Spread the love

বুন্দেলখন্ডের দিনগুলি – দ্বিতীয় পর্ব

নীরেশ দেবনাথ

বুন্দেলখন্ডের এই অঞ্চলটা বেশ সুন্দর। সাগর শহরটাও। ট্রেনে করে এলাহাবাদের দিক থেকে আসতে কাটনি স্টেশনে ট্রেন পাল্টে সাগর যাবার জন্য ট্রেন ধরতে হয়। বিন্ধ পর্বতশ্রেণী পার হয়ে মালব মালভূমির উপর ছোট্ট সুন্দর সাজানো শহর সাগর অবস্থিত। এখানে একটা মিলিটারী রেজিমেন্টের ট্রেনিং সেন্টার আছে। তা ছাড়া একটা ব্রিগেড, আমাদের ই এম ই ব্যাটালিয়ন। আর আছে এখান থেকে একটু দূরে ধানাতে একটা ব্রিগেড। মিলিটারির ক্যাম্প ছাড়াও সাগর শহর পার হয়ে পুব দিকে এসে একটু চড়াই উঠে আমাদের ব্যাটালিয়ানের দিকে আসতে ডান দিকে পাহাড়ের উপরে ডক্টর হরি সিং গৌড় ইউনিভার্সিটি যা সাগর ইউনিভার্সিটি নামে খ্যাত। এটি একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

হেডকোয়ার্টার কোম্পানিতে এডম প্লাটুনে আমি শামিল হলাম। আমাদের টেকনিক্যাল সেলে যারা আছে, প্রথমে ভেবেছিলাম যে তাদের সাথে আমার থাকার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু দেখলাম এরকম কিছু না। এডম প্লাটুনে যারা যারা আছে সবার জন্য একটা ব্যারাকের অর্ধাংশ এলট করা আছে। সেখানে যার যেখানে খুশি থাকতে পারে। দরজার পাশে একটাই মাত্র খাট খালি ছিল, সেখানে আমার বাক্স এবং বেডিং রাখলাম। এখন সন্ধ্যাবেলা, সবাই যে যার কাছ থেকে ফিরে এসে কেউ কথা বলছে, কেউ গল্প করছে,কেউ বিশ্রাম করছে। আমাকে দেখে সবাই স্বাগত জানালো। আমি প্রায় সবার সাথে হাত মিলিয়ে এসে আমার বেডিং খুলে বিছানাটা সাজাতে শুরু করলাম। দুজন এসে আমাকে বিছানা গোছাতে সাহায্য করলো। শুরু হলো এডম প্লাটুনে আমার নতুন জীবন।

ধীরে ধীরে সবার সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বিশেষ করে দরজার পাশে আমার খাটের ডান দিকের জন এবং আমাদের দুজনের খাটের সামনের দুজন – এই চারজনের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। সবাই আমাদের এই চারজনকে বলতো স্কোয়ার বা চতুর্ভুজ। আমি দেবনাথ, আমার ডান দিকে প্রকাশ কুমার কুন্ডু, তার সামনে হরিশ চন্দ্র সিং এবং তার ডান দিকে অর্থাৎ আমার সামনে রামধারী সিং লোহান।

আমাদের এই চতুর্ভুজের বন্ধুত্ব বেশ মজাদার। আমি দেবনাথ। নিঃস্ব পরিবারের বড় ছেলে। যে কোন একটা চাকরী দরকার ছিল। সেই চাকরি মিলিটারীর হোক আর যাই হোক। তো মিলিটারীতে পেয়ে গেছি, চলে এসেছি। আমার ডান দিকে কুণ্ড – নর্থ বেঙ্গলের শিলিগুড়ির স্কুল টিচারের বড় ছেলে। আদরের দুলাল। অনেক দুঃখ পেয়ে, অনেক দাগা পেয়ে মিলিটারীতে এসে জয়েন করেছে।

এখন ড্রাফটসম্যান হিসেবে কাজ করছে। তার সামনে হরিশ চন্দ্র সিং – বেনারসের ছোটখাটো জমিদার টাইপের পরিবারের বড় ছেলে। প্রচুর সম্পত্তি। বেনারসি সিল্ক শাড়ি তৈরির তাঁতের কারখানা আছে। কী দুঃখে মিলিটারিতে এসে জয়েন করেছে, প্রায় দেড় বছরের বেশি একসাথে থেকেও তার কথা জানতে পারলাম না। তার ডান দিকে অর্থাৎ আমার সামনে লোহান – বিশাল ধনী কিষান পরিবারের বড় ছেলে। পরিবারের সম্মান রক্ষা করার জন্য মিলিটারিতে জয়েন করেছে। এখন স্টোর কিপার হিসেবে কাজ করছে। আমাদের এই চারজনের মধ্যে একটা বিশেষ মিল আছে, চারজনই পরিবারের বড় ছেলে।

ছোটবেলা থেকেই আমি শারীরিকভাবে দুর্বল, অথচ কেমন করে আমাকে পছন্দ করে মিলিটারিতে জয়েন করার সুযোগ করে দিল আমি তা জানি না। কিন্তু আমি দেখেছি, এই দুর্বলতর মানুষকে সব সময়, সব ক্ষেত্রেই কেউ না কেউ বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। আমাদের চতুর্ভুজের এই হরিশচন্দ্র সিং যতদিন আমি এই হেডকোয়ার্টার কোম্পানিতে ছিলাম, আমাকে বিভিন্ন ভাবে প্রটেকশন দিয়ে গেছে। যেমন একবার কারগিলে ভলেন্টিয়ার পোস্টিং যাওয়ার জন্য একটা অপশন চেয়েছিল। আমি আনন্দের সঙ্গে কারগিলে পোস্টিং যাওয়ার জন্য অপশন ফিলাপ করে দিলাম।

হরিশচন্দ্র সিং হেডকোয়ার্টার কোম্পানীর চ্যাম্পিয়ন ছিল। যে কোন দরখাস্ত তার হাত দিয়েই আগে ফরওয়ার্ড হত। সে আমার অ্যাপ্লিকেশন দেখে সেটা নিয়ে আসে এবং এসে আমাকে দু চার ধমক দিয়ে বলল, দেবনাথ, তুমি জানো এই কারগিল জিনিসটা কি? কারগিল কোথায়? ওখানে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি টেম্পারেচার। তুমি সেখানে গিয়ে বাঁচবে? বলে আমার চোখের সামনে আমার দরখাস্ত টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে হওয়ায় ভাসিয়ে দিল।

রচনাকাল –
১১ জুলাই, ২০২২
পুনে, মহারাষ্ট্র।
————+———++++—–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *