পতন শুরু হয়ে গেল
অশোক কুমার আচার্য্য
বাড়ি পৌঁছে খবর পেলাম রীতা আর নেই। কানে যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম কার কথা বলছো।করুনা আস্তে করে বলল- রাজুদা ফোন করেছিল,তোমাকে অনেকবার ফোন করেছে পায়নি। তারপর আমাকে ফোনে বলল, তোমার বন্ধু রীতাদির গতকাল রাত্রে স্ট্রোক হয়েছিল। বাড়ির লোকজন সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার ডিসান হাসপাতালে নিয়ে যায়।চিকিৎসার সুযোগ দেয়নি।রাস্তাতেই মারা যায়।বাড়ির সবাই বুঝতে পেরে ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার দেখেই বলেন, সব শেষ হয়ে গেছে।
আমাদের বয়স হয়েছে বুঝতে পারলাম। হলদিয়া হাই স্কুল থেকে উনিশ শতকের আশি সালে আমরা একসঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি।রীতার বোন রীনাও আমাদের সঙ্গে পড়তো।দুই বোন একসঙ্গে পড়লেও ওরা যমজ ছিল না। পিঠোপিঠি বলে একই রকম লাগতো। রীতা ছোট বেলায় খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে হাতের হাড় ভাঙে।ওদের বাবা হলদিয়া ডক কমপ্লেক্সে চাকরি করতো।সেই জন্য কোম্পানির হাসপাতালে চিকিৎসা করায়।সে সময় ভালো ডাক্তাররা কোন কোম্পানির হাসপাতালে চাকরি করতো না।যার ফলে ভাঙা হাড় জোড়া লাগলেও বাম হাতটা একটু বাঁকা থেকে যায়।দুর্ঘটনার কারনে পড়ার ক্ষতি হয়।শেষপর্যন্ত একবছর পিছিয়ে গিয়ে বোনের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তে থাকে।প্রথম দিকে একটু ওর মেনে নিতে অসুবিধা হলেও পরে আমাদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। রীনার দিদি বলে আমিও ওকে রীতাদি বলেই ডাকতাম।
রীতাদির সঙ্গে আমার খুব সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। ক্লাস অফ থাকলে আমরা বসে বসে গল্প করতাম। কত অজানা বিষয় আলোচনায় উঠে আসত আমাদের মধ্যে। হলদিয়া বন্দর তখন সবে একটু একটু করে গড়ে উঠছে। চারিদিকে কারখানার পাইলিং এর দুমদাম শব্দ। মানুষ বিশ্বকর্মা নগর নির্মাণ করতে লেগেছে। চালু হয়ে গিয়েছে হলদিয়া ডক।তেনজিং নোরগে এসেছে গঙ্গোত্রী হিমবাহ ও গঙ্গার সৃষ্টি রহস্য মোচনের জন্য তার স্পিডবোট নিয়ে হলদিয়ায়। হলদিয়া ডকের চারপাশে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়।আমরা ও গিয়েছি অভ্যর্থনা জানাতে, জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে। স্থানীয় ছেলে হওয়ায় এলাকা আমার হাতের তালুর মতো স্পষ্ট। ফিঙ্গার জেটি তৈরি চলছে।যদিও একসময় কালবৈশাখীর প্রবল নাচনে ফিঙ্গার জেটির উপর নির্মিত ক্রেন ডকের নীল জলে সমাধি প্রাপ্ত হয়
।দুর্ঘটনার পরের দিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখে এসে রীতা দিকে বলেছি সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা।
আমরা যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই তখন ও অনেক পরিনত।এর মধ্যে স্কুলের অনেকে প্রেমপত্র দিয়েছে। তা নিয়ে রেষারেষি হয়েছে নিজেদের মধ্যে। সব কথাই জেনেছি আর বিকশিত হয়েছি যৌবনের এক একটি ধাপে।আমাদের ব্যাচের সবাই মাধ্যমিক পাশ করতে পারেনি।সে সময় পাশের হারটাও ছিল অনেক কম। শতকরা চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ জন ছাত্র ছাত্রী পাশ করতো।তবে আমরা পাশ করেছি আর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি নিজেদের মধ্যে। এক একজন এক একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে ভর্তি হয়েছি। এরফলে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে রবিবার বা ছুটির দিনে বিকেলবেলায় সাইকেলে ওদের কোয়ার্টারে গিয়েছি।তখন রীতাদির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও মনটা টানতো রীনার জন্য। রীতাদিও সেটা জানতো।কিছুটা প্রশ্রয় ও যে ছিল না তা নয়।সম্পর্কটা অনেকটা খোলামেলা ছিল। নিজেদের মধ্যে লুকোচুরি ছিল না।
দু’বছর পর আমাদের মধ্যে আবার দেখা-সাক্ষাৎ বেড়ে গেল আমি মহিষাদল রাজ কলেজে ভর্তি হওয়ায়। একই পথে ওদের কলেজ রামপুর মহাবিদ্যালয়। যাওয়া আসার সময় বাসে আমার জন্য ওরা পাশের সিটটা রেখে দিত।কখনো হয়তো আমি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য আগে চলে গিয়েছি।দেখা হয়নি।কখনো আবার ওদের কলেজে আগে ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। তবুও মাঝে মাঝে যখন আমাদের মধ্যে বাসে দেখা হতো তখন আমরা উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারিনি।
হলদিয়া টাউনশিপে কলকাতার অগ্রগামী যাত্রা দলের ‘মীরার বঁধূয়া’ যাত্রা হবে। নাম ভূমিকায় বীনা দাশগুপ্তা ও তার দাপুটে অভিনয়। দেখতেই হবে।আমি চলে গেলাম রীতাদিদের কোয়ার্টারে।ওরা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে যাত্রা দেখতে যাওয়ার।একটু আগে না গেলে টিকিট পাওয়া যাবে না। রীতাদির ভাই গেল টিকিট কাটতে।আমরা সবাই এক রকম সামনে বসে যাত্রা পালা দেখেছিলাম। সঙ্গে উপরপাওনা মুড়ি আর ফুলুরি। যাত্রা শেষে রাত্রে কাকিমা কোয়ার্টারে থেকে যেতে বললেও আমি ওদের কথা ভেবে সেদিন ভিড় বাসে করে বাড়ি এসেছিলাম। তাতে আমার গ্রহন যোগ্যতা ওদের বাড়িতে অনেকটা বেড়েছিল।
আমরা সবাই যে যার বিষয় নিয়ে কলেজ থেকে পাশ করে বের হলাম।রীতাদিরা ভর্তি হলো শর্ট হ্যান্ড ও টাইপ শিখতে।আমি লেগে গেলাম কন্ট্রাক্টর এর সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতে। মাসে চারশ টাকা পেতাম।ওই টাকায় নিজের হাতখরচ চালিয়ে কম্পিটিশন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি ।দেখতে দেখত আমরা বড় হচ্ছি।প্রথমে রীনার বিয়ে হয়ে গেল।পাত্র পক্ষ রীনাকে এককথায় হাইজ্যাক করে নিয়ে গেল।সময় বেশি দেয়নি।আমরা বন্ধুরা অনেকেই গিয়েছিলাম ওর বিয়েতে।সবাই খুব খুশি। আমাদের ব্যাচের প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান। রীনাকে বিয়ের কনের সাজে দেখে আমার মনটা একটু ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম।ওর একটা কথা আমার কানে এখনো বাজে- আমরা সমবয়সী না হলে আমি তোকেই বিয়ে করতাম।দ্যাখ তোকে তো নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।এখন তা হওয়ার নয়।আমি মাথা নেড়েছি, নিজেদের বিশ্বাসে কোনদিন আস্থা হারাইনি।
রীনার বিয়ের ঠিক দু’মাস পরে রীতাদির বিয়ে হয়ে গেল।মহা ধূমধাম করে।বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন কাকু কাকিমা একটু বেশি করেছিল।বিয়ের পর রীতাদি হলদিয়াতেই সেটেল্ড হলো। বরের চাকরির সুবাদে। আমাদের মধ্যে মাঝে কয়েকবার দেখা হয়েছে ওদের বাড়িতেও গিয়েছি।পুরনো দিনের কথা বেজেছে মৃদু ছন্দে।একমাত্র মেয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। তাকে নিয়ে ওদের কত স্বপ্ন বোনা শুরু হয়েছিল। সব স্বপ্নপূরন দেখা আর হলো না।সবাইকে টা টা করে চলে গেল এক মূহুর্তে। আমাদের যাওয়া আসা শুরু হয়ে গেল অজানা অচেনা এক ফিরে না আসা শহরে।