দীপাবলীর আলোর রোশনাইতে ঘুচে যাক সমাজের অন্ধকার
বটু কৃষ্ণ হালদার
বিশ্বের দরবারে ভারত বর্ষ এক বিস্ময়কর নাম। এর কারণ হলো মিশ্র সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে বহিরাগত আরব জনজাতি প্রাচুর্য ভরা সম্পদে র টানে এই ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। এরপরে একে একে হুন,মোঘল,পাঠান,পর্তুগিজ, ইংরেজ সহ বহু বিদেশীরা এই ভারতবর্ষের বুকে এসেছেন। কোন কোন জনজাতি অর্থ সম্পদ লুট করে নিয়ে চলে গেছেন, কেউ কেউ ব্যবসা করেছেন,আবার কোন কোন জনজাতি চিরতরে ভারতবর্ষের বুকে রয়ে গেছে ন। এক রক্তের মহা সংগ্রাম এর দ্বারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা পাওয়ার পর”নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান/বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান” উক্তিটির মধ্য দিয়ে ভারত বর্ষ ভিন্ন সংস্কৃতির দেশ হিসাব প্রাধান্য পায়।এর কারণে বছরের কোন না কোন সময়ে এই ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব লেগেই থাকে।আজও সেই সংস্কৃতি ও পরম্পরার টানে বিদেশ থেকে বহু পর্যটক প্রতিবছর ভারতবর্ষে আসেন।
এই ভারতবর্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হল পশ্চিমবাংলা।এই রাজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বাঙালি ও তাদের বাংলা ভাষা। যুগ যুগ ধরে বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে বাঙালিরা বহু রক্ষা করেছেন। শুধু বাংলা ভাষা নয়, কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই বাঙ্গালীদের ধর্মীয় উৎসব শুধুমাত্র পশ্চিমবাংলা নয় সমগ্র বিশ্বের বহু জায়গায় পালিত হয়। বাঙ্গালীদের এক অন্যতম ধর্মীয় উৎসব হলো দুর্গাপূজা।এই দুর্গাপূজার পর যে উৎসব বাঙালি আতসবাজির রোশনাইয়ে সমাজকে আলোয় ভরিয়ে দেয়। বাংলা ভাষা প্রেমিক বাঙ্গালীদের সবথেকে বড় আবেগের উৎসব হলো দুর্গাপূজা। বছরে এই কয়েকটা দিন উৎসব এর জন্যই আমরা সবাই অপেক্ষা করে থাকি। বলতে গেলে জাত ধর্ম নির্বিশেষে মিলন উৎসব ও বলা হয়ে থাকে। বছরের এই তিন চারটে দিন উৎসবে মেতে থাকার পরে হয় বিসর্জনের খেলা। সিঁদুর খেলা ও মিষ্টিমুখ দিয়ে দুর্গা মাকে বিসর্জন দেওয়া হয় চোখের জলে। চোখের জল মুছতে মুছতে আপামর বাঙালি আবেগঘন হয়ে ওঠে। আর বলতে থাকে মা তুমি পরের বছর আবার যথাসময়ে বাপের বাড়িতে উপস্থিত হবে। মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, সেই ভগ্ন হৃদয় কে কিছুটা হলেও আনন্দে পরিপূর্ণ করে তোলে মা লক্ষ্মী ও কালীপূজা।
কালী বা কালিকা হলেন একজন দেবী। তিনি দেবী দূর্গার একটি রূপ । তার অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় আবশ্যিক কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যা-র প্রথম দেবী। শাক্তমতে কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। বাঙালি হিন্দু সমাজে কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।কালীবঙ্গদেশ, কাল (সৃষ্টি, পরিবর্তন, স্থিতি, ধ্বংস) ও শক্তির দেবী।দেবী কালীর একটি প্রসন্ন প্রতিমাঅন্তর্ভুক্তিহিন্দু দেবী ,মহাবিদ্যা ,মাতৃকা,আদি পরাশক্তি,পার্বতী ,দূর্গা,মহাকালীশ্মশান কালী রূপেও তিনি পূজিত হন।
অস্ত্র খড়্গবাহন,শব (শবরূপী শিব
পুরাণ ও তন্ত্র সাহিত্যে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়)। এগুলি হল-দক্ষিণাকালী(শ্যামা),মহাকালী,শ্মশানকালী গুহ্যকালী, ভদ্রকালী, সিদ্ধকালী, আদ্যাকালী, চামুন্ডাকালী।আবার বিভিন্ন মন্দিরে “ব্রহ্মময়ী”, “ভবতারিণী”, “আনন্দময়ী”, “করুণাময়ী” ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা পূজা করা হয়।এই সব রূপের মধ্যে দক্ষিণাকালীর বিগ্রহই সর্বাধিক পরিচিত ও পূজিত। দক্ষিণাকালী চতুর্ভূজা। তার চার হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা রয়েছে। তার গলায় রয়েছে নরমুণ্ডের মালা। দেবীর গায়ের রং কালো। মাথায় আলুলায়িত চুল এবং তিনি শিবের বুকে ডান পা আগে রেখে দণ্ডায়মান।
ব্রহ্মযামল নামক তন্ত্রগ্রন্থের মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। এছাড়া মাঘ মাসের চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজাও বিশেষ জনপ্রিয়। এছাড়াও ভাদ্র ও পৌষ মাসের অমাবস্যায় কালী পুজো বিশেষ জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে।
ভারত, বাংলাদেশে অনেক কালী মন্দিরের দেখা পাওয়া যায়।
‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ ‘কৃষ্ণ’ (কালো) বা ‘ঘোর বর্ণ’।হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত-এ যে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে, তা দেবী আদি শক্তি পার্বতীর রূপ।মহাভারত-এ ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী’ নামে আরও এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধৃবর্গ ও পশুদের আত্মা বহন করেন। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে “সময়ের থেকে উচ্চতর”। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, ‘কালী’ শব্দটি ‘কৃষ্ণবর্ণ’ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। প্রকৃত অর্থে কাল (সময়) কে কলন (রচনা) করেন যিনি তিনিই (কাল+ঈ) কালী। সনাতন ধর্মে ঈ-কারের সৃষ্টি ও শব্দোচ্চারণ-কে উল্লেখ করা হয়েছে ঈশ্বরী বা সগুণ ও নিগুর্ণ ব্রহ্মকে উপলদ্ধি করার জন্য। আবার শ্রীশ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ মেলে যে,
‘ইয়া দেবী সর্বভুতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে,
নমস্তসৈ, নমস্তসৈ নমো নমোঃহ।’
এই কারণে অনেকেই কালী-কে ক্রোধাম্বিতা, রণরঙ্গিনী বা করালবদনা বলেও অভিহিত করে থাকেন।
দেবীর আর্বিভাব সম্পর্কে পৌরাণিক ব্যাখ্যা ও সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেব লোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা পার্বতীর তপস্যা করতে থাকেন, তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত। দেবী কৌশিকী মা মহামায়ার দেহ থেকে নিঃসৃত হয়ে মহাকাল বর্ণ ধারণ করে।
এই পূজা প্রাচীন নয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধি গ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তার সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদিয়ায় কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃষ্ণ চন্দ্রের পৌত্র ঈশান চন্দ্রও বহু অর্থব্যয় করে কালীপূজার আয়োজন করতেন।
আমরা যে রূপে কালীকে পুজো করি সেখানে কালীর পায়ের নীচে শায়িত থাকেন শিব। আসলে অসুরদের হারিয়ে প্রবল বিজয় নৃত্য শুরু করেছিলেন কালী। অসুরদের ধরহীন মুন্ড দিয়ে তিনি বানিয়ে ছিলেন কোমরবন্ধ ও গলার মালা। কালীর সেই নৃত্য স্বর্গে ত্রাহি-ত্রাহি রব ছাড়ে। কালীর নাচে তখন সব কিছু প্রায় ধ্বংস হতে শুরু হয়েছে। এমন অবস্থায় কালীর সেই নৃত্য মহাদেব বন্ধ করতে কালীর সামনে গিয়ে শুয়ে পরেন। তার পরে নিজের পায়ের নীচে স্বামীকে শুয়ে থাকতে দেখে জিভ কাটেন তিনি। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে সেই সময় কালীর সেই রূপ পূজিত হয়ে আসছে আজও।
কালীর একটি নয় দুটি রূপ আছে। কোথাও কালীর ডান পা আবার কোথাও কালীর বাঁ পা এগিয়ে থাকতে দেখা যায়। বিগ্রহে কালীর ডান পা এগিয়ে থাকলে তিনি তখন দক্ষিণা কালী। আর যখন তাঁর বাঁ পা এগিয়ে থাকে তখন তিনি বামা কালী। আর এই দুই রূপেই পুজিত হন মা কালী।
যুগ যুগ ধরে দেবী কালীকে নিয়ে উন্মাদনা ও রহস্য ঘিরে রয়েছে সমাজের বুকে।কিন্ত কেন এই রহস্য ঘিরে আছে কালীমূর্তিকে? বাংলার প্রায় সব দেবদেবীই বসন পরিহিতা। সালঙ্কারা। মা কালীকেও বিভিন্ন অলঙ্কারে সাজানো হয়। তবে বরাবর তাঁর নগ্নিকা রূপই পূজ্য। প্রসাদী ভক্তিগীতিতে তাই মাকে বসন পরার আর্তি শোনা যায়। এছাড়া কোনও কোনও রূপে কালী ভয়ংকরী, যেমন ছিন্নমস্তা। আবার কোথাও তাঁর মাতৃভাবের প্রকাশ। দশমহাবিদ্যা বলে যে দশজন সিদ্ধা দেবী, তাঁদের প্রথমজন হলেন কালী। এই কালীর বিভিন্ন রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। যথা, দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী প্রভৃতি। এর মধ্যে দক্ষিণাকালী রূপটিই বাংলায় বেশিমাত্রায় পুজো পায়। এই মূর্তিতে মায়ের একহাতে ছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ। অন্যহাতে বরাভয়। মায়ের গাত্রবর্ণ মেঘের ন্যায় এবং তিনি দিগম্বরী। কেন এই কালি মূর্তি নগ্ন?
কালী শব্দের উৎপত্তি কাল থেকে। কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ কালী। কাল বলতে বোঝায় সময়। অর্থাৎ অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতকে যিনি কলন করেন তিনি মহাকাল। আর সেই মহাকালের নিয়ন্ত্রক যিনি, তিনিই মহাকালী।সাধক কমলাকান্ত ভট্টচার্যের গানে তাই পাই, ‘সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনমোহিণী, আপনি নাচ আপনি গাও মা আপনি দাও মা করতালি।’ এই গানেই আর একটু এগিয়ে কমলাকান্ত বলেন, ‘আদিভূতা সনাতনী শূণ্যরূপা শশীভালী, ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুন্ডুমালা কোথা পেলি?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই দেখা যায়, আসলে কালী অনন্তের প্রতীক। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে মুণ্ডমালা পাওয়ার তাই প্রশ্ন উঠছে না। এ আসলে মানুষের অহং ছিন্ন করার প্রতীক। তাঁর এক হাতে তাই খড়্গ। সেই খড়্গের আঁকা চোখ প্রজ্ঞার প্রতীক। অন্য হাতে বরাভয়। এই কল্পিত রূপেই শক্তির দ্বিবিধ রূপের সমাহার। একদিকে তা বিনাশী, অন্যদিকে তা সৃষ্টিরও প্রতীক বটে।
এই আদিশক্তি বা আদ্যাশক্তি ‘সময়ের থেকেও উচ্চতর’। কাল থেকে কালীর উৎপত্তি ধরলে, তা আসলে সময়ের সীমানা পেরনো এক ধারণা। সেই অনন্তকে কোনও জাগতিক বস্ত্রের আবরণে আবৃত করা যায় না। দেবী তাই নগ্নিকা। আবার কোনও কোনও মতে বলা হয় কালী শক্তির প্রতীক, শক্তিকেও কোনও বসন বা আচ্ছাদনে আবদ্ধ করা যায় না। তাই নগ্নিকা হিসেবেই কালীর ধারণা গড়ে উঠেছে। তবে ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, কালীমূর্তি যে বাংলার শান্ত দেবদেবীর আলয়ে ব্যতিক্রমী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
করালবদনী মা কালী ছিন্নমস্তা সঙ্গে ডাকাতদের একটা বিশেষ যোগ সূত্র ছিল। আজ থেকে প্রায় দেড়শ দুইশ বছর আগে বাংলার গ্রাম গঞ্জে তাবড় তাবড় সব জমিদার বাবুদের প্রাসাদে,প্রাসাদে সে রেস্তায় দরবারে এমন কি অন্দরমহলে ডাকাতদের বিভিন্ন চিঠি পৌঁছে যেত।ব্যাস চিঠির এটুকু বয়ান যথেষ্ট ছিল। তবে তৎকালীন সময়ে অত্যাচারী রাজা মহারাজাদের কাছে যম ছিল ওই সময় রঘু ডাকাত রা। তারা জমিদারদের কাছে ছিল যম, আর গরিবদের কাছে ছিলেন রবিনহুড।বড়লোকদের সম্পত্তি তারা লুট করে নিয়ে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।বিভিন্ন সাহিত্যে লেখকরা তাদের দয়া ও দানের কথা উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন সময়ে।চিঠি পাওয়ামাত্র জমিদারবাবুর গোপণ কুঠুরি সিন্দুক থেকে টাকা বেরিয়ে ডানা মেলে উড়তে উড়তে সোজা পৌঁছে যেত ভুষুন্ডি কিংবা ঠেঙ্গামামারির মাঠে। থানা কোতোয়ালী করার সাহস পেত না কেউ।কারণ সেই চিঠির একদম নিচে লেখা থাকতো আমাদের এই চিঠির বিষয়ে কোতোয়ালিতে জানাইলে বা আমাকে কোন বিপদে ফেলার চেষ্টা করিলে তোমাকে উপযুক্ত প্রতিফলন সেবন করিতে হইবেক ইহা মনে রাখিবেক। এমন সব ডাকাতের দলগুলোর দেবী কালিকা প্রতি নিবেদিত প্রাণ ভক্ত ছিল। গরিবের রবিনহুডরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই মা কালী তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। কিংবদন্তির পর্যায়ে ছিল তার নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা। তারা আরো মনে করতেন নারীরা মহামায়া র অংশ মাতৃ স মা। একইসঙ্গে শক্তিরূপিণী।মাতৃশক্তির বরাভয় বা আশীর্বাদ ছাড়া কার্যসিদ্ধি হওয়া সম্ভব নয় কোনমতে। সুতরাং তাদের প্রতি ন্যূনতম অশ্রদ্ধা অসম্মান প্রদর্শন করা চলবে না ডাকাত দলের প্রত্যেক সদস্যের প্রতি কঠোর নির্দেশ ছিল গুরুদেব দের। অন্যান্য কর্মচারীরাও সেই নির্দেশ যথাযথ আজ্ঞাবহ স্বরূপ পালন করতেন। আর যদি কেউ এই আজ্ঞা সঠিকভাবে পালন না কর করতো তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হত। এখানে উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বিশু ডাকাতের কথা। তিনি একসময় ছিলেন বাংলার ত্রাস। দরিদ্রের ভগবান ডাকাতের নাম ছিল শ্রী বিশ্বনাথ বাগদি। গায়ের হাভাতে মানুষগুলো তাকে ডাকতো বিশ্বনাথবাবু নয় তো রাজা বিশ্বনাথ নামে। নদীয়া থেকে মুকশুদাবাদ(অধুনা মুর্শিদাবাদ) হয়ে ২৪ পরগনা,হাওড়া,হুগলি অব্দি বিস্তৃত ছিল রাজা বিশ্বনাথের সাম্রাজ্য।যিনি ইংরেজ কোম্পানি,বাবু,বানিয়া,জমিদার আর নীলকর সাহেবদের চোখে ছিল বিশে বাগদী,বিশে ডাকাত অথবা ডেকয়েট। তার দলের এক ঘনিষ্ঠ সহচর এর নাম ছিল বৈদ্যনাথ ঘোষ বোদে গয়লা। তিনি দলের সর্দার এর নির্দেশ অমান্য করার ফলে বৈদ্যনাথ ঘোষকে একবার প্রচন্ড প্রহার করেছিলেন। আহত অপমানিত বো দে দল ছেড়ে গিয়ে কোম্পানি নীলকর সাহেব আর জমিদার বাবুদের গুপ্তচর বনে যায়। এর ফলে পরবর্তীকালে চরম ক্ষতি হয়েছিল বিশু ডাকাতের।কিন্তু মাতৃশক্তির অপমান এর সঙ্গে কোন শর্তে আপোষ করেননি সে।বর্ধমানের কালনায় এক ধনী গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন একদল ডাকাত। কোন উপায় না দেখে সেই বাড়ির ঘর কৃষ্ণকায় এবং পরমা সুন্দরী এক গৃহবধু তার শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি বাঁচাতে সম্পুর্ন নগ্ন হয়ে বাড়িতে রাখা মোষ বলির রাম খাঁড়া টি হাতে নিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন ডাকাতদের সামনে।মাতৃ শক্তি সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে করজোড়ে নতজানু হয়ে বসে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন ডাকাত দলের সর্দার।”এ কাজ করলে যদি তোর এত ক্রোধ হয় সে দুষ্কর্ম আমি কখনো করবো না মা”বলেই সেই গৃহবধূকে ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সদলবলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিল ডাকাতের সরদার।পরদিন ভোরে বাড়ির পাশে জলাশয় ভেসে উঠতে দেখা গিয়েছিল ওই গৃহবধূর মৃতদেহ।পর পুরুষের সামনে নগ্নিকা হওয়ার লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করেছিলেন সেই গৃহবধূ।
তৎকালীন সময়ে বাংলার ডাকাতদের মধ্যে মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে দেবীর পাদদেশে নরবলি দেওয়ার প্রথা ও ছিল এ তথ্য জানা যায় একাধিক কাহিনী সূত্র থেকে।বিভিন্ন লেখকের এর সাহিত্যমালা আমরা নরবলির কথা জানতে পারি।তবে এই বলির জন্য মূলত উৎসর্গ করা হতো জমিদারবাবু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বা কোনো বিশ্বাস ভঙ্গ কারি কে।কিন্তু কোন দরিদ্র নিরন্ন মানুষের বাড়িতে ডাকাতি অথবা ডাকাতের হাতে তাদের কোন অনিষ্ট সাধন হয়েছে এজাতীয় প্রমাণ পাওয়া খুব কম পাওয়া যায়।
আমার ছোট বেলা কেটেছে গ্রামে।নব্বাইয়ের দশকে কালী পূজা কে কেন্দ্র করে পাড়ায় পাড়ায় চলত পূজার প্রতিযোগিতা ও উন্মাদনা।শিশু মনে ও স্থান করেছিল মা কালী।নিজেদের মধ্যে টাকা তুলে বিল বই ছাপাতে দিতাম।সেই টাকা আসত বাবার পকেট দিয়ে চুরি করে।অনেকে মার ও খেয়েছে চুরি করার জন্য।বেশির ভাগ সময়ে দলের লিডার আমি হতাম।কারণ যত আজগুবি প্ল্যান আমার মাথায় আসত।এই যেমন কারো বাগানের ফুল,সবজি, ডাব ফল ইত্যাদি চুরি করার জন্য আমরা বিভিন্ন সময়ে প্ল্যান করতাম। সারারাত জেগে কালী পূজার আনন্দ উপভোগ করতাম। তখন বাজি কেনার পয়সা অতটা ছিল না। হয়তো এক প্যাকেট চকলেট নয়তো কালিপটকা ফুলঝুরি দোদোমা দিয়ে সারা রাত কেটে যেত।তবে অন্যের মাথায় হাত বুলিয়ে তার বোমা ফাটাতে বেশি। তবে সব থেকে বেশি মিস করি পাটকাঠি ও শুকনো খড় দিয়ে বানানো আঁজুলে, পিজুলে। বাঙ্গালী সভ্যতার এক প্রাচীন নিদর্শন যা হারিয়ে যেতে বসেছে।পুকুরের চারপাশে নয়তো বাড়ির সামনে পাটকাঠি উপর খড় দিয়ে যেটি তৈরি করা হতো তাতে আগুন জ্বালিয়ে ঘোর অমানিশার অন্ধকার দূর করা হতো। আবার মশাল তৈরি করে সারা রাস্তায় দৌড়ানো হত।পাট কাঠি তে আগুন জ্বালিয়ে সবাই মিলে বেশ মজার মজার ছড়া ও কাটা হত।মোমবাতি নয় বাড়িতে বানানো মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ির চারপাশ সাজানো হতো। কালী পূজার পরের দিন অলক্ষী তাড়িয়ে আনা হয় গৃহলক্ষী। দেখতাম কলাগাছের ছাল ছাড়িয়ে সেটাকে ত্রিভুজের মত বানিয়ে তাতে দুটি মাটির পুতুল রেখে তাতে ধুপ,মোমবাতি দূর্বাঘাস,ধান সহ পূজার জিনিস তাতে সাজিয়ে সবাই মিলে শঙ্খ,ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মাঠের মাঝখানে ফেলে দিয়ে আসতো।
শাক্ত সাধনার অন্যতম পীঠস্থান হলো এই পশ্চিমবাংলা। শক্তির পূজা দীর্ঘকালীন এক চর্চা ও চর্যা হয়ে এই অসম হিমাচল বঙ্গ রাজ্যে রয়েছে।ছোট থেকে বড় স্থানীয় মন্দিরের জোক তন্ত্র আর কালী সাধনা নানা কাহিনীতে ভারাক্রান্ত আমাদের যৌথ স্মৃতি আমাদের মনে ঢুকে থাকা চন্ডী চামুন্ডা কালীর প্রতীক আর কৌম সমাজের রোমে রোমে প্রবিষ্ট শ্যামা সংস্কৃতি আমাদের।যার একদিকে যদি তন্ত্রের রহস্যময় ভয়াবহতা অন্যদিকে স্নেহ বিগলিত শ্যামা সংগীত।ইতিহাস যেমন তেমন আমাদের সাহিত্যে বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা থেকে রবি ঠাকুরের গুপ্তধন এইসব অন্ধকারাচ্ছন্ন গুপ্ত কারবারের স্মৃতি জেগে আছে।বাঙালির ধর্ম ও সমাজ গ্রন্থে যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন হিন্দু ধর্মের প্রচারক অংশ দুর্গাপূজার কথা। শাস্ত্রীয় ধর্মচিন্তা অনুযায়ী দুর্গা মা চন্ডী আদ্যা শক্তি সৃষ্টি স্থিতি বিনাশকারী নী ব্রম্ভ স্বরূপিনী। শ্রীশ্রী চন্ডীতে তার স্বরূপ বর্ণিত।বাঙালি হিন্দুর প্রধান উপাস্য কালী পূজার ব্যাপক প্রচলন সম্ভবত ষোড়শ সপ্তদশ শতকে হয়েছিল। তাই মুখ দেখলেই বোঝা যায় এই দেবীর পিছনে অনার্য নিষাদ কল্পনা মূল প্রেরণা ছিল।
বাংলা সাহিত্যেও বারবার ফিরে এসে মা কালী। আমরা জানি কবি কাজী নজরুল ইসলাম অগণিত শ্যামা সংগীত লিখেছিলেন। যা সব থেকে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সারারাত জেগে সেই শ্যামা সংগীত শুনে কাটিয়ে দিতাম।ইসলাম ধর্মের হয়েও নজরুল ইসলাম কালী মায়ের গান এ অন্তর এর যাবতীয় দুধ মিশিয়ে এক আশ্চর্য রসায়ন তৈরি করতে পারতেন। এজন্য তাকে জেলেও যেতে হয়। সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?”গুরুদেবের সেই ঘরে বাইরে তে ও মা কালীর বর্ণনা একটু অন্যরকমভাবে পাওয়া যায়।বিমালা বলেছিল আমাদের দেশে তাকেই বলে সুন্দর যার বর্ণ গৌর। কিন্তু যে আকাশ আলো দেয় সে যে নীল। আমার মায়ের বর্ণ ছিল শ্যামলা,তাঁর দীপ্তি ছিল পুণ্যের। তাঁর রূপ রূপের গর্ব কে লজ্জা দিত। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি কাব্যে কালী সাধক এর অবদান যে কত বড় তা বোঝা যায় এর থেকেই…..আমরা কমলাকান্ত থেকে সাধক রামপ্রসাদের কাছেই বারবার হাত পেতে ই থেকেছি।এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আমাদের এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত যে আলাদা করে মনেই আসে না।” ধুম লেগেছে হৃদ কমলে” এই গানের মধ্য দিয়েও শঙ্খ ঘোষ পুনরাবিষ্কৃত,পরিপূর্ণ, বিশাল পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন। মা কালীর কথা প্রসঙ্গে আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ এর কথা কিভাবে ভুলে যাব। জগধাত্রী কালী দুর্গা তিনটি মূর্তিকে প্রতীকের মতো ব্যবহার করে তিনি“মা যা ছিলেন মা যা হইয়াছেন মাজা হইবেন এর ত্রয়ী রূপে বিবর্তন ঘটিয়েছেন। অন্ধকার সমা ছন্না কালিমা ময়ি। হৃতসর্বস্ব এইজন্য নগ্নিকা। আজি দেশে সর্বত্রই শ্মশান এইজন্য মা কঙ্কাল মালিনী। মনে পড়ে যায় ২০২০ তে লেখা কবিতার লাইন _”গরম পাথর থেকে ভাপ ওঠে/গহন কাজলে আঁকা তিনটি চোখ/তার জিভে অসাড় গরল/বিপুল আঁধার থেকে উঠে আসে ছিন্নমস্তা/নিজের কন্ঠ ছেঁড়া রক্তিম ফিনিক/নিজের কপাল পাত্রে ধরা?”(জয়া মিত্র/দেবী ছিন্নমস্তা)
দীপাপলির আলোর রোশনাইতে ঘুচে যাক সমাজের অন্ধকার — নিবন্ধে বটু কৃষ্ণ হালদার অনেক কিছু জানালেন সাহিত্যের শৈলীতে, ওনার কলাম খুবই বিখ্যাত ও পাঠক প্ৰিয়, খুব পন্ডিত ও সাহসী কলামনিস্ট উনি, ওনার লেখা মাঝে-মাঝে পেলে পাঠক-পাঠিকাদের তৃপ্তি দান করবে !’আমার ধারণা !
— ঋদেনদিক মিত্রো
Ridendick Mitro
Kolkata, India,