★ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য★
ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য
★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★
——– কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– 22
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১৩। জয়দ্রথ বধ :
অস্তাচলে সূর্য হেরি আতঙ্কিত মন।
উতলা অর্জুন কন কেশবে তখন।।
“জয়দ্রথ অভিমুখে করহ গমন।
রক্ষিতে পারি আজিকে যেন মোর পণ”।।
উচাটন দুর্যোধন হেরি আগমন।
হইলেন তৈরি তিনি করিবারে রণ।।
হইলেন তৈরি শল্য কর্ণ বৃষসেন।
অশ্বত্থামা জয়দ্রথ সমরে চলেন।।
অস্তগামী সূর্যে হেরি পুলকিত মন।
দুর্যোধন বন্ধু কর্ণে কহেন তখন।।
“দিবাকাল স্বল্পকাল রহিয়াছে বাকী।
জয়দ্রথে তুমি কভু রেখনা একাকী।।
কর রণ প্রাণপণ জয়দ্রথ ত্রাণে।
অর্জুন হইবে ব্যর্থ প্রতিজ্ঞা পালনে।।
দিবাকর অস্তাচলে করিছে গমন।
ব্যর্থ হ’য়ে পার্থ তাই ত্যাজিবে জীবন।।
ত্যাজিবে জীবন তার প্রবেশি অনলে।
পার্থশোকে মনোদুখে মরিবে সকলে।।
কণ্টকহীন সে দিন হইবেক ধরা।
করিব সবাই ভোগ এই বসুন্ধরা।।
করিবারে এই যুদ্ধ করহ যতন।
লভিয়া জয় পাইবে এ রাজ্য রতন।।
কর্ণ কন, “দেহ মোর শরেতে বিক্ষত।
কর্তব্য তাই হইব আমি যুদ্ধ রত।।
তব লাগি রণি রণ বিরাম বিহীন।
কিন্তু জয় জেনো তুমি সেতো দেবাধীন।।
★
অর্জুন করেন তীব্র শর বরষণ।
অশ্ব সেনা হস্তি দলে করিতে নিধন।।
অগ্রগামী ভীমসেন সাত্যকি রক্ষিত।
জয়দ্রথ অভিমুখে কৌরব বেষ্টিত।।
দুর্যোধন কর্ণ কৃপ অর্জুনে বেষ্টন
করিবারে আইলেন হ’য়ে উচাটন।।
পার্থ বাণে ক্লীষ্ট কৃপ কর্ণ দুর্যোধন।
করিলেন তাঁরা সবে তফাতে গমন।।
জয়দ্রথের সারথি হলো শির চ্যূত।
শরাঘাতে রথধ্বজ ভূতলে পতিত।।
সূর্য দ্রুত অস্তাচলে করিছে গমন।
হেরিয়া ব্যাকুল কৃষ্ণ ধনঞ্জয়ে কন।।
“রয়েছেন সুরক্ষিত ভীত জয়দ্রথ।
করিছেন রক্ষা তাঁরে ছয় মহারথ।।
না করি জয় কিংবা না কোন ছলনে,
জয়দ্রথে বধ তুমি করিবে কেমনে।।
যোগবলে সূর্যে আমি করিব আবৃত।
হেরিয়া হইবে বোধ সূর্য অস্তগত।।
সূর্যাস্ত হইল সবে ভাবিয়া তখন,
বাহিরিবে জয়দ্রথ না থাকি গোপন।।
পাইয়া সুযোগ তুমি সেই অবকাশে,
লইবে উদ্যোগ তুমি তাহার বিনাশে।।
যোগীশ্বর যোগ যুক্ত কেশব তখন,
আঁধারে করেন সূর্যে তিনি আচ্ছাদন।।
সূর্য অস্তাচলে আজি করিল গমন।
এই ভাবি কুরুকুল পুলকিত মন।।
জয়দ্রথ ঊর্ধ্বপানে দেখেন তখন।
নাই সূর্য অস্তাচলে করেছে গমন।।
ধনঞ্জয়ে কহিলেন শ্রীমধুসূদন।
“উপযুক্ত কাল ইহা করিতে হনন।।
দিব্য অস্ত্র এইবার করহ ক্ষেপন।
জয়দ্রথের মস্তক করিতে ছেদন।।
করিতে হইবে যাহা কহি আমি শোন।
অন্যথা তাহার যেন নাহি হয় কোন।।
পূর্বকথা কহি এক তোমারে এখন।
মনোযোগ দিয়া তুমি করহ শ্রবণ।।
জয়দ্রথ-পিতা রাজা বৃদ্ধক্ষত্র নাম।
কেকয় রাজ্যে প্রাসাদ ছিল তাঁর ধাম।।
পুত্র জন্ম কালে তাঁর হয় দৈব বাণী।
শিরশ্ছেদিবে সমরে শত্রু অস্ত্র হানি।।
পুত্র লাগি বৃদ্ধক্ষত্র হলেন আকুল।
অভিশাপ দেন তিনি হইয়া ব্যাকুল।।
ফাটিবে মস্তক তার হইয়া চৌচির।
ভূপাতিত করিবে যে মম পুত্রশির।।
যথাকালে জয়দ্রথে রাজপদ দিয়া,
গমিলেন বনমাঝে তপস্যা লাগিয়া।।
সমন্তপঞ্চক ছাড়ি এক্ষণে বাহিরে।
আছেন তপস্যারত অরণ্য গভীরে।।
দিব্য অস্ত্র ত্বরা তুমি করহ ক্ষেপন।
জয়দ্রথমুণ্ড এবে করহ ছেদন।।
তীব্র শক্তি দিয়া তুমি করহ ক্ষেপন।
পিতৃ ক্রোড়ে হয় যেন মুণ্ডের পতন।।
করিও যতন ক্রোড়ে ফেলিবারে শির।
নচেৎ মস্তক তব হইবে চৌচির।।
ওষ্ঠপ্রান্তে পার্থ বাণ করিয়া লেহন,
মন্ত্রসিদ্ধ সেই বাণ করেন ক্ষেপন।।
দ্রুত বেগে সেই বাণ করিয়া গমন,
জয়দ্রথমুণ্ড তাহা করিল ছেদন।।
শ্যেন পক্ষী সম বাণ ভেদিয়া গগন,
ধায়িল খণ্ডিত শির করিয়া বহন।।
আরও কয় বাণেতে বাড়ে তার গতি।
সেই কালে বৃদ্ধক্ষত্র রত সন্ধ্যারতি।।
হেনকালে কৃষ্ণকেশ কুণ্ডল শোভিত,
জয়দ্রথমুণ্ড তাঁর ক্রোড়েতে পতিত।।
ত্রস্ত ভীত বৃদ্ধক্ষত্র ত্বরিতে উত্থিত।
পুত্রের মস্তক তাহে ভূমিতে পতিত।।
সাথে সাথে শির তাঁর হইল বিদীর্ণ।
নিজ শাপে পুত্রপাপে তিনি হন জীর্ণ।।
অতঃপর কৃষ্ণবলে মোচিল আঁধার।
জ্ঞাত হলো সকলেই কারণ তাহার।।
শোকাকুল কুরুকুল আর দুর্যোধন।
ভ্রাতৃবৃন্দ সবে অশ্রু করেন মোচন।।
কৃষ্ণার্জুন-শঙ্খ হর্ষে হইল ধ্বনিত।
মনে স্থির যুধিষ্ঠির জয়দ্রথ হত।।
★★★
১৪। দুর্যোধনের ক্ষোভ :
দুর্যোধন উচাটন কহিলেন দ্রোণে।
“হইতেছি নাশ মোরা কুরুক্ষেত্র রণে।।
হইল বিনাশ কত শত মহারথ।
ভীষ্ম পিতামহ আর রাজা জয়দ্রথ।।
অতি লোভী পাপী আমি করি ধর্মনাশ।
যমালয়ে যায় মোর জয় অভিলাষ।।
পাণ্ডব পাঞ্চালে বধ করিব এ রণে।
অন্যথায় বীরলোকে প্রস্তুত গমনে।।
আজ আমি অসহায় মনেতে যাতনা।
কেহ নাহি করে মোর মঙ্গল কামনা।।
প্রকাশেন ভীষ্ম তাঁর মৃত্যুর উপায়।
শায়িত আছেন তাই শরের শয্যায়।।
পার্থ অতি প্রিয় শিষ্য সকলেই জানে।
পাণ্ডবের জয় চান তাই মনে প্রাণে।।
এ জীবন মোর আর নাহি প্রয়োজন।
অনুমতি দিন মোরে লভিতে মরণ”।।
কহিলেন দ্রোণ হেন কথা করিয়া শ্রবণ।
“বাক্যবাণে কেন মোরে করহ পীড়ন।।
কহি আমি সদা তবু নাহি রাখ মনে।
নহেক সম্ভব জয় কভুও অর্জুনে।।
সকলে মিলি অর্জুনে করিলে বেষ্টন।
তবুও জয়দ্রথের হইল মরণ।।
অর্জুন হইতে তাঁর হয়নি নিস্তার।
আমিও না হেরি অর্থ জীবন রক্ষার।।
সন্তপ্ত আজিকে আমি আছি মনে অতি।
বাক্যবাণ হান কেন তুমি মম প্রতি।।
হত ভূরিশ্রবা আর সিন্ধুরাজ যবে।
জীবিত তখন আর কেহ নাহি রবে।।
না করিয়া ধ্বংস শত্রু শোন দুর্যোধন।
মোর বর্ম আমি নাহি করিব মোচন।।
অশ্বত্থামায় কহিও নাশিতে সোমক।
কেহ যেন নাহি থাকে জীবিত সোমক।।
শত্রু মাঝে প্রবেশিব আমি এইবার।
রক্ষা কর কুরুসেনা তুমি এইবার।।
হইবে যুদ্ধ আজিকে অতীব ভীষণ।
চলিবে রাত্রিকালেও ভয়ঙ্কর রণ”।।
এতেক কহিয়া দ্রোণ করেন ধাবন।
যুদ্ধক্ষেত্রে আছে যেথা পাণ্ডুপুত্রগণ।।
অতঃপর দুর্যোধন কহিলেন কর্ণে,
“দ্রোণ ছেড়ে পথ ক’রে দিলেন অর্জুনে।।
তাই সে সহজে ব্যূহে করিল প্রবেশ।
অতঃপর জয়দ্রথে করিল নিকেশ”।।
কহিলেন কর্ণ, “নিন্দা নাহি কর আর।
যুদ্ধরত তিনি ত্যাজি প্রাণ মায়া তাঁর।।
স্থবির তিনি অক্ষম ত্বরিত গমনে।
দ্রুত হস্তে বাণ তিনি অক্ষম ক্ষেপনে।।
মানিলাম তিনি অস্ত্র বিশারদ অতি।
জিনিতে পাণ্ডব তাঁর নাহিক শকতি।।
জয়দ্রথ-রক্ষা চেষ্টা করিলাম কত।
তবু কেন সিন্ধুরাজ হইলেন হত।।
যতই চেষ্টা করিনা মোরা পরাধীন।
জেনো তুমি সব কিছু দৈবের অধীন।।
শঠতা করি পাণ্ডবে দিয়েছি গরল।
হত্যালাগি জতুগৃহে দিয়েছি অনল।।
দ্যূত ক্রীড়া করি তারা হয়ে পরাজিত,
দ্বাদশ বর্ষ অরণ্যে হইল প্রেরিত।।
কিন্তু সব প্রচেষ্টাই হইল বিফল।
বিশ্বাস হইছে মনে সব দৈব বল।।
করিলেও শত চেষ্টা মোরা মনে প্রাণে,
যেতে হবে আমাদের দেবতার টানে।।
ঘটে যত কর্মফল দৈবই প্রবল।
নিদ্রিত নর জাগ্রত দৈব অবিচল”।।
★★★★
(চলবে)