কোলে
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
হাসপাতাল মর্গের সামনে ভোদোভাই তার দেড় বছরেরর নাতিটাকে নিয়ে বসে আছে ভোরবেলায় নিউমনিয়ায় মৃত, তার উনিশ বছরের একমাত্র সন্তান জরিনার মৃতদেহ নিতে। বাড়ীতে তার স্ত্রী শয্যাসায়ী, সঙ্গে এসেছে তার শ্বশুর আশি বছরের বৃদ্ধ সাদেক গাজী। নাতিটা ভীষণ কাঁদছে। তাকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। পাপ দিয়ে পাঁচিলের ওপারে রাস্তা ধরে কিছু লোক মিছিল করে শ্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে — হিন্দী, হিন্দু, হিন্দুস্থান, উচ্চে রহে হামারা নিশান।
ঠিক সেই সময় এক শাখা সিঁদুর পরা মা তাঁর গর্ভবতী পুত্রবধূকে দেখাতে গাইনী ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছেন। বাচ্চাটাকে ঐভাবে কাঁদতে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে ওকে কোলে তুলে নিলেন। সামান্য একটু নাচানোর পর কান্না থেমে গেল। ভোদো ভাই-এর শ্বশুর জামাইটিকে বলে উঠলো– বুঝলে বাব, মায়ের কোন জাত হয় না, মায়ের কখনো মরণ হয় না। সব মায়ের কোলই এক।
আঁৎকে উঠে ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন —
–হঠাৎ মরণের কথা বললেন কেন চাচাজী?
–মা, আমাদের কপাল পুড়েছে। ওটা আমার পো নাতি। আমার নাতনিটা এই লাস ঘরে। তাই তার লাশ নিতে আইছি।
ভদ্রমহিলার চোখে জল। মেয়েকে বললেন–
–মামন, বৌদিকে নিয়ে ওয়ার্ডে গিয়ে নাম লেখা। একটু বাদেই আমি যাচ্ছি।
ওরা চলে গেল। বাচ্চাটিকে কোলে নাচাতে নাচাতে এখানকার চত্বরে ফুটে থাকা গোলাপ-গন্ধরাজ-কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে উনি আঙুল তুলে দেখাতে থাকেন–
ওই দেখো সোনা! কত ফুল পাঁপড়ি! তুমি কিন্তু একটুও কাঁদবে না। তোমার মা আজ ভোরে ফুল হয়ে ঐ বাগানে ফুটে আছে নিঃশব্দে নিঃসাড়ে।
সে ভাষার অর্থ ও কি বুঝলো কে জানে? অবোধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে শিশিরে-নবরাগে ধোয়া হাল্কা বাতাসে দোলখাওয়া কলিদের দিকে।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত