Spread the love

কবিতার সাথে  ব্যক্তিগত কিছু মুহূর্ত “ছোটো খোকা বলে অ আ …”, “ঘণো মেঘ বলে ঋ …”  সেই কোন শৈশবে কবিতা এসে ধরে ছিলো আমার হাত ভুলে গেছি, তবে নিশ্চিত আমি কবিতার হাত ধরিনি তখন। রবি ঠাকুরকে তখন একটা লম্বা দাড়ি গোঁফ ওয়ালা লোক ছাড়া আর কিছু ভেবে ছিলাম বলে মনে হয়না। কবিতা আর রবি ঠাকুরকে মিশিয়ে কবিগুরুর আনুভূতিক ছবি হৃদয়ের ক্যানভাসে আপন আত্মার রঙে ফুটে উঠেছে অনেক পরে। আর তারও অনেক পরে কবিতার সাথে লাজুক আলাপ ও পরিচয়। আর ব্যক্তিগত নিভৃত কথার শুরু তো এই, কিছু কাল আগে।           জন্মের পর প্রথম যে কবিতার সাথে আমার দেখা হয়েছিল, তখন তো জানতাম না যে সেই আসলে বড়ো একটা কবিতা গোটা জীবন ময়, তারপর যে দিন মুখ দিয়ে প্রথম ভাষার প্রকাশ হয়েছিলো, একটা আদি অন্তহীন অনন্ত কবিতা বেরিয়ে এসেছিলো আমার অনন্ত নিরূপাধিক আত্মা থেকে আপন স্বতঃস্ফূর্ততায় একটা ছোট্টো শব্দে অর্বুদ কোটি অনুভবের ভাষায় শব্দ হীন কবিতা নিয়ে, সেই আমার প্রথম কবিতার সাথে ব্যক্তিগত কিছু কথা। সেই একক শব্দের অর্বুদ কবিতা “মা”। যদিও তখন ওই কবিতায় সংজ্ঞা দানা বেঁধে ওঠেনি, এখনও না। পাশাপাসি আর একটা অতি নিবিড় নীরব গভীর কবিতার নিরন্তর স্রোত “বাবা”, চির বহমান। দুই অনন্ত কবিতার স্রোতের মাঝে বয়ে চলতে চলতে কথা বলতে বলতে খুঁজে পেলাম সংজ্ঞায় বাঁধা কবিতার দল, শুরু হলো কথা তাদের সাথে, তবে সেই দুটো কবিতার স্রোত ছুঁয়ে ছুঁয়েই।            সেই দুটো কবিতার হাত ধরে আর মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে রবি ঠাকুরের সাথে প্রথম চেনা হয়ে গেলো; সহজ পাঠের পাতায় সেই সহজ কবিতাটার সাথে কথা বলতে বলতে প্রথম খুঁজে পেলাম অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জগদ্-ব্যাপী অদ্বিতীয় সত্তার অনুভব, যদিও তখন এটা বুঝিনি, –                                  “রোজ রোজ ভাবে ব’সে প্রদীপের আলো,                                   উড়িতে পেতাম যদি হ’ত বড়ো ভালো।                                   ভাবিতে ভাবিতে শেষে কবে পেল পাখা –                                   জোনাকি হল সে, ঘরে যায়না তো রাখা।” কেমন অদ্ভুত মনে হয়, বিস্ময় জাগে। তখন এই সব কবিতার সাথে একলা কথা বলতে বলতে চুপ করে বসে মনে মনে কতো রঙীন সচল ছবি আঁকা হয়ে গেছে, আর আজ কথা বলে খুঁজে পাই জীবনের রূপান্তর, অনুভবের গভীরতর গভীরে জীব জড়ের অদ্বিতীয়ত্বের একক প্রকাশ। সেই কিশলয়ের পাতাতে –                                   “একদিনও কি দুপুর বেলা হলে                                   বিকাল হলো মনে করতে নাই?                                    আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে                                    সুয্যি ডুবে গেছে মাঠের শেষে,” সত্যিই তো, আত্মিক অনুভবেই আত্মার সৃষ্টি, জগতের অস্তিত্ব, নিত্যতা আর অনিত্যতা। সময়ের আপেক্ষিকতায় জীবদেহের আবস্থানিক তারতম্যে সূর্যের উদয়, আস্ত কিন্তু অনুভবের একাত্মিকতায় সে তো একেবারেই ভিন্নতর। কবিতার সাথে নিভৃত আলাপ চারিতায় অতীন্দ্রিয়মন জাগে ঐন্দ্রিক মননে। কবিতার সাথে কথা বলতে বলতে আপন সত্তাকে খুঁজে ফিরি অতীত ও ভবিষ্যতের সময়ের স্রোতে পারমাণবিক অস্তিত্ব থেকে মহাজাগতিক বৃহতে। কখনো আমার অস্তিত্ব হারিয়ে যায় অতীন্দ্রিয় কবিতার শব্দহীন ভাষায়, কখনো বা কবিতারা আমিত্বের অনবিকতায়।                      কবিতার সাথে কথা বলতে বলতে কবিতার হাত ধরে পথ হেঁটেছি কখনো আকাশের ছায়াপথে, পৌঁছে গিয়েছি মহাজাগতিক প্রান্তসীমায় কিন্তু সেখানে কোনো সীমানা নেই, এক অনন্ত মনন, চিন্তন আর বিজ্ঞান বহমান সময়ের ব্রহ্মত্বে। তবে কবিতার সাথে ব্যক্তি গত কথা আর পথ চলায় যখন ঢুকে যাই প্রকৃতির রাজ্যে তখন মননে চিন্তনে ধরা পড়ে প্রকৃতির অন্য এক রূপ।           রূপ, রস, গন্ধের বিচিত্রতা নাকি ভিন্ন দেহের ভিন্ন ঐন্দ্রিক স্নায়ুতন্ত্র কিংবা পুঞ্জীভূত চিন্তা রূপ আত্ম-সত্তায় বৈচিত্র্য; প্রশ্ন জাগে অনুভূতির পরিধিতে, কোন অস্তিত্বের ভিত্তিতে কিসের বিদ্যমানতা অথবা কোন সেই ‘নিত্যই একমাত্র সত্য’ (only the permanent is real)। আমার কবিতা আসে তখন আমার পাশে নিভৃত আলাপ চারিতায়। ভাষা আর ছবি খুঁজি আমি আর আমার কবিতা হাতে হাত ধরে কখনো পাহাড়ে কখনো জঙ্গলে, নদীতে, সাগরে, আকাশে, বাতাসে, ফুলে, ফলে, জীবে, জড়ে। কোথাও ছন্দ পাই, কোথাও শব্দ পাই, কোথাও চিন্তা পাই, কোথাও অনুভূতি পাই, কোথাও আবেগ পাই, কোথাও ভালোবাসা পাই, কোথাও প্রেম, কোথাও দায়িত্ব, আরো আরো আরো কতো কি; শত শত ছবি আণবিক অনুভবের বিকিরণে রঙিন; সব তুলে দিই আমার কবিতার হাতে, ওই বসে বসে গাঁথে ছড়ার মালা, পদ্যের সাজি, কিছু গল্পের ডালি। ছন্দের জাদুরা নেমে আসে মাঝে মাঝে কখনো মিটি মিটি তারাদের দেশ থেকে, ঝর্ণা থেকে, নদী থেকে, বৃষ্টি থেকে, ঝড়, মেঘের গর্জন থেকে কখনো বা শহরের জটলা থেকে, ট্রেনের হকারদের ভাষেন্দ্রজাল থেকে, ফেরিওয়ালার শব্দসুর থেকে, কখনো বা প্রাণীর ডাক থেকে, আরো কতো আসে, মন থেকে, প্রাণ থেকে, আত্মা থেকে; সব কবিতার হাতে তুলে দিই। ও বসে বসে বুনে চলে, আমি চেয়ে চেয়ে দেখি – “শব্দের পাহাড়ে,   ছন্দের বাহারে, প্রজাপতি, ভ্রমরে চোমে ফুল। কলি ফোটে কবিতায়,   অলি জুটে মধু খায়, ছন্দেরা দোল খায়                                                                               দুল্ দুল্।” প্রকৃতি এসে ধরা দেয় ভাষার লাবণ্যে রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ নিয়ে অনুভূতির পারমানবিক বিভাজনে ও বিকিরণে। কবিতার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা প্রকাশিত হয় শব্দমানতায়। কখনোবা গভীর অনুভবের জটিলতায় শব্দেরা দুর্বোধ্য নীরব স্থির হয়ে থাকে। কতো রকম প্রশ্ন জাগে – “সেই নতুন দেশে  তুমি হয়ে আর আমি হয়ে থাকবো তো ?? নাকি সব ঘুমের শেষে  তুমি আমি নেই, আছে অনন্ত নিদ্রায় শায়িত বিষ্ণু অনন্ত সময়ের ব্রহ্মে ?? !! ?? !!” আমার কবিতারা কখনো ডেকে নিয়ে আসে ‘রবি ঠাকুর’, ‘নজুরুল’, ‘জীবনানন্দ’, …   …   …, সাথে আসে ‘আমি’, ‘বিদ্রোহী’, ‘হওয়ার রাত’ …   …   …। অনন্ত কবিতার জীবনের কথা শুনতে শুনতে আমার অস্তিত্ব হারিয়ে যায় ধুলি কণার মতো আয়নিত কবিতার নীহারিকায়। – ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাইনা আর’           কবিতার সাথে ব্যক্তিগত কিছু কথার শেষে হয় না কোনো দিনই, বেশিটাই অবশিষ্ট থেকে যায়। কবিতার সাথে এক দিনের ব্যক্তিগত কিছু কথোপকথন শোনাই – কবিতা ! তোমার হৃদয় কোন কবি ? কবিতা হৃদয়ের দ্বার খুলে দেখায় – হয়তো আমার চেনা, হয়তোবা অচেনা । আর তোমার হৃদয়ে কোনজন ? কবিতা হৃদয়ের দ্বার খুলে দেখায় । কই ? ওখানে তো কবি নেই ! আছে – , নিরুপাধিক, শতরূপি, বহুরূপি । আছে জীবন, আছে আনন্দ। আছে রবি, আছে প্রেম। এখানে বরফ ভেঙে জল ভেঙে বায়ু, এখানে গাছ থেকে ফল ফেটে বীজ থেকে চারা, আছে উল্টো পথও। এখনে আলোয় ফোটে আঁধার, আঁধারে ফোটে আলো। আমিই কবিতা, কবি নেই ! হয় না ! তবুও তুমি কার ? আমি অনুভূতি আত্মার, আমি আমার, আমার, আমার। তুমিও আমার শুধু তাই, আমি শুধু তোমার।। কবিতার সাথে বেশি কথাই অবশিষ্ট আছে এখনও। যেটুকু হয়েছে তাও সব বলা যায়না বা বলে শেষ করা যায় না। শেষ হবে না বা শেষ করা যাবে না কোনো দিনই। কারণ নিত্য অনিত্যের ভিড়ের ঠিক মাঝে আছে রূপান্তরের অদৃশ্য বাঁক। আর এই অদ্ভুত খেলার মাঝে আছে ক্ষুদ্রতম চরম নির্গুণ সত্যের ভাগাভাগিজাত সগুণিকরণ। … মানবেশ মিদ্দার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *