Spread the love

গন্তব্য অযোধ্যা পাহাড়: ভ্রমণ ও বনভোজন
**********************
রাজকুমার সরকার [ঝাড়খণ্ড]

ইংরেজী বছরের প্রথম দিন থেকেই বনভোজন শুরু হয়ে যায়।পয়লা জানুয়ারি থেকেই বনভোজনে বহু মানুষ মেতে ওঠেন। বিভিন্ন পিকনিক স্পটে বনভোজনের দৃশ্য চোখে পড়ে।অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমরাও একদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে….
যতদূর মনে পড়ে ১৭ই জানুয়ারি,২০১৮
বুধবার সকাল সকাল একটি ভ্যান গাড়িতে চেপে পড়লাম। যাত্রীবাহী নয়;মালবাহী।এখানে গাড়ি কোনো বিষয় নয়;মোদ্দা কথা আনন্দ। পুরুলিয়া জেলার বরাবাজার ব্লকের একটি গ্রাম সরবেড়িয়া।সেখানে থেকেই রওনা দিয়েছিলাম। বরাবাজার হয়ে বলরামপুর।বলরামপুর থেকে অযোধ্যা।এই আমাদের যাত্রাপথ।বাঘমুণ্ডির কাছে সিন্দরী গ্রামে আমার স্ত্রী’র মেজমামীমার বাপের বাড়ি।একটা কাছাকাছি পরিচিত ঠিকানা হলে ভালো লাগে। বুকে বল থাকে। নিশীথ মামা প্রস্তুত। এদিকে আমরাও দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি।
গাড়ি থামলো বাঘমুণ্ডি মোড়ে।বাঘমুণ্ডি’কে অযোধ্যা পাহাড়ের প্রবেশ পথ বলা হয়।অযোধ্যা পাহাড়ের যাওয়ার দুটি মুখ্য পথ , এক বাঘমুণ্ডি হয়ে দুই সিরকাবাদ হয়ে।বেশিরভাগ মানুষ বা পর্যটক এই দুটি রাস্তাই ব্যবহার করেন। আরও রাস্তা রয়েছে।ঝালদা হয়েও অযোধ্যা পাহাড়ে যাওয়া যায়।এটিও একটি প্রবেশ পথ।মাঠা হয়েও যাওয়া যায়।আরও রাস্তা আছে যেগুলো জানা নেই। অবশ্যই থাকবে শর্টকার্ট রুট।সে প্রসঙ্গ এখন বন্ধ রাখছি।


বাঘমুণ্ডির বাজারে আমরা মাংস,সবজি,মশলাপাতি ,জল ইত্যাদি কিনে গাড়ি করে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে করতে সোজা অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে এসে হাজির।আমাদের যাবতীয় পরিকল্পনার মূল কাণ্ডারি আমিই……
চোখের সামনে লহরিয়া শিব মন্দির। আগে লহরিয়া শিবের মন্দিরটি একটি ছোট্ট ঝুপড়ির মত ছিল।বর্তমানে সংস্কার করে বিশাল মন্দির। স্থানীয় লোকমুখে জানা হোলো।
এখন লহরিয়া শিব মন্দির খুব সুন্দর। দেখছিলাম অজস্র বাস, প্রাইভেট গাড়ি।যেন কোনো বিশাল মেলা বসেছে।খবর নিয়ে জানলাম বেশিরভাগ পর্যটক কোলকাতার। স্থানীয় মানুষের ভিড়ও রয়েছে। আমরা সামনে একটি পুকুরের ধারে সমতল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে সতরঞ্জি পেতে জায়গা বুক করে ফেললাম। যতক্ষণ থাকবো এই জায়গায় অন্যের প্রবেশ নিষেধ। হ্যাঁ,এটাই নিয়ম।বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটি একটি করে দল।সকলেই পিকনিক করতে এসেছেন বিভিন্ন জায়গা থেকে।সাউন্ড বক্স নিয়ে গান, নাচ….চিৎকার… চেঁচামেচি… হই হুল্লোড়…
অযোধ্যা পাহাড় মানে সবুজের সমারোহ।পাহাড় শৃঙ্খল, আঁকাবাকা পথ উঠে গেছে পাহাড়ের বুক দিয়ে।লহরিয়া শিব মন্দির, লহরিয়া ড্যাম,লোয়ার ড্যাম,আপার ড্যাম,টুরগা ড্যাম,টুরগা ফলস্,বামনি ফলস্ আরও কত কি দেখার।এখানে জলকে ড্যাম বেঁধে রাখা হয়েছে।এখানে বিশেষ পদ্ধতিতে ইলেকট্রিক তৈরী হয়।যখন হাইডেল প্রজেক্ট তৈরী হচ্ছিল সেই সময় একবার এসেছিলাম। ঘুরে ঘুরে ফটো তোলা,কোথাও বসে বসে আপনমনে কবিতা লেখা……
রাস্তাটি খুব বিপজ্জনক বলে মনে হোলো।রাস্তা জমি থেকে পাহাড়ের বুক চিরে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে।যাওয়ার সময় ও নামার সময় খুব ভয় লাগবে।ভালো পাকা ড্রাইভার নিয়েই যাওয়া প্রয়োজন। আমার এক আত্মীয় নিজেই ড্রাইভার, পাকা ড্রাইভার যাকে বলে।উঠিয়ে ফেললো গাড়ি উপরে।আমি তখন বিভিন্ন দেবদেবীকে স্মরণে ব্যস্ত। চোখ বন্ধ করে ফেলেছি।মনে হচ্ছে জীবনের আজই শেষ দিন। হা হা হা…
উঠে গেছি অযোধ্যা হিল টপ- এ।সিরকাবাদ হয়েও একবার অযোধ্যা হিলটপ এসেছিলাম।সিরকাবাদ থেকে অযোধ্যা হিলটপ এর দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। এটি আমার দ্বিতীয় অযোধ্যা অভিযান।অযোধ্যা হিলটপে ভারত সেবাশ্রম সংঘের একটি সুন্দর শাখা রয়েছে,নজরে এলো। এখানে একটি দুর্গা মন্দির আছে।ঢুকলাম একটু প্রণাম করতে। চোখে পড়লো একটি বড় প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপটি দেখে আমার একটা কৌতূহল হোল।পুরোহিতকে বললাম বাহ্ প্রদীপটি বেশ বড়সড়।পুরোহিত তখন আমাকে বুঝে নিয়েছেন। বললেন এই প্রদীপ ১৯৭৯ থেকে অর্থাৎ ৩৯ বছর ধরে জ্বলছে এই অনির্বাণ শিখা।যে বছর আমরা গেছিলাম ২০১৮
বর্তমান হিসাব করলে দাঁড়াচ্ছে ৪৫ বছর।তাহলে এই অনির্বাণ শিখা ৪৫ বছর ধরে জ্বলছে।শীত বর্ষা গরম কত কিছু আবহাওয়ার সম্মুখীন হওয়ার পরেও এই প্রদীপ জ্বলছে এতো ঈশ্বরের অলৌকিক ইশারা !
যাঁরা যান অনেকেই প্রদীপ-এ এক শিশি ঘি ঢেলে আসেন বা দেন।কত কিছু আছে দেখার/ জানার…

পাশেই একটি মনসা মন্দির। পুরোহিত বললেন — আমরা এখানে দুধ রেখে দিই এক পাত্রে। সাপ গর্ত থেকে বের হয়, দুধ খেয়ে আবার গর্তে ঢুকে যায়।আমি এসকল তথ্য জানার জন্য অনেকক্ষণ থামলাম। এগুলো জানার/ দেখার কৌতূহল আমার খুব,বরাবরই। পাহাড়ের সব কিছু দেখে আমরা ফিরে এলাম নীচে। তারপর খাওয়া দাওয়া করে রাত্রে সিন্দরী চলে গেলাম।
অযোধ্যা পাহাড় যাওয়ার সময় আমি জায়গাগুলোর নাম লিখে রাখছিলাম কাগজে।আমি যেখানেই যাই কাগজ কলম সবসময়ই কাছেই থাকে।বড় সুন্দর সুন্দর নাম জায়গাগুলোর সিন্দরী,ঘোড়াবাঁধা,চড়িদা,বাঘমুণ্ডি,অযোধ্যা মোড়,
গোবিন্দপুর,আমতল,নীমতল,বহড়াতল,বাসুডি,
রেরেংটাঁড়,দুয়ারসিনী,মাঠা, ভুচুংডি, বাসীটাঁড়,দেওলী ডাভা, রসুলডি, হরপালডি, পাথরবাঁধ,রাঙ্গাডি প্রভৃতি ।ভুচুংডি মোড় থেকে পাখিপাহাড় যাওয়া যায়।
পাখিপাহাড়ের কথা আজ কারও অজানা নয়।বলরামপুর থেকে বাঘমুণ্ডি আসার পথে ভুচুংডি মোড় হয়ে পাখিপাহাড়ে যাওয়া যায়।এখানে ট্রেকিং করতে আসেন অনেকে। অযোধ্যা পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি হোল চেমটাবুরু।এমনকি দক্ষিণবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এই চেমটাবুরু।এখানেও ট্রেকিং করতে আসেন অনেকেই। অযোধ্যা পাহাড়ে দেখার আছে ময়ূর পাহাড়,ওয়াচ টাওয়ার,মার্বেল লেক প্রভৃতি।
এখানে “চড়িদা” সম্পর্কে দু’কথা বলা প্রয়োজন আছে।’চড়িদা’ গ্রামটি মুখোশ শিল্পীদের গ্রাম। প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে মুখোশ তৈরি হয়।ছৌ মুখোশ। পুরুলিয়ার ছৌ শিল্পীদের কথা সবাই জানেন।ছৌ নৃত্যের জন্য পুরুলিয়া জেলার নাম সবাই জানেন।শুধু দেশে নয় ছৌ-শিল্প ও ছৌ-নৃত্য এখন আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে।এই গ্রামের ছৌ- শিল্পী গম্ভীর সিং মুড়া ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর একটি মূর্ত্তি রয়েছে।
অযোধ্যা পাহাড়ের মধ্যে। মোট ৭৮ টি ছোট বড় গ্রাম রয়েছে।অনেকটা এলাকাজুড়ে অযোধ্যা পাহাড়।শুধু একটি পাহাড় তো নয়;পাহাড় শৃঙ্খল।

পাঠক-পাঠিকাদের সুবিধার জন্য একটি দূরত্ব তালিকা রাখলাম :—-
————————————-
*পুরুলিয়া-বলরামপুর ৩২ কিলোমিটার
*বরাবাজার- বলরামপুর ১৭ কিলো মিটার
*বলরামপুর-বাঘমুণ্ডি ২৬ কিলোমিটার
*বলরামপুর- অযোধ্যা পাহাড় ৩৮ কিলোমিটার
*বাঘমুণ্ডি- সিন্দরী ৫। কিলোমিটার
*অযোধ্যা মোড়-সিন্দরী ৬ কিলোমিটার
*বরাবাজার- সরবেড়িয়া ১৩ কিলোমিটার

পাঠক গণ এর উদ্দেশ্যে:

পত্রিকার স্বার্থে লেখা পছন্দ হলে কমেন্ট ও শেয়ার করতে অনুরোধ করছি। আপনিও লেখা পাঠাতে পারেন নিম্নোক্ত ঠিকানায়:

kabyapot@gmail.com

WhatsApp: 8100481677

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *