দীপ
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
প্রবুদ্ধ উইপ্রোতে চাকরি করে। বাঙ্গালোরে পোষ্টিং। ওর ছোট পিসিমা, অবসরপ্রাপ্তা সংগীতের অধ্যাপিকা রীণা সেনগুপ্তা ওখানে ছোট মেয়ের কাছে এখন থাকেন। সেখানেই থাকে ও। প্রবল বর্ষায় কেরালায় বহু মানুষ বিপন্ন। সারা দেশজুড়ে মানুষ ত্রাণ তুলছে। পিসি-ভাইপো ঠিক কোরলো যে আরাও রিলিফ তুলবে। প্রবুদ্ধ বলল–পিসি, একনামী কলেজ মহারাজা বীরবিক্রম একাডেমিতে তুমি তো Music-এর Profesor ছিলে। গানের জগতের লোকদের তোমার জানাশোনা তুমি উদ্যোগ নাও না একটা গানের অনুষ্ঠান করে টাকা তোলা যায় কিনা। সেবার আমাদের দক্ষিণ ২৪ পরগণায় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ তুলতে তোমার দুই ছোটভাই অম্লান ও নীলয়, মানে বাবা ও কাকা এই পথ নিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা তুলেছিল। আমাদের পরিবারের সমাজ সেবার এই ঐতিহ্য তো বরাবর আছে।
ভাইপোর কথায় ছোট পিসি রাজী হয়ে গেলেন। হায়দার আলি অডিটোরিয়ামে যথারীতি বহু শিল্পীর সমাবেশে কার্ড ছাপিয়ে অনুষ্ঠান হোল। কার্ডে আহ্বাহিকা হিসাবে নাম রইলো ছোটপিসির। প্যাক্ট আপ Hall। এ্যাংকারিং করলেন অধ্যাপিকা সেনগুপ্তা নিজে। নিজে দুটো গানও গাইলেন। অনুষ্ঠান শেষ। মঞ্চ প্রায় ফাঁকা। এমন সময় তাঁরই মতো ষাটোর্দ্ধো এক মহিলা এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করে বললেন, তোকে তো আমার নাতির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এই বুড়িটাকে তুই চিনতে পেরেছিল?
একটু ভ্যাবাচাকা মেরে অধ্যাপিকা সেনগুপ্তা বললেন, আমি ঠিক চিনতে পারছি না। kindly একটু পরিচয় দিন।
–আমি রবীন্দ্রভারতীতে তোর সহপাঠিনী, শবনম, শবনম পারভিন।
–শবনম! বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রীণা ম্যাম বললেন– পোড়ারমুখী, তুই বয়সের তুলনায় বড্ড বেশি বুড়ী হয়ে গেছিস। চিনবো কি করে তোকে? জানিস আমার যমজ নাতি নাতনি আছে এখানে আমার মেয়ের ঘরে। কে বলবে আমি দিদা?
–ঠিকই রীনি, বয়সের তুলনায় তুই অনেক কচি আছিস। তাই তো বললাম, আমার নাতির সঙ্গে তোর বিয়ে দেওয়া যাবে।
একটু থেমে শবনম বললেন–তুই ঠিক আগের মতোই আছিস। কত বড়লোকের মেয়ে তুই। ইউনিভার্সিটিতে আসতিস সাধারণ তাঁতের শাড়ী আর দু’হাতে দুটো সরু সোনার চুড়ি পরে। দুঃস্থ কেউ এলে আগবাড়িয়ে তুই উদ্যোগ নিতিস চাঁদা তুলে তাকে সাহায্য দিতে। চল্লিশ বছর বাদে তোর সাথে দেখা। Retired Music Professor তুই। স্বামী অর্থোপেডিক্স-এর Retired ডাক্তার। তোর পয়সা খায় কে? কৃপণও ছিলি না কোনোদিন। আজও নস নিশ্চয়ই। অথচ, কি সাদামাটা বেশভূষা আজও। আজও একটা সাধারণ তাঁতের শাড়ী, হাতে শাঁখা পলা, গলায় একটা সরু হার, কপালে সিঁদূরের টিপ। একজন মাসীমা তোর নাম দিয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী। সত্যিই, আজও এই ৬৩/৬৪ বছর বয়সে তুই প্রিয়দর্শিনীই আছিস।
কথাটা শুনেই অধ্যাপিকা সেনগুপ্তার মুখটা ম্লান হয়ে গেল।
–কি রে, কি হোল তোর রীনি? না, না কিছু না। জানিস বিয়ের পর সেই যে চলে এলাম বিলোনিয়া, তারপর আর সেভাবে বাপের বাড়ী গিয়ে থাকা হয়নি, অন্যদের খোঁজ খবরও নেওয়া হয়নি। তুই তো জানিস, এই সুন্দর নামটি আমায় কে দিয়েছিলেন: মাসীমা, মানে আমার গানের স্যার দীপেনদা, দীপেন বাবুর মা। সেই ১৯৭৭ সালের কথা। অধ্যাপকদের মাহিনা ছিল খুব কম। উনি খুব কৃতী ছাত্র ছিলেন তবে অসচ্ছ্বল। উনি আমায় ওনার কলেজের অফডেতে গান শেখাতে আসতেন আমাদের বাড়ীতে। ওনার রুচিসম্মত ব্যবহার, গানের গলা ও দরদ দিয়ে আমায় শেখানোর জন্য আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম ওঁকে। উনিও ভীষণ স্নেহ করতেন আমায়। দু’জনের সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। আমি সবে অষ্টাদশী। দীপুদার থেকে তিন সাড়ে তিন বছরের ছোট। প্রেম করিনি। কিন্তু আমার বাড়ীর সবাই আমাদের বাড়ীর সর্বময় কর্তা বাবার অকাল মৃত্যুতে আমার সহজ সরল দাদার অভিভাবক, বিমলদার মারফৎ ওঁর সাথে আমার বিয়ে পাকা কোরলেন। আমি ওঁর বাকদত্তা হয়ে গেলাম। আমার ফটো দেখে মাসীমাই আমার নাম দিয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী। ঠিক হয়েছিল আমার এম. এ পড়া শেষ হলে আমাদের বিয়ে হবে।
একটু থেমে আরও বিষণ্ণ মুখে অধ্যাপিকা সেনগুপ্তা বললেন, সকল সত্তা দিয়ে উনি আমায় গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। আমার কেরিয়ারের জন্য উনি বিদেশে গানের উপর গবেষণার সুযোগ পেয়েও যাননি। কিন্তু, আমি এম. এ পাশের সঙ্গে সঙ্গে আমার বাড়ীর লোকদের মত ঘুরে গেল। আমরা বৈদ্য, ওঁরা কায়স্থ, আমরা ওদেশীয় ওঁরা এদেশীয় আমরা ধনী ব্যবসায়ী পরিবার, ওঁরা অসচ্ছ্বল ঘর, বড় সংসার, ওঁনার মাহিনাও কম, আমরা শহরের মানুষ, ওনাদের বাড়ী কাকদ্বীপের অজ পাড়াগাঁয়ে, এই সব ধো তুলে আগরতলা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার সুভাষ দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার বিয়ে হোল। আমার অনুরোধে বিমলদা বিয়ের নেমতন্নের একটা কার্ড ওকে ওঁর বাড়ীর ঠিকানায় পাঠিয়েছিলেন ডাকে। উনি বা ওঁর বাড়ীর কেউ আসেননি। আসবেন না আমিও জানতাম। তবুও ভেবেছিলাম, একবার দেখা হবে, বধূবেশে ওঁকে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে নেবো। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি।
একটু থেমে উনি সতীর্থাকে জিজ্ঞেস করেন–“শবনম, দীপুদা এখন কেমন আছেন, কোথায় আছেন, জানিস কিছু তুই?
–সব জানি। কিন্তু শুনলে তোর কষ্ট হবে; বোলবো না।
— না না তুই বল। আমি জানতে চাই এই পৌনে অর্ধশতাব্দী পরে মানুষটি কেমন আছেন? তিনিই তো আমায় তিলে তিলে এই সম্মানের পেশায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, নইলে হয়তো কোন ব্যবসাদারের বৌ হয়ে জীবন কাটাতাম, হোটেল-বার-নাইট ক্লাব করে বেড়াতাম। আজ যে সংস্কৃতি জগতের মানুষজনকে নিয়ে বিপন্ন মানুষদের জন্য Relief fund collect করছি, সেটাও তো তাঁরই শিক্ষা।
–তার মানে, তুই এখনো দীপু স্যারকে ভুলিসনি?
–ভুললে যে পাপ হবে।
— কিন্তু, তোর অজান্তে যে তুই একটা বড় পাপ করে ফেলেছিস বোন।
–জানি, বাকদত্তা হয়েও আমি আমার বাড়ীর নির্দেশে সেখান থেকে সরে এসেছি।
হ্যাঁ সেটা তো পাপ বটেই। কিন্তু তার চেয়েও একটা বড়ো পাপ তোর একটা হয়ে গেছে।
–কি সেটা শবনম?
–ডাক্তার বাবুর সঙ্গে তোর বিয়ের কদিন বাদেই নিদারুণ মনোভঙ্গে মেশোমশাই অর্থাৎ দীপুদার বাবা স্ট্রোকে মারা যান। তোর সিঁথিটা যখন সিঁদূরে ডগডগে হচ্ছে, তখন অকালে মাসীমার সিঁথিটা হয়ে যায় ফ্যকাসে।
–কি বলছিস তুই? আমি এর কিছুই জানি না। হে ঈশ্বর, আমি এ কি করেছি? ধিক ধিক, শত ধিক আমার শিক্ষা দীক্ষাকে।
শবনমকে জড়িয়ে ধরে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে থাকেন Prof. Sengupta. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বৃদ্ধা বান্ধবী বলেন, সত্যি বলতে কি এতদিন মনে মনে ভাবতাম যে পয়সাওয়ালা বর পেয়ে তুই দীপুদার মতো এমন একজন সরল আদর্শবান মানুষকে betray করেছিস। কিন্তু আজ আমার চোখ খুলে গেল। এই বিংশ-একবিংশ শতাব্দীতেও উচ্চ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালী পরিবারের লেখাপড়া জানা মেয়েরাও যে কতো অসহায় এবং অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত নির্ভর তুই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
–ঠিক তাই রে। বাড়ীর অভিভাবকদের সিদ্ধান্তের মুখে আমার কিছুই করার ছিল না। ফুটবলের মতো একবার এদিক, আর একবার ওদিক শুধু গড়াগড়ি খেলাম।
একটু থেমে উনি জিজ্ঞেস করলেন–হারে শবু! তা দীপুদা কেমন আছেন?
–সেটা বলতে পারিস ছেলে মেয়ে বৌমা নিয়ে ওঁর ভরা সংসার। ওনার স্ত্রী মানসীদি খুবই রূপবতী ও গুণবতী। মাসীমা নিজে দেখে বিয়েতে অনিচ্ছুক দীপুদাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ওঁর সাথে। এখন খুবই সুখী দম্পতি। দু’জনেই এখন Retierd Profesor; দু’জনেই খুব সহজ সরল জীবনযাপন করেন ও প্রচুর Social work করেন।
–যাক, খুব ভালো লাগলো শুনে। আমার অনিচ্ছাকৃত দেওয়া ক্ষতটাকে যে মাসনীদি প্রলেপ দিতে পেরেছেন, অদেখা, অচেনা, সেই সহোদরাটিকে আমার শ্রদ্ধা, আমার শত কোটি নমস্কার।
–এতদিন তোকে মনে মনে ভাবতাম যে তুই মাইকেলের রেবেকা, তুই বিশ্বাস ঘাতিকা। কিন্তু, আজ বুঝলাম তুই উচ্চ শিক্ষিতা, উত্তবিত্ত ঘরের এক অসহায় নারী। এও বুঝলাম, স্বামী, মেয়ে জামাই, নাতি নাতনি নিয়ে তোর ভরাট একটা বিশাল আকাশ থাকলেও, সেই আকাশে এককোণে আজও কিন্তু দীপুদার দীপ-এর রশ্মি অম্লান।
প্রফেসর সেনগুপ্তা থাকেন নিরুত্তর।
আস্তে আস্তে গোটা অডিটোরিয়াম প্রায় খালি হয়ে গেল। লাইটম্যান একে একে আলোগুলোও নিভিয়ে দিচ্ছে।
–শবু চল যাওয়া যাক। তুই কোথায় যাবি? আমি নামিয়ে দিয়ে যাবো।
–এই তো কাছেই, শিবাজী পার্কে। দু’জনে পাশাপাশি বসলেন। প্রবুদ্ধ বোসলো সামনে। বাঙালী ড্রাইভার গাড়ী স্টার্ট দিয়েই রবীন্দ্রসংগীত ছাড়লো চিন্ময় চ্যাটার্জীর কণ্ঠে–
ভালোবেসে সখী,
নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।
আমারও পরাণে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণ মন্দিরে।
প্রফেসর সেনগুপ্তার শিল্পী মন দুমড়ে মুচড়ে যায় আজ এই গানে। গত পঞ্চাশ বছরে কোনদিনও তার এমন মনে হয়েছে স্মরণে আসেনা। জানলা দিয়ে বাইরে শূন্যের দিকে তাকিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে রুমালে চোখ মোছেন ধীরে।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।