মুন্নু প্রত্যেকবারের মতোই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল পার্কিং লট এর কাছে। আমি নাগপুর ফ্লাইটে যতবার আসি ওর গাড়িতেই সওয়ার হই। যেকদিন থাকি, মুন্নু ও থাকে। নাগপুর এয়ারপোর্ট এর টারম্যাক থেকে বেরিয়ে সামনেই দাঁড়ানো ছিল মুন্নর গাড়ি। একটা নতুন বোলেরো নিয়েছে দেখলাম। বোলেরো খুব শক্ত পোক্ত গাড়ি। জঙ্গল পাহাড় ঘাট রাস্তার পক্ষে একদম আদর্শ। মুন্নু জিজ্ঞেস করলো পেঞ্চ এ কোথায় উঠবো। বললাম রিসোর্ট এর নাম ও চিনতে পেরে ঘাড় নাড়ল। আমার আর মুন্নুর কথা হিন্দিতেই হয়ে থাকে কিন্তু আমার যেমন হিন্দি মুন্নুর ইংরেজির দখল সেরকমই তাই আমাদের কথোপকথন আমি বাংলাতেই রাখবার চেষ্টা করবো হিন্দি ব্যবহার যদি করি আর তার ভুল ভ্রান্তি অনুগ্রহ করে মার্জনা করবেন নচেৎ হিন্দি না শিখে জঙ্গলের গল্প আর বলাই যাবে না স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে।
আমার বুকিং ছিল পেঞ্চে। টাইগার এন্ড উডস রিসোর্ট এ মাত্র এক রাতের জন্য। পেঞ্চ আমি অনেকসময় একটা লঞ্চ প্যাড এর মত ব্যবহার করি। রাতটুকু থাকি সকাল সকাল একটা সাফারি করে, ব্রেকফাস্ট করে কানহা চলে যাই। এবারেও তাই। সারহি চলে যাওয়ার ইচ্ছে পরেরদিন। নাগপুর এয়ারপোর্ট থেকে সামান্য শহর পেরিয়ে byepass রাস্তা মাত্র সাতাত্তর কি মি দূরেই পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্ক। কালিদাস এর স্মৃতি ধন্য রামটেক কে দান পাশে রেখে আগেই কামতী ছাড়িয়ে আমাদের পথ। অনেকগুলো ফ্লাইওভার এর দৌলতে রাস্তা এখন অনেক সোজা হয়ে গেছে। হাইওয়ে থেকে বাঁ দিকে একটা টার্ন নিয়ে আমরা পেঞ্চ এর ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কটেজ রিসোর্ট এর সারি দুপাশে আলগা আলোর সহজ পথ একটু আস্তেই চালাচ্ছিল মুন্নু। অনেক সময় এই হাল্কা চলন ভালো লাগে। হোটেল রিসোর্ট গুলো প্রায় নিঃশব্দ বড়ো বড়ো শাল সেগুন দাঁড়িয়ে রয়েছে পথে। কৃষ্ণচুড়াও। একবার অন্ধকার এই পথে রাতের আকাশে আলো করে রেখেছিল পলাশ শিমুলের ফুল। ঘন অন্ধকারে রাতের আকাশে ফুল ফুটে রয়েছে থোকা থোকা। সে এক অভিজ্ঞতা।
মুন্নু খুসবুদার কালি জর্দা দিয়ে পান খেয়েছে বাতাসে তার খুশবু পাচ্ছি। আমি মিঠা পাতি চবন এলাচের পান খাই। রোজ দুটো করে। অনেকেই মানেন না যে হালকা পান শুধু মাউথ ফ্রেশনারের কাজই করেনা, দাঁতও রাখে ভালো। সেই কে যেন বলতো, শরীর কে অল্প অল্প সব কিছুই দিতে হয়। জিম করবেট যেমন কুয়ার সিং কে মৃত্যু সজ্জা থেকে তুলে এনে প্রথমেই একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, অন্ততঃ এখন তুমি মরতে যাচ্ছ না এবং সত্যি সত্যি প্রায় ঘাটের মড়া বনে যাওয়া কুয়ার সিং এর পরেও আরও অনেকদিন বেঁচে বর্তে ছিলেন এবং স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছিলেন।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই গাড়ি বড়ো গেট দিয়ে টাইগার এন্ড উডস এর হাতায় ঢুকিয়ে দিল মুন্নু। সির্ফরাজ অপেক্ষাতেই ছিল আমার সামান তুলে দিল দশ নম্বর কটেজে। সির্ফরাজ জিজ্ঞেস করলো ডিনার কখন নেবো। বললাম হাত মুখ ধুয়ে এসেই নিচ্ছি। আসলে আমাদের আসতে অনেকটাই রাত হয়েছে। ডিনারের পাট চুকে গেছে আগেই এবার বেচারারা শুতে পারলেই বাঁচে… সক্কাল সক্কাল আবার সাফারি আছে সকলকে ডেকে তোলা, চা দেওয়ার ঝামেলা থাকে।
শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। সকালেই সাড়ে চারটে নাগাদ উঠে পড়তে হবে কারণ সাফারি কল টাইম ভোর পাঁচটা। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে যেমন সময় দরকার, সময় দরকার ক্যামেরা, ফিল্ড গ্লাস গুছিয়ে নেবার। ভোরের বেলা জঙ্গলে শিশির পড়ে তাই এই মার্চ মাসেও টুপি, গরম জামাও গুছিয়ে নিতে হয়। এক কথায় অনেকই কাজ একবার ভুল লেন্স নিয়ে চলে গেছিলাম। বাঘ বাহাদুর গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আর আমি 150-600 ক্যামেরা লেন্স নিয়ে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে। এসব পার্ট of the স্পোর্ট। এখন যদিও শিকার করতে আমরা আর জঙ্গলে যাইনা কেউ, কিন্ত আয়োজন কম নয়।
সকালে তুরিয়া গেটে যখন পৌঁছলাম তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। কিন্তু সাফারি জিপের লাইন, আশপাশের দোকানের জলমলে আলো চায়ের কেটলির ধোঁয়া আর ড্রাইভার গাইডদের জটলায় জায়গাটা গমগম করছে। দোকানগুলি মূলত শুভেনির বিক্রি করে সেই সঙ্গে টুপি, টিশার্ট যাদের প্রত্যেকটির ওপর পেঞ্চ এর নাম এমব্রস করা সেই সব বিক্রি করে। কেউ হয়তো টুপি আনতে ভুলেছে এখানে দেখে শুনে কিনে নিলেই হলো। আমি একটা জ্যাকেট কিনেছিলাম একবার। ভালো।
চালক কে দেখতে পেলাম না বোধহয় পারমিট করাতে গেছে আমি জিপ থেকে নেমে চা খেতে ছলে এলাম উল্টো দিকের একটা স্টলে। আমার মতো অনেক দেশি বিদেশি আবার দেসোয়ালিরাও চা নিয়েছে তাদের কালোরব্যলোর চলছে কেউ আবার চায়ে চুমুক দেবার আগে থুথু ফেলে ঠোঁটের ফাঁকে থাকা ন্যাতানো খৈনি থেকে অব্যহতি চাইছে। একটু সরে এলাম চায়ের ভাঁড় নিয়ে। সঙ্গে থাকে ক্যামেরা সেগুলো যাতে ঠোকা না খায় সতর্ক থাকতে হয়, এসব নিয়েই আমার বেড়ানো।
সাফারি শুরু হলো। আগেও অনেক লেখায় বলেছি যে পেঞ্চে বড়ো বাঘ দেখিনি কখনো এবারও দেখতে পেলাম না। কিন্তু জঙ্গল টা দেখলাম প্রাণ ভরে। পাতা খসানোর শুরু হয়েছে জঙ্গলে তার যে কতরকম রং বলে শেষ করা যাবে না। বাঁশ গেছে ফুল এসেছে দেখলাম। বাঁশ গাছে ফুল আসা মানে সে গাছের মরণ এসেছে। মৃত্যু সমাসন্ন। এই নিয়ে বন পাহাড়ের মানুষের অনেকরকম বক্তব্য আছে কেউ কেউ একে অশুভ বলে মনে করে আবার আমার গাইড রঞ্জিত যে এখানেই জন্মেছে এখানেই বড়ো হয়ে উঠছে সেই আগ্রহ নিয়ে আমায় দেখালো দেখিয়ে সব ব্যাম্বু ট্রি কা ফুল। আমি বললাম এরপর তো এই গাছ মরে যাবে। তাইনা? সে কিন্ত একমত হলোনা। কিঁউ, এইসা কুছ হ্যায় ক্যা? ঠিক বলতে পারলাম না, শুধু বললাম শুনা হ্যায়।
এই অংশে অনেকগুলো ঘোস্ট ট্রি দেখলাম। ছাল ওঠা, রুপোলি শরীরে নগ্নিকার লাস্য। পাতাগুলো নড়ছে। নগ্নিকার রহস্য শুধু শরীরেই নয় তার চাহনি আমন্ত্রণ সকলি বড়ো আকর্ষণীয় বড়ো উত্তেজক।
একদল জংলী কুকুর দেখলাম। খুবই কম দেখা যায় এদের। মধ্যপ্রদেশে এদের বলে মুন্নিকোয়া। কুই কুই করে ডাক পারতে পারতে মাটি শুকতে শুকতে অস্থির তারা। ভয়ঙ্কর প্রাণী এরা। বাঘকেও রেয়াত করে না। দলবদ্ধ ভাবে শিকার করে এরা। খুবলে নেয় শরীরের মাংস শরীরের এখান ওখান থেকে ক্রমে প্রাণীটি রক্তক্ষরণ হতে হতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা শিকারের ওপর। আমাদের কোলকাতার মুন্নিকয়াদের কথা মনে পড়ে। সংসারে কাজের জায়গায় সর্বত্র।
এমন না হলেই ভালো ছিল, কিন্ত বাস্তবে এরাই এখন দলে ভারী। শিকারেও পটু।
ঘড়ি দেখলাম ফেরার সময় হয়ে এসেছে। গরমের দিন সমাসন্ন। পেঞ্চে কৃত্রিম ভাবে জল সরবরাহ করা হয় পশু পাখিদের। সিমেন্টের ছোট ছোট চৌবাচ্চা দেখা যায় জঙ্গলের মধ্যে। এখানেই জলের গাড়ি আসে সকালে বিকালে জল ভরে দিয়ে যেতে। এমন এক তালাওএর কিনারে বসে একটা white brested kingfisher – মাছরাঙা পাখি। বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম একসময় উড়ে গেল পাখিটা দু একটা ঘাসফুলে কেমন দোলা দিয়ে, নিজেরই খেয়ালে।
সব ভালোর শেষ আছে এবারে পেঞ্চ থেকে বিদায়ের ক্ষণ। আবার আসবো, হয়তো এভাবেই। সময় কম উড়ানে উড়ানে কি জঙ্গল দেখা হয়? এ যেন সেই কাপল দের মতো যাদের সংসার করা হয় না, সহবাসও নয় কেবল এক শহর থেকে অন্য শহরে উড়ে যাওয়ার সময় দেখা হয় বিমান আড্ডায়। এককাপ কফি একটু হাসি তারপর আবার ফিরে যাওয়া।
আমার জঙ্গলে আসাও এরকমই। সহবাস হয়না কখনো দেখা হয় মাত্র।
মুন্নু জিজ্ঞেস করল সাইটিং হুয়া স্যার? বললাম হ্যাঁ দেখলাম। ওয়াইল্ড ডগস ঝুন্ড। বাহ স্যার বাড়িয়া লাকি রহে ঈশিবার। বহত rare সাইটিং হোতি হ্যায় মুন্নিকোয়াকি। আপনে উঃ ডকুমেন্টরি ফিলাম দেখা না স্যার? বললাম হ্যাঁ দেখেছি কাবি নীর জঙ্গলে। নাগারহলে ন্যাশনাল পার্কে। ওই ফিল্মে ওয়াইল্ড ডগ দের কঠোর সংগ্রাম যা তাদের বেঁচে থাকার জন্যেই করতে হয় সুন্দর দেখিয়েছেন পরিচালক। এরাও কিন্তু এনডেঞ্জারড।
পাখির তখন অনেকটা পথ জলছবিতে আঁকা
নদীর ভিতর কান্না কোথায় ভীষণ আঁকা বাঁকা।
পাখি উড়ছে নামছে পাখি, নদীর কত ঢেউ
নদী ভাবছে, ভাবছে নদী পাখির ছিল কেউ।
বন্ধু সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এর কবিতার পঙতি গুলো মনে পড়ছে কারণ কানহায় যাচ্ছি যে
আর কানহা মানে বানজার নদী
কানহা মানে বামনি দাদার, কানহা মানে বাঘিরা লগ হাট কিন্তু এবার আমার গন্তব্য সারি–
কানহার একটি অঞ্চল। কানহায় মোট চারটে কোর এলাকা আছে – কানহা, কিসলি মুক্কি আর সারহি। কানহা ন্যাশনাল পার্কের উত্তরে সারহি। এই অংশে অত্যন্ত ঘন জঙ্গল হেতু সাইটিং এর সম্ভাবনা কম থাকে এবং একারণেই পর্যটনের অহেতুক চাপ নেই এখানে। ঘরোন্দা তে সাধারণত থাকি আমি। হোমস্টে। এক প্রাক্তন বনকর্মী যার বর্তমান মালিক। আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে কাপুর সাহেব হই হই করে ছুটে এলেন। বাতায়া নেই, বাতায়া নেহি আপনে এইটুকুই শুনতে পেলাম। বলি বাতাবো কেন? জানিতো এলেই থাকতে পাবো তা সে যতই অসুবিধে থাকুক না কেন। একগাল হেসে দুটো হাত ধরেন কাপুর, ঘরোনদার কর্নধার।
আন্দার আইয়ে সাব , তাশরিফ রাখিয়ে আমার হিন্দি খুব খারাপ বলি শুকরিয়া।
সারহি অঞ্চলে হালো নদীর দেখা মেলে। কানহার দুটি নদীর একটি এই হালো। এখানে জঙ্গল প্রকৃতি খুব সুন্দর আর নীলগাই, স্লোথ বোর, ঢোল এবং অবশ্যই চিতা বাঘের জন্য বিখ্যাত কানহার সারহি অঞ্চল। অনেকে মনে করে এখানে বাঘ নেই, কিন্তু সেটা একেবারেই ভুল। আমি নিজে একবার মোহনের খোঁজে এখানে অনেক্ষন অপেক্ষা করেছিলাম তারপর চোলে গেছিলাম বামনি দাদার। মোহনের তখন বয়েস হয়েছে। অনেক সন্তান সন্তোতির গর্বিত গার্জেন সে কিন্তু বয়েস এমন বস্তু যে না ছেড়ে মানুষকে না ছেড়ে বাঘকে। বুড়ো মোহন তখন অনেকটা সময়ই বামনি দাদার আর সারহি পথের জংশনে শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাত। সেদিন যদিও তাকে দেখিনি তবুও সারহিতে বাঘ নেই বললে আমার মোহনের কথাই মনে পড়ে।
সারহি অঞ্চলে যেমন হালো নদী এখানকার জঙ্গলের ও বৈশিষ্ট্য অনন্য। মিশ্র পর্ণমচি জঙ্গল প্রধানত দেখা যায় এখানে। এই জঙ্গল কানহার নতুন আকর্ষণ তো বটেই এখানে খাটিয়া গেট থেকে আসাই বেশি সুবিধের। মুক্কি থেকে দূরত্বের কারণে আমার তো প্রথমে মনে হয়েছিল সারহি কে আলাদা একটা পার্ক করলেও ভালো হোত। এখানকার জঙ্গল যখন মূল কানহার থেকে অনেকটাই আলাদা তখন আলাদা সংকচুয়ারি হলে মন্দ হোত না। আসলে আমাদের দেশেই নিয়মগুলোয় কোন নিষ্ঠা নেই। কোর অঞ্চলের মাত্র দশ শতাংশ এখন খুলে দেওয়া হয়েছে পর্যটনের উদ্দেশে সেই দশ শতাংশই টুরিজম আর বোনবিভাগের আকচা আঁকচি।
যে সব মানুষ জঙ্গল ভালোবাসে বা বোঝে তাদের মতামত দেওয়ার অবকাশ নেই। ভাবা যায় স্বয়ং বুদ্ধুদেব গুহ র মত মানুষই কখনো ডাক পাননি কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত জানানোর, পরিকল্পনা তো দূর অস্ত তাঁর মত মানুষও আজীবন রয়ে গেলেন ব্রাত্য। তা সে সাহিত্য কিংবা বন যাই হোক না কেন।
সাত পাঁচ ভাবছিলাম কাপুর সাহেব চা খেতে ডাকলেন। চা আর পকোড়া। ভেজ। এখানে পেঁয়াজ পকোড়া চলে আর একটা এসোর্টেড পকোড়াও পাওয়া যায়। বেশ ভালো লাগে আমার। সন্ধ্যার পরে বাইরে বসেই গল্প করি আমরা। ঘরোন্দার বারান্দায় বসেও গল্প জমে। সেখানেও বেতের সোফা, গ্লাস টপ টেবিল রয়েছে। এখানে ঘরগুলিতে জনজাতিদের হাতের পরশ মেলে। প্রত্যেকটি ঘরের মেঝে মাটি দিয়ে নিকোন, আল্পনা দেওয়া এবং jonjatider সংহত চিত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পিছনের দিকে আদিগন্ত সর্ষে ক্ষেত মুগ্ধ করে বারবার তাই ঘরোন্দায় আমি সাচ্ছন্দ বোধ করি বরাবর।
শীত কালে বহুবার উঠোনে আগুনের পাশে রাম নিয়ে বসেছি চিকেনের নলা পোড়া এসেছে কাপুরের নির্দেশে কাপুর গল্পে সঙ্গদান করলেও মদ্যপান থেকে বিরত থাকতেই দেখেছি বরাবর।
আজ আর রাতের সাফারি নিলাম না। অনেকটা পথ এসেছি তাছাড়া আগেও নাইট সাফারি করেছি অনেকবার তাই ভাবলাম পরেরদিনটাই ভালো হবে। নাইট সাফারির মজাই আলাদা যেই না গাড়ির হেডলাইট পথের ওপরে থমকে পড়ে বা ঝলসে ওঠে ওমনি নাইট জারগুলো জটপট করে উড়তে শুরু করে একদম চাকার সামনে থেকে। বার্কিং ডিয়ার এর চোখ ঝলসে ওঠে হিরের দ্যুতিতে আর কি হয়? মেঠো খরগোশ পালিয়ে বাঁচে। পিছনের পায়ে ভর রেখে সামনের পা দুটি তুলে লাফ দিয়ে হারিয়ে যায় একে একে। দূরগুম দূরগুম করে ডেকে ওঠে পেঁচা। ডানা ঝাপটায়। আলোর ঝলকের মধ্যে একচিলতে বিদ্যুৎ সংযোজিত হয় নতুন করে। কোটরা ডাকে বাক বাক। জিপের পিছনে বসলে ভয় জাঁকিয়ে বসে খস খস শব্দ হলো মনে হয় স্বাপদের ভয়, ড্রাইভার চলিয়ে আগে বাড়িয়ে বলে ভীত কম্পিত স্বর। জঙ্গল বিলাস কিন্ত বিলাসিতা নয়, কোনোদিন ছিলও না এটা মনে রাখা ভালো।
সাফারি যাইনি, অগত্যা আড্ডাতেই বসলাম হালকা একটা শল জড়িয়ে। কাপুর ও এসে বসলেন বাঁধাকপি পকোড়া আর চা। একথা সেকথার পর কাপুর বলল জানেন বামনি দাদারে এখন আর যাওয়া যাচ্ছে না, সাফারি বন্ধ হয়েছে ওদিকে।
মোহন ওখানে ঘুরত।বুড়ো মোহন খাবারের সন্ধানে পরের দিকে সদরেও চলে আসতো।
আর মোহন দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাপুর। কেন, মোহন তো মারা যায়নি। খবর পেতাম সেরম কিছু হলে। মারা গেলে ভালো ছিল সাহেব, তার থেকেও খারাপ হলো তার। এটা সে কি ডিজার্ভ করতো? বড়ো বাঘের এই কি পরিণতি
সে কী, কি হয়েছিল তার বলতে গিয়ে কথা আটকে যায় তবু ঘরঘর করে বলি
শুনবেন সাহেব আপনি সহ্য করতে পারবেন তো?
কি হয়েছিল? ধমকের মত শোনালো আমার গলা।
কাপুর উঠে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো অস্থির ভাব
তারপর কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে বলল, ওই যে বললেন না মোহন গ্রামের লোকালয়ে চলে আসতো সেটাই ওর কাল হলো।বইহার গ্রামের ঘটনা। মোহন প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে ওই গ্রাম অভিমুখে যেত, গৃহস্ত বাড়ি থেকে মুরগি ছাগল এটা সেটা তুলতে শুরু করলো সে। এতটাই সাহসী হয়ে উঠেছিল যে সন্ধ্যার সময় অনেক সময় বাইকের চালকদের মুখোমুখিও পড়ে যেত সে কিন্তু মানুষকে কিছুই বলতো না, মাথা নিচু করে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াতো। এসময় অনেকেই তাকে দেখে থাকবে। গ্রামের মানুষ ফরেস্ট অফিসে অভিযোগ করতে লাগল ফরেষ্ট আর কি করে, কম্পেন্সেশন দিতে আরম্ভ করে তারা। মোটামুটি চলছিল এভাবেই। তাকে গভীর বনে ফেরানোর সমস্যা ছিল। কারণ বয়েসের কারণে সে শিকার করার ক্ষমতা হারিয়েছিল। হয়তো না খেতে পেয়েই মরে যেত সে তাই ফরেস্ট তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলো মাত্র।
ঘটনা অন্য দিকে গড়ালো এক যুবতীর মৃত্যু কে কেন্দ্র করে সটি ক্ষেতের মধ্যে তার দেহ বিযুক্ত মুন্ডু টা পাওয়া গেল এক কুয়াশা মাখা সকাল বেলায়। দেহ ছিন্ন ভিন্ন অত্যাচারের স্পষ্ট চিন্হবাহী।
পুলিশ এলো, গ্রামের মুখিয়া মোড়ল এলো, সবাই সব্যস্ত করলো যে মেয়েটি পাশবিক অত্যাচারের শিকার। যার ভরকেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। কিন্তু একদল রাজনীতির মানুষ ফুৎকারে উড়িয়ে দিল বৃদ্ধ মোড়লদের কথা। মোহন মেরেছে ওকে, ধর মুন্ডু আলাদা এ কাম বাঘয়া মোহন কি। একদল তরুণ তুর্কি যারা নব্য রাজনীতির নিয়ন্ত্রক তারা রটিয়ে দিল এ ঘিনোনি কাম বাঘয়া মোহনকি…
পোস্টমর্টেম হলো তাতে স্পষ্ট হলো সেকথা mauled by an animal. মানুষের দায় নয়, অপরাধী মোহন।
সাঁঝয়া গাড়ি এলো, যেখানে একটা অ্যাম্বুলেন্স এর জন্য হা পিত্যেস করা মানুষের কাছে সাধারণ ব্যাপার, তারাই দেখল যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় খাঁচা গাড়ি চলে এলো, এলো বিটাররা ধরা পড়লো মোহন। ঘুম পারানি গুলি করতে হয়নি খাঁচার ভিতর রাখা ছাগলটাই টেনে এনেছিল ক্ষুধার্ত মোহনকে স্বেচ্ছা বন্দি হতে। মোহন চলে গেল বিলাসপুরের চিড়িয়াখানায়।
শাস্তি হলো মোহনের একসময় মাথা উঁচু করে যে ঘুরে বেড়াতো বামনি দাদারে। কিছুদিনের মধ্যে সবাই ভুলে গেল তাকে এবং সেই মেয়েটিকে।
কাপুর চুপ করল। কতগুলো জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে।
সাহেব উঠুন তাহলে, সকালের সাফারি টা তো নেবেন প্রশ্ন কাপুরের।
না কাল চলে যাবো আমি
সেকি কালকেই? কলকাটা ফিরে যাবেন?
নাহ কাপুরজী যাবো বিলাসপুর।
মোহনের সঙ্গে একবার দেখা করাটা খুব জরুরী। মুন্নু, সকাল আটটায় বেরোবো তৈরী থেকো।
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো মুন্নু ড্রাইভার।