Spread the love

ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য

★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★ –Nov.- 22
কাব‍্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– ৩৬
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১৮। অর্জুন – কর্ণের অভিযান ।।

রণসাজে ওঠে সেজে শব্দহীন রথ।
ধায়িলেন কৃষ্ণার্জুন পালনে শপথ।।
নির্মল সকল দিক সেই শুভ ক্ষণে।
চাষ, শতপত্র, ক্রৌঞ্চ উড়িল গগনে।।
কঙ্ক, বায়স প্রভৃতি নানা পক্ষীকুল,
আগে আগে খাদ্য লোভে চলে বিলকুল।।

গমিবার কালে রণে কহেন কেশব,
“শোন পার্থ যাহা কহি রেখ মনে সব।
তোমা সম যোদ্ধা আজি ভুবনে বিরল।
তথাপি করিলে হেলা হইবে বিফল।।
শত্রু মিত্র অল্প অতি আজি এই রণে।
তথাপি করিও যুদ্ধ তুমি প্রাণপণে।।
কৌরব পক্ষে জীবিত পাঁচ মহারথ।
তাই যুদ্ধে জয়লাভ সোজা নয় পথ।।
জীবিত আছেন কর্ণ, শল্য, অশ্বত্থামা।
আর আছেন জীবিত কৃপ, কৃতবর্মা।।
অশ্বত্থামা গুরুপুত্র তাই দয়া মনে।
কৃপাচার্য গুরুজন যুঝিবে কেমনে ?
কৃতবর্মা বন্ধুজন তব মাতৃকুলে।
শল্যে হত্যা সম্ভব তা কেমনে মাতুলে ?
এইসব ভেবে তুমি হয়েছ দুর্বল।
মোহ ত্যাগ কর পার্থ হইতে সফল।।
কর্ণে হত্যা আগে কর রণাঙ্গনে আজ।
কর্ণ-হত্যা লক্ষ্য হোক পরে অন্য কাজ।।
জতুগৃহ দ্যূতক্রীড়া যতেক পীড়ন,
ঘটিল সবই তাহা কর্ণের কারণ”।।

কহিলেন পার্থ কৃষ্ণে, “শোন হে গোবিন্দ,
মোর মনে নাহি আজ আর কোন দ্বন্দ্ব।।
রয়েছ সহায় তুমি, হে মধুসূদন।
ত্রিলোক করিতে পারি সহজে দমন।।

ভীমসেন সেইক্ষণে ব্যাপৃত সমরে,
সারথিরে কন তিনি, “কহ তুমি মোরে,
কত অস্ত্র আছে মোর এখনো সঞ্চিত।
অল্প অস্ত্র আছে তাই হইলাম ভীত।।
“নহে ভয় অকারণ” কহিল সারথি।
“চলে যাবে সারাদিন সহজেই অতি।।
ছয় গো-শকটে নারে করিতে বহন।
নির্ভয়ে অস্ত্র আপনি করুন ক্ষেপন”।।
সারথি বিশোক কহে ক্ষণপরে তার,
“যায় শোনা অদূরেতে গাণ্ডীব টঙ্কার।।
রণাঙ্গনে আসিছেন রণিতে অর্জুন।
আর ভয় নাহি তিনি রণেতে নিপুন”।।
হৃষ্টচিত্তে ভীমসেন কহিলেন হাসি,
“রথ দেবো গ্রাম দেবো, দেবো দাস দাসী।।
প্রিয় সংবাদ তুমি করিলে প্রদান।
তার লাগি উপহার করিলাম দান”।।

অর্জুন কেশবে কন হয়ে উচাটন,
“কর্ণ সকাশে ত্বরায় করহ গমন।।
পাঞ্চাল সেনা সবের যুদ্ধে নাহি মন।
কর্ণ-ভয়ে ভীত তারা করে পলায়ন।।
রোধিবারে কর্ণে আমি লইব যতন।
নতুবা সকলেরে সে করিবে হনন”।।

হেরিয়া অর্জুন-রথ কন মদ্ররাজ,
“পার্থ-ভয়ে ভীত যত কুরুসেনা আজ।।
কিন্তু পার্থ নাহি যুঝে কুরুসেনা সনে।
লক্ষ্য তার তুমি আজ এই মহারণে।।
অর্জুন- নিধনে তুমি নাহি কর ভুল।
ক্ষমতা তোমার জেনো ভীষ্ম দ্রোণ তুল।।
যতেক ভীত নৃপতি ব্যস্ত পলায়নে।
তুমি ভিন্ন নাহি কেহ ভয় নিবারণে।।
এই রণে কুরুগণে দিও আশ্রয়-দ্বীপ।
করিও আঁধার দূর জ্বালিয়ে প্রদীপ”।।

কহিলেন কর্ণ তাঁরে, “শোন মদ্ররাজ,
তব মুখে মম কথা শুনিলাম আজ।।
ধনঞ্জয়-ভীতি মোর নাহি ছিল মনে।
বাহুবল আছে মোর অর্জুন নিধনে।।
আজই নাশিব আমি এই দুই বীরে।
নচেৎ কভুও নাহি ফিরিব শিবিরে”।।

হেন কালে উপস্থিত কৃপ, অশ্বত্থামা।
দুর্যোধন ও শকুনি আর কৃতবর্মা।।
হেরিয়া কর্ণ তাঁদের কহেন তখন,
কৃষ্ণার্জুনে একসাথে হোক আক্রমণ।।
কর্ণের আদেশ যত মহারথগণ,
কৃষ্ণার্জুনে বাণ হানে করিতে নিধন।।
কিন্তু পার্থ তীব্র বাণে করে নিবারণ।
সেই বাণে কত সেনা হইল নিধন।।
দশ ভাই তার আর দুঃশাসন,
ল’য়ে সেনা পার্থে সবে করিল বেষ্টন।।
হেরিয়া অর্জুন ভল্ল করেন ক্ষেপন।
তাহাতেই দশ ভাই হইল নিধন।।
সংশপ্তক সেনা আসে করিবারে রণ।
জয়ী হন পার্থ সবে করিয়া হনন।।

১৯। দুঃশাসন বধ ।।

রণাঙ্গনে যুদ্ধরত কর্ণ মহাবীর।
পাঞ্চাল সেনা সকলে রোধিতে অস্থির।।
নিমেষে কর্ণ ত্যাজেন বান শত শত।
ধৃষ্টদ্যুম্ন-পুত্র তাহে হইল নিহত।।
কহিলেন কৃষ্ণ পার্থে হয়ে উচাটন,
সত্বর কর্ণে এখন করহ নিধন।।
নচেৎ পাঞ্চাল সেনা হয়ে যাবে শেষ।
কর্ণ-বধে মন তাই করহ নিবেশ।।
ধায়িলেন পার্থ রথে কৃষ্ণের বচনে।
উপস্থিত ভীমসেন তাঁহারে রক্ষণে।।

হেনকালে দুঃশাসন সম্মুখ সমরে,
ত্যাজিলেন শর তাঁর লক্ষ্যিয়া ভীমেরে।
ভীমসেন ত্যাজিলেন তাঁর মহাবাণ।
সেই বাণে শত্রু-বাণ ভেঙে খানখান।।
ছিন্ন ধনু হলো তার ভীম-শরাঘাতে।
সারথি নিহত তার ভীমসেন হাতে।।
দুঃশাসন নিজে রথ করিয়া চালন ।
ভীমসেনে চাহিলেন করিতে হনন।।
ত্যাজিলেন মহাশর ভীমসেন পানে।
শরাহত হন ভীম বেঁচে যান প্রাণে।।
আহত হইয়া ভীম করিলেন ভান।
রহিলেন শুয়ে রথে যেন হীন প্রাণ।।
উঠিলেন ক্ষণপরে করিয়া গর্জন।
দোঁহে চলে যুদ্ধ ঘোর অতীব ভীষণ।।
ক্রোধে ভীম প্রজ্জ্বলিত দাবানল যথা।
সগর্জনে কহিলেন, “শোন রে দুরাত্মা।।
এই রণে এইক্ষণে বক্ষ রক্তে তোর,
মিটাইব আজ আমি ঘোর তৃষ্ণা মোর।।
দুঃশাসন শক্তি অস্ত্র করেন ক্ষেপন।
রোধিলেন ভীম গদা করিয়া ঘূর্ণন।।
শক্তি অস্ত্র হলো নষ্ট ঘূর্ণিত গদাতে।
নিক্ষেপিত দুঃশাসন ভীম-গদাঘাতে।।
রথাশ্ব বিনষ্ট তার ভীমের গদায়।
বেদনায় দুঃশাসন ধূলায় লুটায়।।

স্মরণে আসে ভীমের নানান বঞ্চনা।
দ্রৌপদী-কেশাকর্ষণ লাঞ্ছনা কতনা।।
নির্লজ বস্ত্র হরণ দ্যূত-সভা মাঝে।
বুকে তাঁর দেয় ব্যথা দিবা নিশি সাঁঝে।।

উঠিলেন জ্বলে ভীম হুতাশন যথা।
দুঃশাসন-রক্ত পানে হবে না অন্যথা।।
সগর্জনে কহিলেন যত যোদ্ধৃগণে।
দুঃশাসনে বধিব আজি এই রণে।।
রক্ষা করুন তাহারে থাকিলে ক্ষমতা।
নৃশংস হত্যালীলা নাহি কোন মমতা।।
কেশ ধরি দেন ঝাঁকি করি লম্ফদান।
ধৃত হয়ে দুঃশাসন ভয়ে কম্পমান।।
ভূতলে ফেলিয়া তারে ভীম বৃকোদর,
স্থাপিলেন পদ তাঁর গ্রীবার উপর।।
অতঃপর কোষমুক্ত তীক্ষ্ণ তরবারি।
বিদারিল বক্ষ তার শোণিত উদ্গারি।।
করিলেন ভীমসেন সেই রক্ত পান।
মনানল নির্বাপিত জুড়াইল প্রাণ।।
গতাসু দুঃশাসন পড়ে থাকে ভূমে।
আনন্দিত ভীমসেন তরবারি চুমে।।
ছেদন করিয়া পরে দুঃশাসন-শির।
করেন স্বাদন তার গরম রুধির।।
কহিলেন এই রক্ত অতীব সুস্বাদু।
মানে হার মাতৃদুগ্ধ ঘৃত কিম্বা মধু।।
ছিন্ন মুণ্ড ভীমসেন করিয়া ধারণ,
কহিলেন তব লাগি কি করি এখন।।
নীচাশয়ী লোভী মন করিনু শোধন।
মৃত্যু তোমারে এবার করুক রক্ষণ।।
রক্তপায়ী ভীমে হেরি কত যোদ্ধৃগণ।
ভয়ে ভীত ত্যাজি রণ করে পলায়ন।।
কারো বা হইল ভয়ে ভূমিতে পতন।
হস্তচ্যূত অস্ত্র কারো হইল তখন।।
‘নহে নর’ এই ভাবি বাকি সেনাগণ,
যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়ি সবে করে পলায়ন।।

কর্ণ-ভ্রাতা চিত্রসেন ব্যস্ত পলায়নে।
যুধামন্যু করে বধ বল্লম ক্ষেপনে।।
ক্ষরিত রুধির মুখে ভীমসেন কন,
“মম পণ আজি আমি করিনু পালন।।
এরপর দুর্যোধনে করিব নিধন।
চরণ দিয়া মস্তক করিব মর্দন।।
হেন কহি ভীমসেন দেন বজ্রনাদ।
শ্রবণে কৌরবকুল গনিল প্রমাদ।।
★★★
( চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *