Spread the love

ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য

কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★ –Oct.- 22
কাব‍্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– ৩৫
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১৬। অর্জুনের ক্রোধ ও কৃষ্ণের উপদেশ।

যুধিষ্ঠিরের কুকথা করিয়া শ্রবণ,
সক্রোধে অর্জুন খড়্গ করেন ধারণ।।
চিত্তজ্ঞ কেশব তাঁরে হেন হেরি কন,
খড়্গ হস্তে লহ তুমি কিসের কারণ।।
যুদ্ধযোগ্য কেহ নাই দেখি এইখানে।
ভীমসেন যুদ্ধরত এবে রণাঙ্গনে।।
আইলে তুমি ভ্রাতারে করিতে দর্শন।
তিনিও আছেন দেখ কুশলে এখন।।
হওয়া উচিত ছিল আনন্দিত মন।
ক্রুদ্ধ তুমি আজ কেন কিসের কারণ ?
খড়্গ হস্তে লহ কেন কিবা অভিপ্রায় ?
অর্জুন তা তুমি জ্ঞাত করহ আমায়।।
সঘন শ্বাসে অর্জুন আশীবীষ যথা।
অন্তরে পালিত মোর এক গূঢ় কথা।।
কহিলে কেহ গাণ্ডীব করিবারে দান।
শিরশ্ছেদ করি লব আমি তার প্রাণ।।
গোবিন্দ, তুমি নিশ্চয় করিলে শ্রবণ।
হেন কথা করিল কে আজি উচ্চারণ।।
বধিব ওনারে আমি প্রতিজ্ঞা প্রকট।
ঋণমুক্ত হবো আমি সত্যের নিকট।।
সর্বকালজ্ঞ তুমি হে, কহ জনার্দন,
উচিত কার্য কি আমি করিব এখন।।
‘ধিক ধিক ধনঞ্জয় ‘ ! কহেন কেশব।
তব মুখে আমি আজ কি শুনি এসব ?
বুঝিলাম অসম্পূর্ণ জ্ঞানের কারণে,
ক্রুদ্ধ হইয়াছ তাই তুমি অকারণে।।
ধর্মভীরু তুমি কিন্তু নহক পণ্ডিত।
সত্যজ্ঞানে শিক্ষা লাভ তোমার উচিত।।
ধর্মের সকল দিক জ্ঞাত যেই জন,
কদাপি নাহি করে সে হেন আচরণ।।
অকর্তব্য কর্মে লিপ্ত হয় যেই জন,
পুরুষাধম জানিবে হয় সেই জন।।
অকারণে প্রাণ নেয়া নহে কারো ধর্ম।
বরং মিথ্যা ভাষণ সেও ভালো কর্ম।।
জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা তব পূজ্য অতি সদাশয়।
করিলে হত্যা তাহারে মহাপাপ হয়।।
বালকসম তখন করেছিলে পণ।
মূঢ় তুমি পাপ কর্মে উদ্যত এখন।।
সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্বে তুমি আছ হীনজ্ঞান।
তাই হানিতে চাহিছ নিজ ভ্রাতৃপ্রাণ।।
সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্ব এবে করিব বর্ণন।
মনোযোগ সহকারে করহ শ্রবণ।।
ধর্মসংগত জেনো সত্যের পালন।
তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নাই কন সাধুজন।।
কিন্তু যদি হিতকর মিথ্যা কভু হয়।
মিথ্যা ছাড়া সত্য সেথা কদাপিও নয়।।
শ্রেয় নয় কভু সেথা সত্যের পালন।
মঙ্গল তাহাতে হয় রাখিও স্মরণ ।।
অতঃপর কৃষ্ণ কন কর প্রণিধান।
নিদারুণ কর্ম ক’রে কেহ পুণ্যবান।।
বলাক গমিল স্বর্গে বধি অন্ধজনে।
সেই উপাখ্যান শোন বর্ণিব এক্ষণে।।

পুরাকালে ছিল ব্যাধ সে বলাক নামে।
পিতা মাতা পুত্র কান্তা ছিল তার ধামে।।
পশু বধ নাহি করে কভু অকারণে।
বধ করে পশু শুধু ক্ষুধা নিবারণে।।
সেই কারণে যায় সে বনে একদিন।
কিছু না লভি ফেরে সে শিকার বিহীন।
অবশেষে দর্শে এক সরোবর তীরে,
বারি পান করে এক পশু ধীরে ধীরে।।
দৃষ্টিশক্তি নাই তার ঘ্রাণশক্তি অতি।
দৃষ্টিহারা হ’য়ে তাই নাহি ছিল ক্ষতি।।
অতি হিংস্র সে পশু দক্ষ সে মারণে।
পশু শূন্য সে অরণ্য তাহার কারণে।।
শরাঘাতে বলাক তারে করিল নিধন।
হইলেন প্রীত তাহে স্বর্গ-বাসীগণ।।
রহিল না দুখ তার তাঁহাদের বরে।
গমিল স্বর্গে সে তার মরণের পরে।।

ভনিলেন কৃষ্ণ পার্থে সেই উপাখ্যান।
করিয়া শ্রবণ তাহা তিনি চক্ষুষ্মান।।
হইয়া প্রীত কেশব ধনঞ্জয়ে কন,
অন্য এক উপাখ্যান করহ শ্রবণ।।

অপণ্ডিত ধর্মকামী কভু হয় পাপী।
ধর্ম কর্ম করিয়াও দিবারাত্র ব্যাপী।।
কৌশিক নামে ব্রাহ্মণ ছিল এক গ্রামে।
ধর্ম কর্ম করে সদা তপোবন ধামে।।
অল্পজ্ঞানী ছিল বিপ্র কিন্তু ধর্মপ্রাণ।
ছিল তার ব্রত এক রবে সত্যবান।।
সত্যবাদী হ’য়ে বিপ্র হ’য়ে গেল খ্যাত।
শ্রদ্ধা তাই করে তারে নরনারী যত।।
একদা কয়েক ব্যক্তি দস্যুভয়ে ভীত।
কৌশিকের তপোবনে হলো উপনীত।।
কৌশিক তাদের দিল আশ্রমে আশ্রয়।
লুকাইত রহে তারা কাটে মনোভয়।।
অতঃপর তপোবনে এলো দস্যুগণ।
জানিতে চাহিল কোথা সেই ব্যক্তিগণ।।
সত্যবাদী সেই বিপ্র সত্য কথা কন।
সত্যের দেয় না দাম সেই দস্যুগণ।।
সবে মিলে তাহাদের করিল বন্ধন।
তারপর অস্ত্রাঘাতে করিল নিধন।।
কৌশিকের নাহি ছিল ধর্মতত্ত্ব জ্ঞান।
নরকে তাহার তাই হলো অধিষ্ঠান।।

কৃষ্ণ কন সাঙ্গ করি দুই উপাখ্যান,
ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা এবে কর অবধান।।
দ্বেষশূন্য কর্ম কর ধর্ম তাহা জানো।
ধারণ করে জীবে তা ইহা সদা মানো।।
শঙ্কাগ্রস্ত হয় যেথা কোন জীবপ্রাণ,
মিথ্যা সেথা নহে পাপ পাইলে প্রমাণ।।
মিথ্যা বাক্যে যদি কভু কেহ প্রাণ পায়,
জানিবে অধর্ম কভু নাহি হয় তায়।।
সত্য মিথ্যার স্বরূপ কহিনু তোমারে।
ভাব এবে ঠিক কিনা হত্যা যুধিষ্ঠিরে।।

‘পুরুষের যোগ্য বাক্য’ প্রাজ্ঞ মহামতি।
পিতৃ মাতৃ তুল তুমি, তুমি জীব গতি।।
হিতকর জ্ঞান তব দানিল অভয়।
ধর্মরাজে হত্যা নয় কহে ধনঞ্জয়।।
শুনিয়াছ তুমি প্রভু মোর পূর্ব পণ।
উপদেশ দাও প্রভু কি করি এখন।।
ভীমেরও আছে এক প্রতিজ্ঞা ভীষণ।
‘তুবরক’ যে কহিবে করিবে নিধন।।
হেন যুক্তি তুমি মোরে করহ প্রদান।
সত্য রক্ষা যাতে হয় আর ভ্রাতৃপ্রাণ।।

‘রক্ষিবারে দুই কূল শোন এই ক্ষণে,
হত্যা কর মহারাজে ‘তুমি’ সম্বোধনে।।
হেন বাক্যে জীবন্মৃত হন গুণীজন।
হইবে শপথ তব রক্ষিত তখন।।
তারপর কর তাঁর চরণ বন্দনা।
বন্দিয়া চরণ তাঁর চাহিবে মার্জনা।।
ক্রোধ তাঁর নাহি হবে তিনি প্রজ্ঞাবান।
হেনরূপে পাপ মুক্ত হবে তব প্রাণ।।

১৭। অর্জুনের সত্য রক্ষা ও
যুধিষ্ঠিরের অনুতাপ ।।

“কটুবাক্য নাহি কহ তুমি আর মোরে।
রণভূমি হতে স্থিত এক ক্রোশ দূরে।।
নাহি সাজে তব মুখে এ হেন বচন”।
ক্রোধান্বিত ধনঞ্জয় যুধিষ্ঠিরে কন।।
“ভীমেরে মানায় তবু এ হেন বচন।
ধর্মপুত্র তব মুখে বড় অশোভন।।
বিপ্রের বাক্যে বল হে ভরত নন্দন।
ক্ষত্রিয়ের বাহু বল কন বিজ্ঞজন।।
তোমারও বাক্যবল হেরিলাম আজ।
নিষ্ঠুর তুমি নির্দয় তুমি মহারাজ।।
মম আচরণ তব নহেক অজ্ঞাত।
হিত সাধনের চেষ্টা করি অবিরত।।
হিত হেতু কুণ্ঠা নাই এ জীবন দানে।
নিজ প্রাণ বলি দিতে নাহি ভয় প্রাণে।।
তথাপি নিঠুর বাক্যে করিলে আহত।
সুখ নাহি মোর তাই মনে ল’য়ে ক্ষত।।
হেয় নাহি কর মোরে দ্রৌপদী-শয্যায়।
তোমারি কারণে আমি বধিলাম হায়।।
বধিলায কত রথী মহারথগণে।
তবু তুমি বিদ্ধ কর নিঠুর বচনে।।
অধিরাজ পদ পেয়ে হয়েছ গর্বিত।
কটুবাক্যে সেই পদ কর কলুষিত।।
দ্যূতাসক্তিতে ঘটিল যতেক ব্যাঘাত।
তবে কেন কর মোরে বাক্য-কশাঘাত”।।

এহেন পরুষ-বাক্যে বিদগ্ধ অর্জুন।
উদ্যত তাই নিজেরে করিবারে খুন।।
“যে শরীরে করিলাম কটু আচরণ,
এই ক্ষণে তাহা আমি করিব বর্জন”।।

হেন হেরি কৃষ্ণ পার্থে কহেন তখন,
শোকগ্রস্ত কেন ক’রে ‘তুমি’ সম্বোধন।।
আত্মহত্যা কাম্য নয় সে যে মহাপাপ।
ভ্রাতৃহত্যার চেয়েও গুরুতর পাপ।
নিজ মুখে কর তুমি নিজ গুণগান।
হইবে তাহাই আত্ম হত্যার সমান।।

ধনুরে প্রণাম করি অর্জুন তখন,
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তাঁর যুধিষ্ঠিরে কন,
“মোর তুল্য ধনুর্ধর কেহ আর নাই।
আছেন পিনাকপাণি জানি আমি তাই।।
তিনি যদি অনুমতি দেন একবার,
মুহূর্তে বিনষ্ট করি ভব-সংসার।।
রাজসূয় যজ্ঞ মোরা করিবার কালে,
আনিলাম বশে আমি যত দিকপালে।।
দিব্যসভা তৈরি করি তেজেতে আপন।
হলো তাই বাধাহীনে যজ্ঞ সমাপন।।
ডান হস্তে বাণ মোর বাম হস্তে ধনু।
পদ তলে রথ মোর রথধ্বজে হনু।।
অজেয় আমি আজ এ বিশ্বচরাচরে।
কেহ নাহি ত্রিভুবনে বধিতে আমারে।।
সংশপ্তক অল্পই আছে অবশেষ।
অর্ধোত্তর শত্রুসেনা একা করি শেষ।।
অস্ত্র দ্বারাই অস্ত্রজ্ঞে করিনু নিধন।
অস্ত্রহীনে কভু নাহি করিনু হনন।।
শ্রবণ করহ তুমি হে মধুসূদন।
রণাঙ্গণে শীঘ্র মোরা করিব গমন।।
সূতপুত্র কর্ণ সনে রণি তথা রণে,
হনন করিব তারে পণ আজি মনে।।
মুক্ত নাহি করিব এ কবচ বন্ধন।
সূতপুত্র কর্ণে নাহি করিয়া হনন”।।

ত্যাজি ধনু প্রণমিয়া দাদার চরণে,
কহিলেন তাঁরে পার্থ দুঃখিত মনে,
“আমারে করুন ক্ষমা আজি মহারাজ।
রূঢ়বাক্য আর মোর অকর্তব্য কাজ।।
বুঝিবেন ছিল কিবা উদ্দেশ্য আমার।
করিবারে সূতপুত্র কর্ণে সংহার।।
হিত সাধনার্থে আমি সঁপিব জীবন।
কর্ণ নিধনে এখুনি করিব গমন।।

ত্যাজি শয্যা ধর্মরাজ দুঃখিত মনে,
“অসাধু কর্ম করেছি” কহেন অর্জুনে।।
“কুলনাশকারী আমি তাই মনে খেদ।
এ পুরুষাধমে তুমি কর শিরশ্ছেদ।।
অকর্মণ্য ভীরু পাপী মূঢ় বুদ্ধি হায়।
যুদ্ধ জয় ক’রে মোর কিবা লাভ তায়।।
হীন ক্লীব আমি তাই যাব চলে বনে।
প্রজাগণের দায়িত্ব দিয়া ভীমসেনে ।।
তব রূঢ়বাক্য আমি সহিব কেমনে।
কিবা প্রয়োজন মোর এহেন জীবনে”।।

বিনীত কেশব কন, “শুনুন রাজন,
আপনার চরণেতে লইনু শরণ।।
রূঢ়বাক্য শুধু তার প্রতিজ্ঞা পূরণে।
প্রার্থনা মোদের ক্ষমা করুন এক্ষণে।।
এখুনি গমিব রণে রাখিবারে মান।
রণভূমি কর্ণ-রক্ত করিবেই পান”।।
কহিলেন যুধিষ্ঠির, “শোন হে গোবিন্দ,
অজ্ঞতার অন্ধকারে ছিনু মোরা অন্ধ।।
দয়ার সাগর তুমি করুণা অপার।
বিপদ হইতে সবে করিলে উদ্ধার”।।

অশ্রুধারা বয়ে চলে অর্জুন-নয়নে।
যুধিষ্ঠির পদে তিনি শায়িত পতনে।।
ভ্রাতারে তুলিয়া বক্ষে করিয়া ধারণ,
একসাথে দোঁহে তাঁরা করেন রোদন।।

দৃঢ় চিত্তে পার্থ পরে যুধিষ্ঠিরে কন,
“পরশিয়া আপনারে করিলাম পণ,
আজিকেই রণে কর্ণে করিব হনন।
নতুবা আমিই স্বর্গে করিব গমন”।।

সুপ্রসন্ন যুধিষ্ঠির কহেন অর্জুনে,
“জয়ী হও তুমি তব অক্ষয় জীবনে।।
জয় হোক তব শত্রু করিয়া নিধন।
অভিষ্ট লভিয়া কর সার্থক জীবন।।
★★★
(চলবে)

নতুন ভাবে মহাভারতের কাব্যরূপে ধারাবাহিক ভাবে লিখে চলেছেন কবি কৃষ্ণপদ ঘোষ মহাশয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *