Spread the love

 লেখক পরিচিতি :

মৃন্ময় ভট্টাচার্য্য

জন্ম সন – ১৯৬৫
পড়াশোনা “সাম্মানিক স্নাতক”, চন্দননগর গভঃ  কলেজ ।

ঠাকুরদা ছিলেন ভাটপাড়ার বিখ্যাত পন্ডিত রসসাগর হরিচরণ ভট্টাচার্য্য ।

পিতা বিশিষ্ট ব্যায়ামবিদ বিশ্বশ্রী মনোতোষ রায়ের ব্যায়াম শিক্ষক তাপস ভট্টাচার্য্য । কলকাতা থেকে প্রকাশিত “ব্যায়াম চর্চা” পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ।

প্রধানত বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ ও কবিতা লিখার প্রতি আগ্রহ ।
বহু সামাজিক মানব কল্যাণ সমিতির সাথে যুক্ত ।

অসুখে লুকানো সুখের খোঁজে
                     মৃন্ময় ভট্টাচার্য্য

সময় থেমে থাকেনা, নদীর জল সদা প্রবহমান,  জীবনের সবকিছুই তেমনই চলমান । গতি মানেই জীবন, কেবল মৃত্যুতেই সবকিছুর ফুলস্টপ । এই ফুলষ্টপের আগে জীবনে নানা মাপের কমা, সেমিকোলন, এস্ক্লামেশনের ছড়াছড়ি ।

আমরা স্কুলে পড়েছি সূর্যের চারদিকে এক নির্দিষ্ট কক্ষপথ ধরে পৃথিবী আবর্তিত হচ্ছে, জানি তার জন্যই ঋতু পরিবর্তন হয়, সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা । কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা যে গতবছর আজকের দিনে পৃথিবী মহাকাশের যে অঞ্চলে ছিল, আজ আছে তার থেকে বহু দূরে । কারণ সূর্য প্রতি ঘন্টায় ৮ লক্ষ ২৮ হাজার কিলোমিটার গতিতে দৌড়চ্ছে আমাদের গ্যালাক্সি আকাশগঙ্গা বা milkiway কে কেন্দ্র করে । সুতরাং গত এক বছরে সূর্য পাড়ি দিয়েছে ৮,২৮,০০০×২৪×৩৬৫.২৫= ৭২৫,৮২,৪৮,০০০ মানে ৭২৫ কোটি ৮২ লক্ষ ৪৮ হাজার কিলোমিটার । সঙ্গে নিয়ে চলেছে পৃথিবীকেও । সুতরাং পৃথিবী সেই অবস্থানে আর ফিরবেনা কোনোদিনও । যা গেছে তা গেছে ।

ঠিক এভাবেই আমি গতকাল যে আমি ছিলাম, আজ আমি সে আমি নই ।পরিবর্তন হয়ে চলেছে শরীরে, মনে, ভাবনায়, লক্ষ্যে ক্রমান্বয়ে । একটু একটু করে হয়ে চলেছে বলে তা সহজে আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না ।

বোধ যত ধারালো হবে, সহ্য ক্ষমতা ও এইসব পরিবর্তনকে মেনে নেওয়াও ততই সহজ হবে । একটা ব্যক্তিগত উদাহরনেই তা স্পষ্ট করা যাক ।

এই দু-হাজার কুড়ি সালটা সব মানুষের জীবনেই অনেক পরিবর্তন এনে দিল, যা গত বছরগুলিতে কল্পনাতে আনাও সম্ভব ছিল না, আপনি গত দুর্গাপুজোয় কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে আগামী দুর্গাপুজোতে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক হবে ?    মোটেই না ।

এই করোনার প্রকোপে সবাইকার জীবনেই কমা, এস্ক্লামেশন বা সেমিকোলন পড়েছে, যারা একান্ত দুর্ভাগা তারা পেয়েছেন ফুলস্টপ, আমার সৌভাগ্য আমার জীবনে কমা পড়েছে, ফুলস্টপ হলে তো এই লেখাটা  লিখতেও পারতাম না ।

হঠাত করে ২৫ শে মার্চ দেশের অধীশ্বরের এক আদেশে সারা দেশে লকডাউন শুরু হলো, আর আমার গৃহের সর্বোচ্চ ক্ষমতার যিনি অধিকারীনি তিনি ঘোষনা করলেন “গৃহে বাইরের লোকের প্রবেশ নিষিদ্ধ ” । ব্যাস !  তার  মানে দাঁড়ালো বাড়ির কাজের দিদির জন্যও দরজা বন্ধ ।

কিন্তু পেট যে বড় দায়, লকডাউন সে  মানে না, তার সদা জ্বলন্ত গহ্বরে জ্বালানি না ভরলে জ্বলতেই হবে, একদিনও বন্ধ করার উপায় নেই,  সেই পেটের জ্বালা মেটাতে হলে রান্নাঘরে আদিম উনুনের আধুনিক সংস্করণ গ্যাসের ওভেন জ্বালাতেও হবে, রান্নাও করতে হবে, বাসনও মাজতে হবে । ঘরকে আস্তাকুড় বানাতে না চাইলে নিয়মিত ঘর ঝাট দিতে হবে, ন্যাতা দিয়ে মুছতে হবে । আশঙ্কিত হচ্ছি বন্ধ ঘরের উষ্ণতা দূষিত প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগামীতে শ্বাসযোগ্য থাকবে কিনা সন্দেহ । অবস্থা সঙ্গীন । জাপানের মতো ঘরের কাজের রোবট এই লকডাউনের বাজারে পাবো কোথায় !  পেলে তো ল্যাটা চুকেই যেত ।

এতকাল যার শাসনে আমার পায়ে বেড়ি পড়া ছিল,  আজ লকডাউনের বদান্যতায় তিনি সে শিকল খুলে দিলেন । জানেন বাইরে বেড়োবার জো নেই, পুলিশে ধরছে । বন্ধু বা প্রতিবেশীর বাড়িতে আড্ডা মারার কথা স্বপ্নেও ভাবার আর সাহস থাকার কথা নয় ।

ঘরের কাজের ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেল । আমার ভাগে পড়লো ঘর মোছা, তাঁর বাসন মাজা । সকালে ছেলে বিছানায় বসে পড়ছে , আমি তার নিচে মেঝেতে সদ্য নিযুক্তি প্রাপ্ত কাজের কৌশল রপ্ত করতে ব্যাস্ত ।  একটি বিবর্জিত কাপড় যদি জলে ডোবানো হয়, সে ন্যাতা রূপ ধারণ করে, আমিও নাছোড়বান্দা, এক বালতি জল আর ঐ শিরদাঁড়াহীন ন্যাতা নিয়ে লড়ে যাচ্ছি । ঘরের দেওয়ালের কাছে উবু হয়ে বসে মেঝেতে তাকে ঘষে যাচ্ছি আর একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছি দরজার দিকে, যেভাবে বাঙালী স্বাধীনতার পর থেকে পিছতে পিছতে আজ রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেভাবেই ।

আজ সত্যিই নিজেকে একেবারে চাকর বাকর মনে হচ্ছে,  মন না চাইলেও ন্যাতা চাইছে চলতে , তাই চলতে হবেই । ঠিক অফিসে ট্রেডইউনিয়নের নেতাদের পেছনে রাস্তায় টাকফাটা রোদে যেমন বাধ্য হয়ে চলতে হয় । বুঝতে পারছি বাস্তবে ঐ নেতিয়েপড়া ন্যাতাকেও আটকাবার ক্ষমতা ও যে আমার নেই , এই নির্ভেজাল সত্যটা আজ বুঝতে পারলাম । কেউ মানুক আর নাই মানুক, আমি তো জানি এই বাড়ির কর্তা আমিই, সেই কর্তা হয়ে ন্যাতা ঘষে আজ যেন মুখে ঝামা ঘষার স্বাদ পাচ্ছি , হায় কপাল !

ভাবনায় একটু পরিবর্তন আনলাম, দুঃখের মধ্যে সুখের খোঁজে নেমে  পরলাম । আমি আর্থাইটিস বা বাতের ব্যাথায় মাঝে মাঝেই ভুগি , দেখলাম ঘর মোছার মাধ্যমে রোজ সকালে অনেকটা ব্যায়াম তো সহজেই হয়ে যাচ্ছে, ঠিক করলাম শরীর ফিট রাখতে হলে এই ঘরমোছার কাজ কিছুতেই ছাড়া চলবে না । কদিনেই পেটের ভুঁড়িটা উধাও ! শরীরটাও এখন অনেক ঝরঝরে, কাজের প্রতি উৎসাহ অনেক বেড়ে গেছে, মনটা এখন  হতাশা কাটিয়ে কষ্টকেই কেষ্ট ভাবতে শুরু করেছে ।

সুস্থ থাকতে হলে দুষ্ট ভাবনাদের দূর করতে হবে । প্রত্যেক নেগেটিভের ভিতরে পজেটিভের বীজ লুকিয়ে আছে, বোধ জাগ্রত হলে তা অঙ্কুরিত হয়ে মহীরুহে পরিণত হয়, হলে তাতেই সব রুদ্ধ দরজা আবার আনলক হবে,বাতের বেদনা ভুলে, ঘরের মেঝের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর কৃতিত্বে গৃহশ্রী পুরস্কার গৃহকর্ত্রী তুলে দেবেন হাতে, তাঁকে আর শাসক ছেড়ে আবার প্রেয়সী মনে হবে ।

চলুন ফুলস্টপ আসার আগে যে কটা শব্দ এখনো লেখা আছে বাকি, সেগুলো সব পজেটিভই  লিখে যাই ।
                       -:-:-:-:-:-:-:-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Contact for Advertisers, Readers and Writers : email: info@kabyapot.com Whatsapp: 8240042145