ে। এবার সে অন্য টেবিলগুলোর অভিভাবক ও শিক্ষক/ শিক্ষিকার কথপোকথন শোনার চেষ্টা করে। তার জানতে ইচ্ছে করে অন্যান্য অভিভাবকরাও কি তার মত চরম লজ্জায় মাথা নীচু করে আছেন?
সে ভাবতে থাকে তাহলে কি এই প্রজন্মের পিতামাতারা তাদের সন্তানদের সত্যিকারের মানুষ করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ?
কিন্তু সে তো অন্যান্য অভিভাবকদের মত তার সন্তানকে Rat Race এ নামায় নি । পরীক্ষায় কমবেশি নাম্বার পাওয়া নিয়ে কখনও তার ছোট্ট শিশুকে বকেনি পর্যন্ত । কারন তার মূল লক্ষ্য তার সন্তানকে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা ।
ও খুব ভালো মনের মানুষ হবে একদিন, মানুষ হবে। কথাটা শুনে রিমঝিম ইংরাজী শিক্ষক দেবজিৎবাবুর দিকে তাকায় । দেবজিৎবাবু বললেন; আপনার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? অবশ্য এখনকার পিতামাতারা সন্তানকে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখতে চান ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়র হিসেবে, কিন্তু কেউ বলেন না সত্যিকারের মানুষ হ। তাই আমার কথা শুনে আপনি হয়তো চমকে উঠলেন দিদিভাই।
রিমঝিম কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না, এই শিক্ষকের গলায় তো অনুভবকে নিয়ে কোনো রাগ নেই, বিরক্তি নেই, কথার ধরন শুনে মনে হচ্ছে তিনি বেশ সন্তুষ্ট। রিমঝিম মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দেবজিৎবাবুর কথাগুলো মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে।
দেবজিৎবাবু বলে চলেছেন-আমার দীর্ঘ ২৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় অনুভবের মত ছেলে আমি খুবই কম দেখেছি । আমি অনেক ব্রিলিয়ান্ট students দেখেছি, যারা 100/100 পায়। কিন্তু এমন ছাত্র খুবই কম দেখেছি যে classmatesএর কষ্টে নিজেও কষ্ট পায়। নিজের পেনসিল, ইরেজার অকপটে বন্ধুকে দিতে পারে তার না থাকলে। কারো টিফিন পড়ে গেলে বা কেউ টিফিন না আনলে অবলীলায় নিজের টিফিনের ভাগ তাকে দিতে পারে, পরীক্ষার হলে পাশের বন্ধুটি প্রশ্ন না বুঝতে পারলে তাকে সহযোগীতা করে, এজন্য সে শাস্তি পেলেও প্রতিবাদ করে না। ওর জন্য কেউ আঘাত পেলে তাকে যতটা সম্ভব সে সেবা করে, কেউ কাঁদলে ও তাকে সান্ত্বনা দিতে জানে।
স্কুল স্পোর্টসে পুরস্কারের লোভ না করে ছুটতে গিয়ে পড়ে যাওয়া বন্ধুকে পিছিয়ে এসে তুলতে সাহায্য করে।   ক্লাসে বিপ্লবীদের গল্প শুনলে ওর চোখ ছলছল করে তাদের কষ্টের কথা ভেবে। 
এমন সহানুভূতিশীল ছেলে পেয়ে আপনি সুখী নন দিদিভাই?
আমি তো অনুভবকে নিয়ে গর্ব করি, ওর পশু পাখির প্রতি ভালোবাসা তো আপনার অজানা নয়। ও নিজেই তো এসে গল্প করে রাস্তা থেকে কুকুর ছানা, বিড়াল ছানা তুলে নিয়ে যায় বাড়িতে, তাদেরকে নিয়ে ওর খেলা করা এসব তো আপনার অজানা নয় দিদিভাই!! এসব আপনার ভালো লাগে না?
রিমঝিম কিছু বলতে পারে না, ছেলের নিষ্পাপ মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
দেবজিৎবাবু বলেই চলেন – সবাই হয়তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র বানাতে চায় সন্তানকে, কেউ কেউ তা হয়ও হয়তো, কিন্তু সত্যিকারের মানুষ? কতজন হতে পারে?
অনুভবের বয়স ৬ বছর, এই বয়সের প্রায় সব শিশুই কমবেশি চঞ্চল, অন্যমনস্ক, ছটফটে। ও-ও হয়তো কখনও কখনও খুব চঞ্চল হয়ে পড়ে, ও হয়তো 100/100 পায় না, 75 বা 80 পায়, পাক না, ক্ষতি কি? সবাই তো আর অনুভবের মতো অনুভূতি প্রবন হয় না । তাই ওর মধ্যেকার এই সত্যিকারের মনুষত্বটাকে কোনোভাবে মরতে দেবেন না দিদিভাই। এই বলে পুনরায় নমস্কার জানিয়ে দেবজিৎবাবু অন্য টেবিলের দিকে পা বাড়ান।
রিমঝিমের বুকের উপর থেকে কেউ যেন একটা মস্ত বড়ো পাথর এক ধাক্কায় নামিয়ে দিল। সে ভাবতে থাকে কিছু মানুষের বিচার বিবেচনার উপর ভিত্তি করে সে আজ অনেক বড়ো ভুল করতে যাচ্ছিল । ছেলের প্রতি গর্বে তার বুকটা ভরে গেল। অন্তত একটা মানুষতো তার সন্তানকে চিনতে পেরেছে । সে তো এইভাবেই তার সন্তানকে গড়তে চেয়েছে, আজ মনে হচ্ছে সে সফল মা। সঠিক পথে ছেলেকে সে হাঁটাতে পেরেছে ।
সে মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে আমাদের সমাজে দেবজিৎবাবুর মতো শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে দিন দিন।
মনে মনে দেবজিৎবাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে ধীর পায়ে মাথা উঁচু করে স্কুলের গেট পেড়িয়ে বাড়ির দিকে ফিরে আসে রিমঝিম ॥

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *