গল্প : কচু গাছার মাঠ
লেখক: কবিরুল
✍️✍️✍️✍️✍️✍️
ভূত , ভৌতিক ব্যাপার এই ঘটনা গুলো নিয়ে কৌতূহল সকলেরই কম বেশী আছে। ভূতকে কে না ভয় করে। সকলেরই কম বেশী ঐ বিষয়টির প্রতি একটু আধটু দুর্বলতা আছে। ভূতের নাম শুনলেই কেমন যেন গা ছমছম করে। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ভূতের ভয় বলে কথা।
বন্ধুদের মধ্যে দীনেশই একমাত্র সাহসী। ভূত আর ভৌতিক বিষয়ে দীনেশের আগ্রহও অপরিসীম। দীনেশ বরাবর অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসে। অনেকবার চ্যালেঞ্জ করে ভৌতিক পরিবেশের মোকাবিলা করেছে। আর চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছে। ওর জীবনে বহুবার ভূত দর্শন হয়েছে। ভূতের গন্ধ পেলেই দীনেশ ছুটে যায়। ভৌতিক কাহিনী নিয়ে দীনেশ অনেক গল্পও লিখেছে।
দীনেশই জেদ ধরল যে অনুষ্ঠান পয়লা বৈশাখশের দিন করতে হবে। অনুষ্ঠানের লোকেশনও ঠিক করে ফেলেছে। ” দলছুট ” ব্যাণ্ডের এটা একটা বেশ বড় অনুষ্ঠান। দলের ছেলেদের রক্তে যেন বোহেমিয়ান শিহরণ।
রাগঞ্জের বিদ্রোহী মোর থেকে খুব তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে দিনেশ ও তার দলবল বেরিয়ে গেল ।দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুরের কাছেই অনুষ্ঠান।
মানালী অবশ্য বারণ করেছিল ওখানে অনুষ্ঠান না করতে। যেখানে অনুষ্ঠান পথে যেতে তার একটু আগেই একটা বিশাল মাঠ পড়বে। মাঠটা সবাই এড়িয়ে যেতে চাই কারণ তার প্রোফাইল খুব ভাল নয়।মাঠটার নাম কচু গাছার মাঠ। ঐ মাঠের অনেক ইতিহাস আছে। দিনের বেলায় কেমন একটা গা ছমছম ব্যাপার থাকে। কেউ সাহস করে ঐ পথ মাড়ায় না। দীনেশ সব জেনে বেশ লাফিয়ে উঠশ। অনেক দিন পর দীনেশ একটা রোমাঞ্চের স্বাদ পেয়েছে।
কেমন একটা গা ছমছমে ভাব রয়েছে ঐ মাঠে। বিমান আর আসমা দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়ে একে অপরকে ভালবেসে ছিল। ওদের প্রেম পরিণতি পাইনি। আর যার পরিণাম তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছিল।ঐ কচু গাছার মাঠেই দুজনে মারা যায়।সেই থেকে সবাই ঐ মাঠটা এড়িয়ে চলে।
কথা গুলো শুনেই বিদিশার বুকটা কেমন ধরাস করে উঠল। আকাশে হালকা মেঘ করেছে। কালো হয়ে এসেছে চারিদিক।এখনও বেশ কিছু পথ বাকি রয়েছে। দীনেশের কোন উত্তাপ নেই। ও বেশ খোশ মেজাজেই আছে।
বিমান আর আসমা সম্বন্ধে অনেক কথায় শোনা যায়। বিমান ভাল গিটার বাজাত। মাঝে মাঝে কলকাতার কোন নামী ব্যাণ্ড থেকে ডাক পেত। গান বাজনা করে কিছু আয় করত। আর গাড়ি চালাত। আসমাও ভাল গান করত।
দিনেশ একমাত্র ওর ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিল। আর বাকিরা গাড়ির ভিতরে আর কেউ কেউ অন্য গাড়িতে।
দিনেশ হঠাৎ লক্ষ্য করল ড্রাইভারের সিটটা পুরো ফাকা। ড্রাইভার ছাড়াই গাড়ি চলছে। দীনেশ দেখেই কেমন আঁতকে উঠল। চশমাটা আরেকবার মুছে দেখল।না ঠিকই দেখেছে। গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। দীনেশ বেশ হকচকিয়ে গেল।
হঠাৎ করে গাড়িটা এক বাঁকের মুখে এসেই থেমে গেল। না ড্রাইভার সিটেই আছে। তবে তার গাড়ির মিউজিক সিস্টেমের মিউজিক একটু চেঞ্জ হয়েছে। গিটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দীনেশ কিছুই বুঝতে পারল না।
দীনেশ যখন ড্রাইভারের এই বিষয়টা সবাইকে বলল সবাই কেমন হেসে উড়িয়ে দিল।কেউ কেউ দীনেশকে ভীতু বলে ব্যঙ্গ করল। অবশেষে অনুষ্ঠানের মূল জায়গায় আসা গেল।
অনুষ্ঠান শুরু হতে একটু দেরী হল বটে। ভালই ভিড় হয়েছে। অনুষ্ঠান বেশ জমে উঠেছে। হাততালি বেশ ভালই পড়েছে। বেশ কিছুক্ষণ প্রোগ্রাম চলার পর হঠাই করে আখতারের গিটারের তারটা ছিঁড়ে গেল। আর হঠাৎ করে স্টেজের সব আলো নিভে গেল। সকলে বেশ অবাক হল।
অনুষ্ঠান যখন জমে উঠেছে তখন এই বিপত্তি। দীনেশ একটু ঘাবড়ে গেল। যাইহোক দীনেশের একটা সাবস্টিটিউট প্ল্যান রেড়ী থাকে। প্রবীরকে আখতারের জায়গায় পাঠান হল। প্রবীরও ভাল বাজায়।
দীনেশ সহসা লক্ষ্য করল দূর থেকে একটা গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। সুরটা চেনা। গাড়িতেই আজ বাজছিল। যখন দীনেশ দেখল ড্রাইভার ছাড়াই গাড়িটা চলছিল। সুরটা সত্যিই খুব সুন্দর আর অদ্ভুত।
একটা মাতাল করা সুর কচু গাছার মাঠ থেকেই আসছে। সুরের মোহিনী জাদু পুরো অবশ করে তুলছে দীনেশকে। দীনেশ ঐ দিকেই গেল যেদিক থেকে সুরটা আসছে।
দীনেশ মাঠে পা রাখতেই একটা থমথমে ভাব ফিল করল। ঘুটেঘুটে অন্ধকার। জনমানবহীন এই মাঠে কে বা গিটার বাজাবে? আর হঠাৎ এখানেই বাজাবে কেন? গিটারের সুরটা বেশ করুণ। কাছে আসতেই সুরটা আরো স্পষ্ট হল। আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করল বিমান। একটা মহিলা শালোয়ার কামিজ পড়া, ঐ সুরের তালে তালে নাচ করছে। মেয়েটা দীনেশের সাথে যেন লুকোচুরি খেলছে। দীনেশ এবার একটু ভয় পেল।
এদিকে দীনেশদের অনুষ্ঠান অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সবাই ওর খোঁজ করছে। দীনেশের মোবাইল থেকে কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সুইচ অফ বলছে। ওর দলের সবাই চিন্তিত। ঘড়ির কাঁটা যত এগোয় চিন্তার পারদ তত বাড়ে।
এদিকে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আজ রাতেই ফেরার কথা সকলের। বিদিশা বেশ রেগে গেছে। সময় পেরিয়ে চলেছে।
দীনেশ আস্তে আস্তে গীটার বাদকের বেশ কাছেই চলে এসেছে। অন্ধকারে মুখটা বোঝা যায় না। ওর একটু দূরেই একটা মেয়ে একটা তাঁতের শাড়ি হাতে ধরে কাঁদছে। দীনেশ আজ রিয়েলি ভয় পেয়ে গেছে।
চলার শক্তি নেই। গোটা শরীর যেন অবশ। কাছে যেতেই দেখল একটা কংকাল গিটার বাজাচ্ছে। দীনেশের মাথার চুল ভয়ে খাড়া হবার জোগার। একটা নরম মোলায়েম হাত কেউ যেন ওর কাঁধের উপর রাখল। সম্ভবত ঐ মেয়েটা।
তারপর আর কিছু মনে নেই দীনেশের। সকালে জ্ঞান ফেরার পর একটু হালকা নিশ্বাস নিল। এক কাপ চা হাতে ধরল বেশ কাঁপা কাঁপা হাতে। ওর মুখ থেকেই সব ঘটনা শোনার পর সকলে স্তম্ভিত। একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এসেই সব ঘটনা খুলে বলল।
গতরাতে বিমান এসেছিল। বিমান গান বাজনা ভালবাসে। কোথাও অনুষ্ঠান হলে ওর অশরীরি আত্মা মাঝে মাঝে দেখা দেয়। সংগীতের মোহে চলে আসে। গতরাতে সেটাই হয়েছিল।
বহুদিন আগের কথা।
একবার কলকাতায় অনুষ্ঠানে গান করার ডাক পায় বিমান। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে অনুষ্ঠান শেষ করে আসমার জন্য একটা শাড়ি আর কিছু জিনিস কেনে। ফেরার পথে বিমানের গাড়ি এক্সিডেন্ট করে ঐ কচু গাছা মোড়ের কাছেই। গাড়ির ভিতরেই বিমানের মৃত দেহ পাওয়া যায়। পাশে পড়ে থাকে রক্তে ভেজা আসমার জন্য আনা শাড়িটা। আসমা খবর পায় অনেক দেরীতে। তারপর প্রবল শোকে ও সুইসাইড করে কচু গাছের রস খেয়ে। সেই থেকে মাঠটার নামও হয় কচু গাছার মাঠ। আর সেই থেকে ঐ মাঠে বিমান আর আসমার আত্মা আজও ঘুরে বেড়ায়। ওরা ওদের ভালবাসা ওখানে ফিরে পায়।
সব ঘটনা শোনার পর সকলের শরীর ভয়ে হিম হয়ে যায়। দিনেশও খুব ভয় পেয়ে গেছে। এই প্রথম দীনেশ ভূতের ভয় পেল। মুখ পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মুখের থমথমে ভাবটা এখনও যায়নি।
ফেরার পথে মাঠে একটা গিটার পড়ে থাকতে দেখল সবাই। আর গিটারের কাছাকাছি আরো একবার দীনেশ লক্ষ্য করেছিল গাড়িটা মাঝে মাঝেই ড্রাইভারহীন হয়ে যাচ্ছে।
সত্যিই গাড়িটা দুই থেকে তিনবার ড্রাইভারহীন অবস্থায় চলল। এবারে দীনেশ না, দলের অন্যরাও দেখল।সবার গায়ের লোম ভয়ে খাড়া হতে শুরু করেছে।
তবে কি ওটা বিমানের আত্মা ছিল?
হয়ত তাই।
https://www.patrika.kabyapot.com