🌾ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য:–
✍️কৃষ্ণপদ ঘোষ✍️
উপস্থাপন–৯
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
★ ভীষ্ম সকাশে যুধিষ্ঠিরাদি ★
শিবিরে যুধিষ্ঠির ফিরিয়া সেই রাতে,
করিলেন মন্ত্রণা বন্ধু-বান্ধব সাথে।।
কহেন কৃষ্ণে যুধিষ্ঠির বিষন্ন মনে,
এই রণে ভীষ্মে মোরা জিনিব কেমনে।।
ভীষ্ম মোদের সেনা করিছেন হনন,
যথা নলবন হস্তীযূথ করে মর্দন।।
বুদ্ধি দোষে করি যুদ্ধ আমি ভীষ্ম সনে।
নিমগ্ন শোক সাগরে অতল গহনে।।
দশ সহস্র সেনা দিনে করেন হনন।
যুদ্ধ ত্যজি শ্রেয়স্কর অরণ্যে গমন।।
বাকী জীবন আমার করিব যাপন,
অরণ্য গভীরে করিয়া ধর্মাচরণ।।
মোদের প্রতি অনুগ্রহ থাকিলে তব,
স্বধর্ম পক্ষ নির্দেশ দেহ হে মাধব।।
*
কহেন কৃষ্ণ বিষন্ন না হইবেন এবে।
দুর্জয় পরন্তপ আপনার ভ্রাতা সবে।।
পার্থ হইলে অনিচ্ছুক ভীষ্ম হননে,
নিযুক্ত করুন মোরে ভীষ্ম পতনে।।
ভীষ্মে করি আহ্বান সম্মুখ সমরে,
সর্বসমক্ষে রণক্ষেত্রে নাশিব তাঁরে।।
পাণ্ডবের শত্রু জানিবেন যেই জন,
আমারও হয় বৈরী সেই সে দুর্জন।।
অর্জুন সে সখা সম্বন্ধী শিষ্য আমার।
তার লাগি পারি দিতে দেহাংশ আমার।।
অর্জুন করিল প্রতিজ্ঞা ভীষ্ম হননে,
এক্ষণে ব্রতী হোক তার পণ পালনে।।
হয় করুক হত্যা সে রণক্ষেত্রে তাঁরে,
নতুবা সেই ভার আজ দিন আমারে।।
ভীষ্ম দিয়াছেন যোগ অধর্মের পক্ষে।
ধর্মে বিনাশিয়া অধর্মে করেন রক্ষে।।
সেই অধর্মে আমি করিব নিপাতন।
শেষ হয়ে আইল ভীষ্ম-শক্তি-জীবন।।
*
কহেন যুধিষ্ঠির তুমি দিলে অভয়,
ভীষ্ম তুচ্ছ ইন্দ্রেও করিতে পারি জয়।।
সমরে তোমারে অনুমতি দিতে নারি।
লভিতে স্বার্থ মিথ্যাবাদী কেমনে করি।।
যুদ্ধে অস্ত্র না ধরিও তুমি হে মাধব।
সমরে সাহায্য সদা পাই যেন তব।।
কহেছিলেন একদা পিতামহ মোরে,
হিত লাগি মন্ত্রণা দিবেন তিনি মোরে।।
অতএব মোরা সবে যাইব তথায়।
জানিব জিনিতে তাঁরে কি আছে উপায়।।
হিতবাক্য কহিবেন তিনি নিশ্চয়।
তাহাতে নিশ্চয়ই হবে মোর জয়।।
বালক পিতৃহীন মোরা ছিলাম যবে,
মানুষ করিলেন এই পিতামহ সবে।।
আজ সেই পিতামহে বধিবারে চাই।
ধিক ক্ষত্রজীবন এ নাহি কভু চাই।।
*
ত্যজি অস্ত্র কবচ কৃষ্ণ পাণ্ডবগণ,
নতশিরে ভীষ্ম সকাশে করেন গমন।।
প্রণমিলা সকলে তথা ভীষ্ম চরণ।
কহিলেন ভীষ্ম, কহ কিবা প্রয়োজন।।
কিবা হেতু তব হেথা আজি আগমন।
প্রিয় কার্য আমি কিবা করিব এখন।।
কিবা করিতে পারি কহ নিশঙ্ক মনে।
অতি দুষ্কর কর্মও করিব যতনে।।
কহিলেন যুধিষ্ঠির অতি দীন মনে,
বলুন এ যুদ্ধে জয়ী হইব কেমনে।।
প্রজাকুলে রক্ষা কেমনে করিব হায়।
আপনারে জিনিবারে না দেখি উপায়।।
সূক্ষ্ম ছিদ্রও কোথাও আপনার নাই।
ঘূর্ণমান ধনু কেবল দেখিতে পাই।।
শর বর্ষণে হল বিপুল সেনা ক্ষয়।
বলুন পিতামহ কিরূপে হইবে জয়।।
কহিলেন ভীষ্ম, শোন পাণ্ডুপুত্রগণ।
জয় অসম্ভব আমি জীবিত যতক্ষণ।।
কহেন যুধিষ্ঠির, থাকিলে ধনুর্বাণ,
আপনার হস্তে ইন্দ্রের শক্তিও ম্লান।।
করেন যুদ্ধ দণ্ডধর কৃতান্ত যথা,
সুরাসুরও ব্যর্থ নহেক মিথ্যা কথা।।
কহিলেন ভীষ্ম, এ অতি সত্য কথন।
সশস্ত্রে আমি অজেয় নাহিক মরণ।।
কিন্তু যদি ত্যজি অস্ত্র কভুও সমরে,
হত্যা তখন সহজেই করিও মোরে।।
যদি কেহ হয় নিরস্ত্র বা ভূ পতিত,
কিম্বা স্ত্রী, স্ত্রীনাম ধারী বা শরণাগত,
এক-পুত্র পিতা, বিকলাঙ্গ বা নীচ জাতি,
এদের সনে করিতে যুদ্ধ না হয় প্রবৃত্তি।।
পাণ্ডব সেনাদলে শিখণ্ডী মহারথ,
পূর্ব স্ত্রীত্ব তাঁর সকলেই অবগত।।
অর্জুন সম্মুখে তার রাখি শিখণ্ডীরে,
যুদ্ধে বিদ্ধ করুক মোরে সুতীক্ষ্ণ তীরে।।
এ ছাড়া বধিতে কেহ নারিবে আমায়।
যুদ্ধ জিনিবারে এই কহিনু উপায়।।
পিতামহ ভীষ্মে করিয়া অভিবাদন,
নিজ শিবিরে ফেরেন পাণ্ডুপুত্রগণ।।
হেরিয়া ভীষ্মে প্রস্তুত প্রাণ বিসর্জনে,
লজ্জিত অর্জুন কহেন দুঃখিত মনে,
পিতামহ সাথে যুদ্ধ করিব কেমনে।
বাল্যকালের কথা পড়ে এখন মনে।।
ধূলিমাখা গায়ে কতদিন বাল্যকালে,
ধূলিলিপ্ত করেছি বসি তাঁর কোলে।।
উঠিয়া কোলেতে ডেকেছি বলিয়া পিতা।
কহিতেন তিনি আমি নইতো পিতা।।
বৎস রাখিও মনে এই সত্য কথা,
পিতামহ আমি তোমার পিতার পিতা।।
সেই পিতামহে আমি কেমনে নাশিব।
হত্যা করিলেও মোরে বধিতে নারিব।।
হে মাধব ! কহিলাম মোর অভিমত।
এক্ষণে কহ তুমি আছে কিবা পথ।।
কহেন কৃষ্ণ, ভীষ্মে বধিতে করিলে পণ।
ক্ষত্রধর্ম ইহা, এখন তা করহ পালন।।
দুর্ধর্ষ ক্ষত্রিয় বীরে কর নিপাতিত।
নতুবা হইবে তব জয়-আশা হত।।
পূর্বেই অবগত ছিলেন দেবগণ,
শীঘ্র ভীষ্ম যমলোকে করিবে গমন।।
বৃহস্পতি কহিলেন, শোন দেবরাজ,
মূল্যবান এক কথা কহি আমি আজ।।
আততায়ী জানিবে তুমি সতত বধ্য,
হইলেও বয়োজ্যেষ্ঠ গুণবান বৃদ্ধ।।
(ক্রমশঃ)