ঈদের উপহার : ছোট্ট বন্ধুদের জন্য একটি ছোট্ট গল্প
ঈদের টুপি
দিলীপকুমার মিস্ত্রী
কৃষ্ণ আর আজান দুই বন্ধু। ওদের এই বন্ধুত্ব নিয়ে আলোচনা চলছে সারা ইসকুলে। রামসাগর বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের ক্লাস সিক্সের ছাত্র ওরা। গতবছর দুজনেই পঞ্চম শ্রেণিতে যুগ্মভাবে ফার্স্ট হয়েছে। স্কুলের স্যাররা তাই ওদের খুব ভালোবাসে।
রামসাগর পাখি-বাঁধের পূব পাড়ে কৃষ্ণদের পাড়া। আর বাঁধের পশ্চিম পাড়ে আজানদের। বাঁধের লীজ-মালিক দুই পাড়ার দুই মোড়ল গোপাল ঘোষ আর নজরুল সেখ। কিন্তু বাঁধের লাভ-ক্ষতি নিয়ে তাদের মধ্যে কখনও মনোমালিন্য হয়নি। তাদের এই বাঁধের জলেই দুই পাড়ার লোকজনের স্নান, জামাকাপড়-বাসন ধোয়া;সব কিছু।
ঈদের জন্য কৃষ্ণ-আজানদের ইসকুল গতকাল ছুটি ছিল। আজ ইসকুলে দুই বন্ধুর দেখা হতেই, আজান কৃষ্ণকে একটি চকোলেট আর একটি রঙিন টুপি উপহার দিল। বলল,’বন্ধু, ঈদ উপলক্ষে,তোমার জন্য আমার এই সামান্য উপহার। এর বেশি কিছু দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের যে নেই ভাই।‘
কৃষ্ণ বন্ধুর দেয়া উপহার আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করল। তাকে বুকে জড়িয়েও ধরল। বলল,’বন্ধু, আমরাও তো তোমাদের মতো। তাছাড়া, বন্ধুর দেয়া যে কোনো উপহারই অমূল্য,তা সে যা-ই হোক। তুমিই বল, ভালোবাসার কোনো মূল্য হয়? তাকে কখনও পয়সা দিয়ে কেনা যায়?’
টিফিন বেলায়, কৃষ্ণ বন্ধুর দেয়া রঙিন টুপিটি পরে আনন্দে সারা ইসকুল নেচে বেড়ালো। আর তাই দেখে,স্কুলের সমস্ত ছাত্ররা খুব হাসিঠাট্টা করল। কেউ কেউ এমনও বলল,’দেখ দেখ কৃষ্ণ পাগলের কান্ড, মিঞার টুপি পরে কেমন দিব্যি নাচছে!‘ কিন্তু কৃষ্ণের তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে ছুটির পরেও ব্যাগ থেকে টুপিটি বের করে, মাথায় চাপিয়ে, দে- ছুট্ বাড়ির পানে।
এই সব কিছু হেডস্যারের নজরে পড়েছে। তিনি পরদিন প্রেয়ার–ক্লাসে, সকল ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,’গতকাল কৃষ্ণকে দেওয়া আজানের উপহার নিয়ে তোমাদের মধ্যে অনেক হাসিঠাট্টা হয়েছে। আমি এবিষয়ে তোমাদের দু–চারটি কথা বলতে চাই।
‘প্রথমত,বন্ধুর দেয়া উপহার সবসময়ই আকর্ষনীয়, আনন্দের এবং মূল্যবান– তা সে যাই হোক।
‘দ্বিতীয়ত, তোমরা এক মুসলিম বন্ধুর দেওয়া টুপি হিন্দু বন্ধু পরেছে বলে হাসিঠাট্টা করছ। কিন্তু এটা তোমাদের ভুল। টুপির কোনো জাত–ধর্ম হয়না। এক সময়, আমাদের দেশে সাহেবরা হ্যাট মাথায় দিয়ে এসেছিল। তারা ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তাদের হ্যাট কী আজকের দিনে তোমাদের মাথায় উঠছে না ? ক্রিকেট মাঠে তো প্রায় সকলেরই মাথায় হ্যাট দেখা যায়। শচীন সৌরভ ধনী বিরাট গাওস্কর কপিল আজাহার জাদেজা কুম্বলে পতৌদি ইমরান মিঁয়াদাদ ; কে নেই সেই দলে ? তাহলে, হ্যাট মাথায় নিয়ে এদের সকলেরই কী জাত–ধর্ম চলে গেছে ?
‘তৃতীয়ত,তোমরা স্কুলে এসেছে লেখাপড়া শিখতে, মানুষের মতো মানুষ হতে। তোমাদের জানা দরকার, আমাদের দেশেই জন্মেছেন শ্রীচৈতন্য রামকৃষ্ণ নেতাজী বিবেকানন্দের মতো মনীষীরা। যাঁরা জাত–ধর্ম নয়,শুধু মানুষকে ভালোবাসার কথাই বলে গিয়েছেন। তোমরা জেনে রাখো,আমেরিকার চিকাগো শহরে আন্তর্জাতিক ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুতেই বলেছিলেন,মাই ডিয়ার ব্রাদার্স এ্যান্ড সিস্টার্স অফ আমেরিকা। অথচ আমেরিকার সংখ্যাধিক্য নাগরিক খ্রিষ্টান এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এবং তিনি সেটা জানতেনও। তাহলে, যাঁরা হিন্দু ধর্মালম্বী নয়,তাঁদের কেন তিনি ভাই–বোন বলে সম্বোধন করেছিলেন ?
‘সবশেষে তোমাদের সবাইকে বলছি, পৃথিবীতে আগে মানুষ এসেছে, জাত–ধর্ম, পোশাক, এমনকি খাদ্যাভ্যাসও অনেক অনেক বছর পরে এসেছে। এগুলো সবই মানুষের সৃষ্টি। অর্থাৎ খাঁটি এবং সত্য একটিই– তা হল মানুষ। তোমরা আজানের দেয়া টুপি কৃষ্ণ পরেছে বলে তা দেখে হাসছ। তোমরা কি জানো,পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাঙালি পোশাক, ধুতি–পাঞ্জাবি পরা দেখে ইংরেজ সাহেবরা হাসতো ? তাহলে, বিদ্যাসাগরের পোশাক কী ঠিক ছিল না ? আমি আশা করছি, তোমরা এরপর থেকে একজন আদর্শ ছাত্র, আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরবে। কৃষ্ণ আর আজানের বন্ধুত্বকে সম্মান জানাবে। ওদের শিশু–সুলভ উচ্ছ্বাসকে আদর করবে।‘
হেডস্যারের কথা শেষ হল। প্রেয়ার–ক্লাস ভাঙল। সবাই যে–যার ক্লাসে ফিরে যাচ্ছে। হঠাৎ ক্লাস টুয়েল্ভের দুই ছাত্র ঋষভ ও স্মিথ দৌড়ে এসে কৃষ্ণ আর আজানকে কাঁধে তুলে নিয়ে, নাচতে নাচতে ওদের ক্লাসের দিকে এগিয়ে চলল। আর তাই দেখে, হেডস্যার এবং অন্য সব স্যারেদের মুখে হাসির ফোয়ারা যেন আছড়ে পড়ল।। * সমাপ্ত