Spread the love

      ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য

কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★ –Apr. 22
কাব‍্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– ২৯
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৪। পাণ্ড‍্যরাজ বধ – দুঃশাসনের পরাজয়।।

বীরশ্রেষ্ঠ পাণ্ড‍্যরাজ রণে অতি দক্ষ।
করিছেন যুদ্ধ তিনি ল’য়ে পাণ্ডু-পক্ষ।।
অতি বড় বীর তিনি ভাবখানা মনে।
তুলনা অসহ্য তাঁর ভীষ্ম দ্রোণ সনে।।
অশ্বত্থামা ডাক দেন করিবারে রণ।
পাণ্ড‍্যরাজ সেই ডাক করেন গ্রহণ।।
চলে দোঁহে মহারণ অতীব ভীষণ।
দোঁহাকার শরজালে আঁধার গগন।।
আট গাড়ি অস্ত্র তাঁর ভার আট টন।
চারি দণ্ডে অশ্বত্থামা করেন ক্ষেপন।।
পাণ্ড‍্যরাজ-শরজালে সব খানখান।
প্রতিরোধ হয় তাহে সেই সব বাণ।।
কিন্তু বিনষ্ট তাঁহার রথাশ্ব সারথি।
অশ্বত্থামা-শরজাল ভয়ঙ্কর অতি।।
সেই জালে পাণ্ড‍্যরাজ অতি ভীত মনে।
হইল মরণ তাঁর মস্তক ছেদনে।।
অতঃপর কেশব কহেন অর্জুনে।
“অন্য সব ভাই তব নাহি কেন রণে।।
কর্ণ একা করে রণ সমরে ভীষণ।
অশ্বত্থামা ক’রে যায় সৃঞ্জয়ে মর্দন”।।
হেন কহি কৃষ্ণ রথ করেন চালন।
কুরুসেনা সাথে তাঁরা করিবারে রণ।।
দুই দলে যুদ্ধ চলে অতীব ভীষণ।
রথাশ্ব সেনা কত যে হইল নিধন।।
অচেতন দুঃশাসন সহদেব-বাণে।
পতিত ভূতলে তবু নাহি মরে প্রাণে।।
হেরিয়া সারথি তাঁর হইলেন ভীত।
ছাড়ি রণ রণাঙ্গন দ্রুত পলাইত।।
★★★

৫। কর্ণের হস্তে নকুলের পরাজয়।
যুযুৎসু প্রভৃতির যুদ্ধ।।

নকুল কৌরবে রণে করিছে মর্দন।
হেরি তাহা কর্ণ তাহা করে আক্রমণ।।
নকুল সহাস্যে কর্ণে কহেন তখন।
“মোর প্রতি দয়াবান আজি দেবগণ।।
ইচ্ছা তব মোর সনে যুদ্ধ করিবার।
পাপী তুমি সাধ হলো কেন মরিবার।।
করিয়াছ সৃষ্টি তুমি যতেক অনর্থ।
বধিয়া তোমারে আমি হইব কৃতার্থ”।।
কর্ণ কহেন, “নকুল, নাহি কর গর্ব।
অচিরেই গর্ব তব হইবেক খর্ব”।।
হেন কহি দোঁহে যুদ্ধ করেন ভীষণ।
পরস্পরে করে তারা বাণ বরিষণ।।
নিপীড়িত যত সেনা সেই শরাঘাতে।
দর্শক হইয়া তারা দাঁড়ায়ে তফাতে।।
কর্ণবাণে নকুলের বিনষ্ট সারথি।
পরিঘ হস্তে নকুল ধায় তাঁর প্রতি।।
বিনষ্ট পরিঘ সেও কর্ণ-শরাঘাতে।
পলায়নে ব‍্যস্ত তাই হ’য়ে ভীত তাতে।।
কর্ণ বেগে পিছে তাঁর হলেন ধাবিত।
অতি সহজে নকুল হইলেন ধৃত।
লাগাইয়া কার্মুক-জ‍্যা গলেতে তাঁহার।
কর্ণ কন, “মিথ্যা কহ দেখি আরবার।।
করিও না যুদ্ধ কভু কৌরবের সনে।
করিবে যুদ্ধ কেবল সমতুল সনে।।
পরাজয় হেতু তুমি নাহি পাও লজ্জা।
মাদ্রীপুত্র, গৃহে যাও আছে সুখ-শয্যা”।।
কর্ণ তবু নাহি করে নকুলে হনন।
মুক্তি দিলা কুন্তি কথা করিয়া স্মরণ।।
পরাজিত নকুলের সঘন শ্বসন।
ক্রুদ্ধ সর্প রুদ্ধ বদ্ধ কলসে যেমন।।
কর্ণ দিলা মন তার করিবারে রণ।
ভয়ে ভীত যত সেনা করে পলায়ন।।
যুযুৎসু কুরুসেনা করিছে মথন।
হেরিয়া উলূক তারে করে আক্রমণ।।
যুযুৎসুর রথ ধ্বংস উলূকের বাণে।
অন‍্য রথে চড়ি তিনি ব‍্যস্ত পলায়নে।।

শ্রুতকর্মা নাম তার ভ্রাতা দুর্যোধন।
আইলা নকুল-পুত্রে করিতে হনন।।
শতানীক নকুল-পুত্র সমরে নিপুন।
শ্রুতকর্মা সনে তার যুদ্ধ নিদারুণ।।
অশ্ব সারথি দোঁহের বিনষ্ট যখন।
ছাড়ি রণ রণাঙ্গন করে পলায়ন।।
ভীমপুত্র সুতসোম ছিল যুদ্ধে রত।
শকুনির সাথে রণ বাণ অবিরত।।
অশ্ব সারথি বিনষ্ট সুতসোম তাই,
খড়্গ লয়ে যায় ধেয়ে হস্তে ধনু নাই।।
দ্বিখণ্ডিত খড়্গ তার খুরপ্র ক্ষেপনে।
রহিল দাঁড়ায়ে সুত চিন্তাকুল মনে।।
ক্ষণপরে খড়্গাংশ করিয়া ক্ষেপন,
আঘাতে শকুনি-ধনু করিল ছেদন।।
অতঃপর অন‍্য ধনু করিয়া গ্রহণ,
শকুনি পাণ্ডবে ত্বরা করে আক্রমণ।।

কৃপাচার্য যুদ্ধরত ধৃষ্টদ‍্যুম্ন সাথে।
ধৃষ্টদ‍্যুম্ন ক্ষতদেহ কৃপ-শরাঘাতে।।
ধৃষ্টদ‍্যুম্ন ভীমপাশে করিল গমন।
কৃপ তাই শিখণ্ডীরে করে আক্রমণ।।
আঘাতে শিখণ্ডী রণে হয় অচেতন।
সারথি তাহারে ল’য়ে করে পলায়ন।।
★★★
৬। পাণ্ডবগণের জয়।
[ ষোড়শ দিনের যুদ্ধান্ত ]

ত্রিগর্তরাজ পাণ্ডবে করে আক্রমণ।
সাথে তার শিবি আর সেনা নারায়ণ।।
অর্জুন-শরেতে হত সেনা শত শত।
অনলে পতঙ্গ যথা মৃত কত শত।।
সুশর্মার ভ্রাতা হত অর্জুনের বাণে।
ত্রিগর্ত ভ্রাতায় পার্থ বধিলেন প্রাণে।।
ত্রিগর্তের অন‍্য ভ্রাতা সত‍্যসেন নাম।
তোমরে করিল বিদ্ধ কৃষ্ণ-বাহু বাম।।
কশা আর রশ্মি তায় হয় হস্তচ‍্যূত।।
ক্রুদ্ধ পার্থ-ভল্লে সত‍্য হলো শিরচ‍্যূত।।
করেন নিধন তার ভ্রাতা চিত্রসেনে।
হেনরূপে কৃতকৃত‍্য অরাতি দমনে।।
অতঃপর করেন ইন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ।
সেই অস্ত্রে কত সেনা হইল বিয়োগ।।
ভয়ে ভীত কুরুসেনা ছাড়ি রণাঙ্গন,
ত‍্যাজি রণ সবে তারা করে পলায়ন।।

দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরে চলে মহারণ।
পরস্পর প্রতি চলে বাণ বরিষণ।।
যুধিষ্ঠির-বাণে হত রথাশ্ব সারথি।
দুর্যোধন ক্ষুণ্ন মন হারায়ে সারথি।।
হেরি তাই কৃপাচার্য দুর্যোধন পাশে।
যুধিষ্ঠির মনোস্থির কুরুসেনা নাশে।।
রণভূমি কম্পিত সে ভয়ঙ্কর রণে।
নিনাদিত রণস্থল হস্তি বৃংহণে ।।
আকাশ বাতাস হয় ধূলায় মলিন।
তপন গুপ্ত গগনে আঁধারিল দিন।।

পাঞ্চালের সনে রণে কর্ণ মহাবীর।
ত্রিগর্ত সেনায় পার্থ বধে মনোস্থির।।
যুধিষ্ঠির দুর্যোধন রণে পুনর্বার।
ক্ষত দেহে দুইজনে রণেন আবার।।
গদা হস্তে যান ধেয়ে রাজা দুর্যোধন।
যুধিষ্ঠিরে নাশিবারে করিলেন পণ।।
যুধিষ্ঠির শক্তি-অস্ত্র করেন ক্ষেপন।
সেই অস্ত্রে দুর্যোধন হন অচেতন।।
যুধিষ্ঠির মনোস্থির করিতে নিধন।
নাশিবারে দুর্যোধনে দৃঢ়কল্প মন।।
ভীমসেন নিজ পণ করিয়া স্মরণ,
যুধিষ্ঠিরে সেই যাত্রা করে নিবারণ।।

কর্ণ সনে সাত‍্যকির যুদ্ধ নিদারুণ।
হেরিয়া সাত‍্যকি পাশে রহেন অর্জুন।।
দুই পক্ষে চলে যুদ্ধ তখন ভীষণ।
বিধ্বস্ত অর্জুনবাণে কুরু-সেনাগণ।।
অস্তাচলে সূর্য যান পরেতে তাহার।
নিবারিতে রাত্রি-যুদ্ধ শুরু অবহার।।

ক্রমে ক্রমে আসে নেমে আঁধার গভীর।
স্তব্ধ হলো রণভূমি নিস্তব্ধ শিবির।।
নিশীথ-শ্মশান তুল‍্য সেই রণস্থলে,
রাক্ষস পিশাচ আসে সব দলে দলে।।
★★★
( চলবে )

রচনাকার কবি কৃষ্ণপদ ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *