Spread the love

ইউক্রেন যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি

 বরুণ দাশ

 ইউক্রেনে বিধ্বংসী যুদ্ধ ইতিমধ্যে ইমাসাধিক কাল অতিক্রান্ত ওখানকার সাধারন মানুষ অধিকাংশই শরণার্থী হয়ে রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ইত্যাদি দেশে আশ্রয় নিয়ে দুঃসহ জীবন-যাপন করছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে এখন যারা ইউক্রেনে অবস্থান করছেন তারা হলেন ইউক্রেনীয় সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মীবৃন্দ ও তাদের পরিবার তৎসহ নিরুপায় ও নিরাশ্রয় কিছু মানুষ। জাতিপুঞ্জের তথ্য হলো, গত 10ই মার্চ পর্যন্ত প্রায় 10 হাজার মানুষ নিহত ও 24 হাজার মানুষ আহত হয়েছেন ইউক্রেনে। বেসরকারি মতে গত 10ই মার্চ পর্যন্ত ইউক্রেনে আহত ও নিহত কয়েক লক্ষ। এছাড়া, রাশিয়ার সৈন্যদের বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর তছনছ। একটি থিয়েটার হলকে নিরাপদ ভেবে হাজারখানেক মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু গোলা ও বোমাবর্ষণে সেই থিয়েটার হল বিধ্বস্ত এবং আশ্রয়গ্রহণকারী অধিকাংশই আহত-নিহত।

          ইউক্রেনের এক মেয়রকে রাশিয়ার সৈন্যরা তুলে নিয়ে গেলে সেখানকার স্থানীয় মানুষজন নয় জন রাশিয়ান সৈন্যকে আটক করে সেই মেয়রর এর মুক্তির দাবিতে। শেষে মেয়রর এর মুক্তির বিনিময়ে নয় জন রাশিয়ার প্রাণ বাঁচে। 

       ক্রিমিয়া দখলের মতো ইউক্রেন দখলের জন্য রাশিয়া এক লক্ষ সৈন্য সমাবেশ করেছিল এবং বৃষ্টির মতো বোমা ও গোলাবর্ষণে ইউক্রেন বিদ্ধস্ত হয় এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে ইউক্রেনীয় সাধারণ মানুষ আহত হয়ে শয্যাশায়ী। ইতিমধ্যে রাশিয়া, ইউক্রেনে নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করেছে এবং করছে বলে অভিযোগ। ইউক্রেনের বিভিন্ন হাইরাইজ ও  আবাসন রাশিয়ার বোমা ও গোলার আঘাতে ধূলিস্যাত। রাশিয়া এভাবে ক্রমাগত ইউক্রেনের উপর বিমান ও ট্যাঁক বাহিত বোমা গোলা এবং মিসাইল বর্ষন চালু রাখলে রাশিয়ান বারুদ ভান্ডারে টান পড়বে নিশ্চিত।  ইউক্রেন হয়তো সেই প্রত্যাশায় রাশিয়ার হামলা সয্য করছে। তবে ওখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্রমশ: প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হচ্ছে।          একথা ঠিকই, রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেন একটি চত দেশ জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ কোটি। ভৌগোলিক আয়তন বেশি হলেও আবহাওয়ার কারণে ওখানকার জনসংখ্যা সীমিত। 

       গত  14ই মার্চ ইউক্রেনের সমর্থনে আমেরিকা দু-হাজার সৈন্য সমাবেশ করেছে রাশিয়া সীমান্তে। আগামী দিনে ঐ সৈন্য সংখ্যা ও যুদ্ধ সামগ্রী  বাড়বে অবশ্যই। মার্কিন সৈন্য ইউক্রেনের সমর্থনে বিপজ্জনকভাবে আক্রমনাত্মক হলে এবং ইউক্রেনের সমর্থনে ন্যাটো যুদ্ধে নামলে যুদ্ধের চেহারাই পাল্টে যাবে বলে মনে হয়।  প্রায় মাসাধিক কাল ধরে চলা যুদ্ধে যখন যুদ্ধ সামগ্রীতে টান পড়ছে রাশিয়া তখন দারস্থ হচ্ছে চীনের কাছে। এভাবে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে জোট বাধলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক ভারসাম্য বিপদজনক হয়ে উঠবে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

         এমনিতে অতিমারির প্রকোপে বিভিন্ন দেশ রীতিমত সংকটে।  তারমধ্যে ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়ছে। ফলে বিশ্বের সাধারণ মানুষ সংকটের সম্মুখীন এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া এবং চীনের ব্যবসা ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক হয়তো ভালো হবে। কিন্তু ইউক্রেন ও ন্যাটোভূক্ত দেশগুলির অবস্থা বিপদজনক হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা।

 1919 সালে বলশেভিকরা ইউক্রেনের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। 1922 সালে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে গণ্য হয়। 1930-32  সালে ইউক্রেনকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সামলাতে হয়েছিল। ওই দুর্ভিক্ষে 40 থেকে 50 লক্ষ ইউক্রেনীয় মারা গিয়ে ছিলো। 1954 তে ক্রিমিয়া ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং 1991 সালে সোভিয়েত এর পতনের পর ইউক্রেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার পরেই যুদ্ধ, যে যুদ্ধে রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান পুতিনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করেছে।

       ইউক্রেনের বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি রাশিয়া ও চীনের জোটকে পোক্ত করবে বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের বৈদেশিক নীতি অনুসারে রাশিয়া ভারতের বন্ধুদের, সে কারণে ভারত যদি ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া কে সমর্থন করে এবং রাশিয়ার মতোই ভারত যদি তার পুরনো ভৌগোলিক সীমানা পুনরুদ্ধারে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ অধিকারে মন দেয় তাহলে ইউক্রেনের যুদ্ধ ক্রমশ বিশ্বযুদ্ধের চেহারা নেবে একথা বলাই বাহুল্য।

     অবশ্য লকডাউন এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভারত ভ্রমণ এবং গুজরাটে তাকে বিরল রাজকীয় আয়োজন, ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে নতুন চেহারায় আবর্তিত করেছিল। 

    কোভিদ যুদ্ধের সময় ভারত আমেরিকাকে প্যারাসিটামল ও অন্যান্য ওষুধ সামগ্রী সরবরাহ করায় ভারত-মার্কিন সম্পর্কের চেহারা নতুন দীপ্তি পাচ্ছিলো। ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত এখনও নিরপেক্ষ দেশ, তবে দ্রুতই ভারতকে পক্ষ অবলম্বন করতে হবে। ভারতের পক্ষে একইসঙ্গে রাশিয়া ও আমেরিকার পক্ষ অবলম্বন করা সম্ভব নয়।

       গত 24 ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন আশ্রিত ক্রিমিয়ার কার্তিত্ব ও দখলদারি নিয়ে শুরু হয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়ার কাছে এখন এই যুদ্ধ মর্যাদা রক্ষার যুদ্ধ। রাশিয়া ইউক্রেন দখল করতে না পারলে, রাশিয়া আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সে কারণে সৈন্য ও তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ইউক্রেন দখলের জন্য পুতিন এখন মরিয়া এবং সে কারণে পুতিন আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাচ্ছে। ইউক্রেনের বিভিন্ন অংশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে রাশিয়া। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আনবিক যুদ্ধও শুরু হতে পারে, কারণ রাশিয়ার কাছেই এখন 1500 আণবিক বোমা রয়েছে, ফ্রান্সের কাছে ওই বোমা আছে 300,  ভারত, চীন, পাকিস্তান এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া ও ন্যাটোর কাছেও রয়েছে অসংখ্য আণবিক বোমা। এরকম পরিস্থিতিতে একটি দেশ আণবিক বোমা বিস্ফোরণ শুরু করলে অন্যান্য দেশেও তা বিস্ফোরিত হতে শুরু করবে এবং মানব জাতি বিলুপ্ত করার পথ প্রশস্ত হবে।

   চারবার বৈঠক করেও ইউক্রেনে শান্তি আনা যায়নি। মাঝখানে ভারতীয় ছাত্রদের ফিরিয়ে আনার জন্য যুদ্ধবিরতি হয়েছে কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি এবং যুদ্ধবিমান দ্বারা প্রতিদিন বিপুল ধ্বংস সাধিত হচ্ছে, ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল-কারখানা। এছাড়া খাদ্য ও পানীয় এবং ওষুধ ও জ্বালানি সংকট দিনদিন বাড়ছে। 700 ডাক্তারি ছাত্রক-ছাত্রীদের ভারতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও বহু ভারতীয় এখানও ইউক্রেনে রয়ে গিয়েছেন। 

   ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বে যেভাবে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হচ্ছে, রাষ্ট্রপ্রধানদের ইগোর লড়াই যেভাবে বাড়ছে, তাতে বর্তমান বিশ্বে মানুষের ন্যায়, নীতি, সততা  ও মানবিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনবার প্রয়োজনীয়তা প্রধানভাবে এবং গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। বিশ্বজনমত রাশিয়ার পক্ষে নেই, তবুও দম্ভ ও শক্তির আস্ফালন দেখাতে রাশিয়া এত দীর্ঘ যুদ্ধ চালনা করছে।

   ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায়. বিশ্বের চারটি যুগ- সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগের কথা বলা হয়েছে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরের অবস্থিতি ও ধংস স্বীকৃত। এখন চলছে কলিযুগ। বিশ্বযুদ্ধ এবং আনবিক অস্ত্রের প্রয়োগে যদি এই কলিযুগের অবসান হয় তখন খুবই নগণ্য মাত্র জনসংখ্যা নিয়ে হয়তো আবার শুরু হবে সত্য যুগ। তবে ওই যুগ যে রচিত হবেই, তার কোনো মানে নেই। যেমন অন্য গ্রহকে মানুষের বাসযোগ্য করা যাবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। তেমনি সত্য যুগ যে আসবেই তার নিশ্চয়তা নেই। তবে এখন মানবতাবাদ এবং মূল্যবোধের জীবন রচনা করার যে সময় হয়েছে  এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

……………………..

লেখক সাংবাদিক ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট ফ্যকাল্টি 

 বরুন দাশ, 

বসিরহাট 24 পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *