Spread the love

    ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য:

* কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন *

—— কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন–১৭
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )

★প্রতিজ্ঞাপর্বাধ‍্যায়★
৮। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ।

কুরু পাণ্ডব বিরত সায়াহ্নের কালে।
সংশপ্তক বধি পার্থ ফিরিবার তালে।।
সাশ্রুকণ্ঠে পার্থ কন গমনের কালে।
“হৃদি মোর ত্রস্ত কেন আজি সন্ধ‍্যাকালে।।
কহিবারে কথা আজি কেন কণ্ঠ রোধ।
অশুভ ঘটিল কিছু হয় মোর বোধ।।
কান্দে কেন হৃদি মোর আজিকে নীরবে।
আছে কি কুশলে তারা মোর ভ্রাতা সবে”?
“করিও না চিন্তা সখা তুমি এই ক্ষণে।
অঘটন ঘটিলেও দৃঢ় থেকো মনে”।।
কেশব দেন অর্জুনে এরূপে সান্ত্বনা।
তবু তাঁর নাহি যায় মনের যাতনা।।
শিবিরে ফিরিয়া পার্থ হেরিলেন সব।
কথা নাই কারো মুখে সকলে নীরব।।
মাঙ্গলিক বাদ‍্য আজ কেন নাহি বাজে।
ধ্বনিহীন শঙ্খ ভূমে আছে পড়ে লাজে।।
ভ্রাতা সবে যেন আজ হারালো চেতন।
কথা নাই কারো মুখে উদাস বদন।।
পার্থ কন ভ্রাতাগণে হয়ে উচাটন।
“কেন হেরি সবাকার বিষাদ বদন।।
অভিমুন‍্যে কেন আজ হেরি না এখন।
মনে মোর হয় বোধ কিছু অঘটন।।
দূত মুখে আমি আজ করিনু শ্রবন।
চক্রব‍্যূহ দ্রোণ এক করিল রচন।।
অভি তাহা জ্ঞাত মাত্র ভেদিতে কেবল।
কিন্তু সে নির্গমনের না জানে কৌশল।।
তারে আমি শেখালাম ব‍্যূহ প্রবেশিতে।
শিক্ষা নাহি দিনু তারে তাহা বাহিরিতে।।
ব‍্যূহ মাঝে সে কি আজ হইল নিধন।
কহ মোরে কেবা তারে করিল হনন।।
কুঞ্চিত কেশ তার চক্ষু হরিণ-নয়ন।
স্মিত মুখে কথা কয় প্রফুল্ল বদন।।
নব শাল তরুসম শরীর গঠন।
গুরুজন আজ্ঞা সদা করে সে পালন।।
যদিও বালক তবু নম্র আচরণ।
রণে কভু নাহি করে অগ্রে প্রহরণ।।
মহারথ সমরে সে অতীব নিপুন।
বিক্রম আমার চেয়ে বেশি অর্ধগুণ।।
প্রিয় পুত্রের যদি না পাই দরশন ।
গমিব নিশ্চিত আমি যমের সদন।।
হায় পুত্র আমি আজ অতি ভাগ‍্যহীন।
হারায়ে তোমারে আজ হইলাম দীন।।
আমাদের ছাড়ি তুমি গেলে দেবলোকে।
ইন্দ্রের প্রিয় অতিথি তুমি ইন্দ্রলোকে।।
অতঃপর অর্জুন কন যুধিষ্ঠিরে,
অভি কি গমিল স্বর্গে সম্মুখ সমরে ?
দ্রোণ আর কর্ণ বাণে বিলাপে কাতরে।
রহিলে পিতা নিশ্চয় রক্ষিত আমারে।।
ব‍্যূহ মাঝে মহারথ তারা ছয় জন।
অসহায় কালে তারে করিল নিধন।।
কহিবে সুভদ্রা কিবা না হেরি তাহারে।
আমিই উত্তরে তার কিবা কবো তারে।।
মোর হৃদয় নিশ্চয় বজ্রসারময়।
নচেৎ তাহা বিদীর্ণ কেন নাহি হয়।।
করিল সিংহনাদ ধার্তরাষ্ট্রগণ।
দূর হতে আমি তাহা করিনু শ্রবণ।।
*
আইলেন কৃষ্ণ পাশে শোক নাশিবারে।
অর্জুনের বাহু ধরি কহিলেন তাঁরে।।
ক্ষান্ত হও তুমি পার্থ শোক নয় আর।
বীরশ্রেষ্ঠ বীর তুমি ভরসা সবার।।
পুণ‍্যার্জিত লোকে অভি করিল গমন।
দেব সাথে সুখে বাস করিছে এখন।।
সকল ক্ষত্রিয় বীর আশা করে মনে ।
মৃত্যু যদি হয় তবে মরে যেন রণে।।
রোগ ভোগে মৃত্যু নয় শুয়ে বিছানায়।
যুদ্ধ-মৃত্যু শ্রেষ্ঠ মৃত্যু বীর কামনায়।।
বীরশ্রেষ্ঠ শোক তুমি করহ মোচন।
তব শোকে আরো সবে করিছে রোদন।।
যাও তুমি দাও সবে আশ্বাস সান্ত্বনা।
যাক তারা ভুলে সব মনের যাতনা।।
ভ্রাতাগণে কহিলেন অর্জুন তখন।
অভিমন্যু মৃত্যু-কথা করিব শ্রবণ।।
রথারোহী ছিল কত আপনার জন।
তবু তারে ছয় রথী করিল নিধন।।
পৌরুষ হীন বুঝিনু আপনারা সবে।
অন‍্যায় যুদ্ধে বধিল তবুও নীরবে।।
অকর্মণ‍্যে দিনু আমি কর্ম গুরুভার।
আমিই আসল দোষী কেহ নহে আর।।
বীরত্ব সবার দেখি বালকের তুল।
কর্মভার দিয়ে আমি করিলাম ভুল।।
এতেক কহি অর্জুন হইলেন স্থির।
কালনাগ যেন এক অতি ক্রুদ্ধ বীর।।
নিঃশ্বাস সঘন তাঁর ভুজঙ্গ যেমতি।
অসি কারমুক হস্তে অর্জুন সেমতি।।
*
অতঃপর অর্জুনে কন যুধিষ্ঠির।
বিষন্ন ব‍্যথিত কণ্ঠে অতি ধীর স্থির।।
সংশপ্তক বধে তুমি করিলে গমন।
ব‍্যূহবদ্ধ দ্রোণ-সেনা করিল পীড়ন।।
কহিলাম অভিমুন‍্যে হয়ে নিরুপায়।
ব‍্যূহ ভেদ করিবারে তুমিই সহায়।।
ব‍্যূহ ভেদ করে তুমি কর এক দ্বার।
সেই পথে অনুগামী হইব তোমার।।
সকলে ব‍্যর্থ হলাম ভেদিতে আবার।
জয়দ্রথ করেছিল রুদ্ধ সেই দ্বার।।
মহারথ ছয় জন আসিল ত্বরায়।
বালক অভিরে ঘিরে ধরিল সেথায়।।
বেষ্টিত বালকে করে শর বরষণ।
তবুও বালক অভি রণিল ভীষণ।।
বৃহদবল নিহত অভিমন্যু বাণে।
সেনা কত হলো হত শর বরষণে।।
কিন্তু দুঃশাসনপুত্র আসিল পশ্চাতে।
করিল নিধন তারে মস্তকে আঘাতে।।
অভিমন্যু ইন্দ্রলোকে করিল গমন।
হাজারে হাজার সেনা করিয়া নিধন।।
*
‘হা পুত্র’ কহি অর্জুন সেখানে মূর্ছিত।
সেইস্থলে হইলেন তিনি ভূপতিত।।
লভিয়া চেতন কন হইয়া কম্পিত।
জয়দ্রথ কাল মোর হস্তে হবে হত।।
করিলাম এই পণ দৃঢ় পণ মম।
করিব বিনাশ তারে মূষিকের সম।।
কাল যদি নাহি পারি করিবারে হত,
নিশ্চিত হইব আমি নরকে পতিত।।
হয়ে পাপী মহা পাপী গুরুদার গামী,
নরকে যাইব ঠিক মৃত্যুপরে আমি।।
আরও প্রতিজ্ঞা সবে করুন শ্রবণ।
জয়দ্রথে না বধিলে ত‍্যাজিব জীবন।।
সূর্যাস্তের পূর্বে তারে করিব হনন।
নচেৎ অনলে পুড়ে হইব নিধন।।
ত্রিভুবনে কেহ নাই রক্ষিবে তাহারে।
সুরাসুর ব‍্যর্থ হবে রোধিতে আমারে।।
শরাঘাতে শির তার করিব ছেদন।
হেনরূপে কাল তারে করিব নিধন।।
এতেক কহি করেন গাণ্ডীবে টঙ্কার।
আকাশে বাতাসে ওঠে বজ্রের ঝঙ্কার।।
পাঞ্চজন‍্য শঙ্খে কৃষ্ণ করেন নিনাদ।
সেই নিনাদে কৌরব গণিল প্রমাদ।।
দেবদত্ত শঙ্খে পার্থ দেন বজ্র ধ্বনি।
কম্পিত ভুবন তায় বহে প্রতিধ্বনি।।
পাণ্ডবের মাঝে ওঠে সিংহনিনাদ।
কুরুকুল ডরে মরে আশঙ্কা অগাধ।।
★★★★
(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *