‘বিঞ্জানী বিনি’ কল্প বিজ্ঞান সিরিজের একটি গল্প…..
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অভিযান
মনোরঞ্জন ঘোষাল
আজ মার্কিন মুলুকের ফ্লোরিডাতে ওয়ার্ল্ড সায়েন্স কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান করতে এসেছি। পরিকল্পনা করে রেখে ছিলাম এখানের অধিবেশন শেষ করে ক্যারিবিয়ান মুলুকে যাব। কিউবাতে আমার এক বন্ধু থাকেন। সেখানে পরে আসব। তার আগে সান জুয়ানে যাব। সেখান থেকে জামাইকা আর শেষে কিউবা হয়ে আবার এই ফ্লোরিডাতে ফিরব। এখানে ফিরে তার দু দিন পর দেশে ফিরব। ইচ্ছা ছিল অতলান্তিক সাগরের উপর দিয়ে উড়ে সান জুয়ানে যাব। এখানের বারমুডা রহস্যটি যে কী? তা একবার প্রত্যক্ষ করার মন বাসনা জেগেছে। বিমান চালকের সঙ্গে সেই মত কথা বলে নিতে গিয়ে বেধে গেল ঝামেলা। চালক মহাশয় ঐ পথে উড়ান চালাবে না। বললে-“ ও পথে গেলে কেউ আর ফেরে না!”
সে আমাকে মেক্সিকো উপসাগরের উপর দিয়ে কিউবার পথে নিয়ে যেতে চাইল। আমি বুঝলাম ওকে নিয়ে তাহলে বারমুডা অভিযান করা যাবে না। ওর মনে সেই অভিযান করার মত সাহস নেই। ওর নিজের প্রাণের ভয় বেশি। তা সবার হয়। ছেলে পুলে স্ত্রী সংসার নিয়ে সকলেই সুখে থাকতে চায়। ভূতের কিল খেতে কেই বা চাইবে? তাই ঠিক করলাম কিউবা, জামাইকা বা পুয়ের্তো রিকোর কোন বিমান চালককে রাজি করান যায় কী দেখি। তাই তার কথা মত আমার যাত্রা মেক্সিকো উপসাগরের উপর দিয়ে গিয়ে কিউবা থেকে শুরু করলাম। আগে থেকেই আমার গন্তব্য স্থল গুলিতে আমি খবর পাঠিয়ে দিলাম। তারা সেই মত আয়োজন করে রাখবে বলে আমাকে জানিয়েছে।
ফ্লোরিডার ম্যারাথন ইন্টার ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে আমেরিকান সময় সকাল সাড়ে এগারোটা এরোপ্লেনে চাপলাম কিউবা যাবার উদ্দেশ্যে।
ফ্লোরিডা থেকে কিউবা যেতে এক ঘন্টা চব্বিশ মিনিট সময় লাগে প্লেনে। আমার সিটে গিয়ে আমি বসেছি। দেখি সেই ছেলেটিও আমার পাশের সিটে এসে বসে পড়ল। আমি দেখেছি যখন আমার সঙ্গে চালকের কথা হচ্ছিল তখন ঐ ছেলেটি সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আমি সে নিয়ে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। একবার শুধু ভাল করে ওর দিকে তাকালাম। ঠিক তখন ও আমাকে ওর ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল-“আমি বরিস শান্তিয়াগো লাতিন আমেরিকান এক জন ভূ পর্যটক। বারমুডা যাবার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। আপনার মত আমিও কোন চালককে সেখানে যাবার জন্য রাজি করাতে পারি নি। আপনি ঐ বিষয়ে এই চালকের সঙ্গে কথা বলছিলেন শুনে একটা আশায় ওখানে দাঁড়িয়ে আপনাদের কথা শুনছিলাম। শুনলাম আপনাকেও বিমুখ হতে হল”।
দেখলাম ছেলেটি আমার অ পরিচিত হলেও আমাকে বেশ আপন করে নেবার মত কথা বলছে। শুনে খুব ভাল লাগছে। কেমন যেন তাকে পরিচিত পরিচিত বলে মনে হল তখন।
আমি তখন তার মুখের ওপর বলে ফেললাম –“আমি কিন্তু এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নই। এখানে হয় নি তো কী হয়েছে? অন্য কোথাও কাউকে সঙ্গে পেয়ে যাব”।
আমার কথা শুনে শান্তিয়াগো মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার পর বলল-“ একটা কথা বলব? যদি কিছু মনে না করেন”।
আমি একটু মজার ছলে বললাম-“ তা বলেই ফেলো? কিচ্ছু মনে করব না। আর মনে করলেও কিচ্ছু বলব না”।
বরিস এক গাল হেসে বলল-“আমাকে আপনি বারমুডা অভিযানের সঙ্গী করবেন?”
সে কথার উত্তর দিতে আমি সময় নিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলাম “হ্যাঁ”। “কিন্তু বুঝতেই তো পারছ! এখনো কি ভাবে যাব? কে নিয়ে যাবে? আর কোথা থেকেই বা যাব? তার কোন কিছুই ঠিক নেই। তাই তোমাকে পাব কোথা থেকে?”
“আমি এই আপনার সঙ্গে চললাম। আপনি যেখানে যেখানে যাবেন আমিও সেখানে সেখানে যাব”। বলল বরিস।
“তা বেশ। তাহলে চল। একটা সঙ্গী তবু সঙ্গে থাকুক”। বলে আমি সেই আলোচনা আর বাড়ালাম না।
ও ওর নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে লাগল। আমি চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকলাম।
বরিস অল্প বয়সী ছেলে। অন্তত আমার থেকে কুড়ি বছর বয়সে ছোট হবে। কলেজ শেষ করে পর্যটক হয়ে পড়েছে। তার অভিযান গুলি লিখে এক পর্যটক ম্যাগাজিনে প্রকাশ করে। তারাই ওর খরচ খরচা সব দেয়। ও আমার কাছে বারমুডার প্রতি আমার আকর্ষণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইল। আরো বলল আমি বারমুডা সম্পর্কে যতটুকু যা জানি সেই কথা বলতে। ও সে কথা ওর নোট বুকে লিখে রাখবে।
কথায় কথায় সময় কেটে যাবে বলে আমি বলতে শুরু করলাম। “ বারমুডা সম্পর্কে আমার বিশেষ তেমন জ্ঞান নেই। তবে এই কথাটা চলে আসছে অনেক দিন থেকে। বারমুডা অঞ্চলে নাকি জাহাজ, নৌকা বা আকাশ পথে যাওয়ার সময় উড়ো জাহাজ রহস্য জনক ভাবে উধাও হয়ে যায়। খোঁজ-খবর নাকি আর পাওয়া যায় না। এই রহস্যের ব্যাপারটা কী? আমার মনে তা নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে তার নিরসনের জন্য আমার এই অভিযান করা।
আমি যত টুকু জানি তা হল এই যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল হলো আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাংশে ত্রিভুজ আকৃতির একটি বিশেষ অঞ্চল। এর এক কোণে বারমুডা দ্বীপ আর অন্য দুই প্রান্ত বিন্দুতে রয়েছে মিয়ামি বিচ ও পুয়ের্তো রিকোর সান জুয়ানে।
সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ঐ অঞ্চলে ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচটি টি ভি এম অ্যাভেঞ্জার উড়ো জাহাজ এবং একটি উদ্ধারকারী উড়ো জাহাজ রহস্য জনক ভাবে উধাও হয়ে যায়। সেই থেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্য কথাটার চল শুরু হয় বলে সকলের ধারণা। এর পরও বেশ কিছু জাহাজ ও উড়ো জাহাজ সেখানে নিখোঁজ হয়েছে। তবে নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎসগুলো বলে এর মধ্যে কোনো রহস্য নেই। কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে বটে। ওগুলো নিছক দুর্ঘটনাই। ওই এলাকা দিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে প্রচুর জাহাজ চলাচল করে। উড়ো জাহাজের যাতায়াতও খুব বেশি। এ রকম এলাকায় মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। সেটা তাদের চিন্তার বাহিরে হলে অনেকে তার মধ্যে রহস্যের গন্ধ খোঁজে। আবার এর মধ্যে রহস্যের কিছু নেই বলে অনেকেই মনে করেন।
ওই অঞ্চলে কম্পাসের কাঁটা নাকি চুম্বকীয় উত্তর মেরু নির্দেশ করে যা ভৌগোলিক উত্তর মেরু থেকে প্রায় ১১০০ মাইল দূরে। ক্যারিবীয় অঞ্চলে এই পার্থক্য কম্পাসের কাঁটায় প্রায় ২০ ডিগ্রীর মত। জাহাজ বা এরোপ্লেন চালানোর সময় এই পার্থক্য, হিসাবে রাখা হয়। যদি কোনো কারণে ভুল হয় তাহলে নানা বিপত্তি ঘটে যেতে পারে। তা ছাড়া ওই এলাকায় উপসাগরীয় স্রোত ধারার প্রবল ঢেউয়ের উপদ্রব বেশি, আছে ভয়ংকর টর্নেডো ও তার ঝড় ঝাপটা। এ সবের পাল্লায় পড়লে আকস্মিক দুর্ঘটনার প্রকোপ একটু বেশি মনে হতেই পারে। তাই মনে হয় ওই এলাকাটাই রহস্য জনক। বিপদের একটি আখড়া। কিন্তু বহু বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওসব কথার ভিত্তি নেই। যদি তাই হত, তাহলে ওই এলাকা দিয়ে চলাচল কারী জাহাজ উড়ো জাহাজের বিমার হার অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি হত। অথচ সেখানে বাড়তি বিমা তো আরোপ করা হয় না! বিমা কোম্পানি গুলো যা হিসেবি, তাতে ওরা রহস্যের সন্ধান পেলে বিমার হার অবশ্যই বাড়িয়ে ধরত। ওরা এই সব বিষয়ে অন্য সবার থেকে আলাদা।
আসল কথা হলো পত্র পত্রিকা ও অন্যান্য গণ মাধ্যম স্বভাবতই রহস্য বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বেশি আগ্রহী। একটু গন্ধ পেলেই তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলে মজাদার কাহিনী বানিয়ে ফেলে। গাদা গাদা রহস্য উপন্যাসও বেরিয়েছে এই বারমুডাকে নিয়ে। কিন্তু এ সবের পেছনে তেমন সত্যতা নেই বলে অনেকেই বলেন। তবু কেউ মানতে চায় না যে এখানে রহস্যের কিছু নেই!”
ও আমার কথা বলা শুনে আর চুপ থাকতে পারল না। নিজেই বক বক করে বলতে শুরু করল। বোধহয় ওর বিষয়ের ওপর একটা আকর্ষণ গড়ে উঠেছে। জ্ঞান জাহির করা হয়তো না। হয়তো তার জানা কাহিনী ঝালাই করে নিতে চাইছে। তাই ওর বলাতে আমি বাধা দিলাম না। ও বলতে থাকল-
“আসলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল যা শয়তানের ত্রিভুজ নামেও পরিচিত। এটি অতলান্তিক মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চল, যেখানে বেশ কিছু জাহাজ ও উড়ো জাহাজ রহস্য জনক ভাবে নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয়। অনেকে মনে করেন ঐ সকল ঘটনার কারণ নিছক দুর্ঘটনা, যার কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা চালকের অসাবধানতা। আবার এটিকে নিয়ে একটি উপকথাও প্রচলিত আছে। সেই চলতি উপকথা অনুসারে মনে করা হয় এ সবের পেছনে দায়ী হল কোন অতি প্রাকৃতিক শক্তির উপস্থিতি! তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সাজানো রয়েছে যে, যে সব দুর্ঘটনার উপর ভিত্তি করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার বেশ কিছু ভুল রয়েছে, আর কিছু লেখক দ্বারা অতি রঞ্জিত হয়েছে এমন কি কিছু দুর্ঘটনার সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের দুর্ঘটনার কোনই পার্থক্য নেই। একেবারে সাধারণ মত।
নানা সময়ের বিভিন্ন লেখকের বর্ণনায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের বিস্তৃতিতে মত পার্থক্য দেখা দিয়েছে। এই ত্রিভূজের উপর দিয়ে মেক্সিকো উপসাগর থেকে উষ্ণ সমুদ্র স্রোত বয়ে চলেছে। এই তীব্র গতির স্রোতই মূলত অধিকাংশ যানের অন্তর্ধানের কারণ বলে অনেকে মনে করেন। এখানকার আবহাওয়া এমন যে হঠাৎ করে ঝড় ওঠে আবার থেমে যায়, গ্রীষ্মে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বিংশ শতাব্দীতে যখন টেলি যোগাযোগ, রাডার ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ঠিক মত সব জায়গাতে পৌঁছায় নি তার আগে এমন অঞ্চলে জাহাজ ডুবি ছিল একটা নিরন্তর ঘটনা। সেখানে উড়ো জাহাজ বা জল জাহাজ নিখোঁজ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা হিসাবে চালু ছিল। এই অঞ্চলটি মার্কিন মুলুকের ফ্লোরিডা দিকটা, মেক্সিকো, কিউবা, জামাইকার ভারী পন্যবাহি জাহাজ গুলো এখান দিয়েই বেশি যাওয়া আসা করে। তাই এই অঞ্চল বিশ্বের ভারী বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল কারী পথগুলোর অন্যতম। কিন্তু বিশেষ একটি স্থানকে ওরা হিসাবে বাদ রেখে চলাচল করে। জাহাজগুলো আমেরিকা, য়ুরোপ, ক্যারিবিয়ান দ্বীপ গুলিতে যাতায়াত করে। এ ছাড়া এটি হল প্রচুর আমোদ প্রমোদ তরীর বিচারণ ক্ষেত্র। এ অঞ্চলের আকাশ পথে বিভিন্ন রুটে বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত বিমান চলাচল করে। অনেকে এটিকে ত্রিভুজ বলে মানতে চায় না। তাই এই ত্রিভূজের বিস্তৃতির বর্ণনায় বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন মত দিয়েছেন। কেউ মনে করেন এর আকার ট্রাপিজিয়ামের মত, যা ছড়িয়ে আছে ফ্লোরিডা, বাহামা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপ পুঞ্জ ও তার পূর্ব দিকের আটলান্টিক মহাসাগরের অঞ্চল জুড়ে। আবার কেউ কেউ এগুলোর সঙ্গে মেক্সিকো উপসাগরকে যুক্ত করেন। তবে কিছু কিছু লিখিত বর্ণনায় যে সাধারণ অঞ্চলের ছবি ফুটে ওঠে তাতে রয়েছে ফ্লোরিডার আটলান্টিক উপকূল, পুয়ের্তো রিকো, মধ্য আটলান্টিকের বারমুডা দ্বীপ পুঞ্জ এবং বাহামা ও ফ্লোরিডা স্ট্রেইটস এর দক্ষিণ সীমানা সেখানেই ঘটেছে অধিকাংশ দুর্ঘটনা। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বিষয়ে যারা লিখেছেন তাদের মতে ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম এই ত্রিভুজ বিষয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে তার জাহাজের নাবিকেরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি, সঙ্গে আকাশে প্রচুর ধোঁয়া দেখেছিলেন। এ ছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টোপাল্টা দিক নির্দেশনার কথাও বর্ণনা করেছেন। ১৩ই অক্টোবর, ১৪৯২ তে তার লগ বুকে লেখেন –“triangle means the residence of devil!”
বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা প্রকৃত লগ বুক পরীক্ষা করে যে মত দিয়েছেন তার সারমর্ম হল এই যে – ‘নাবিকেরা যে আলো দেখেছেন তা হল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত নৌকায় রান্নার কাজের আগুন। আর সেই আগুন থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ধোঁয়া।
কম্পাসে সমস্যা সৃষ্টি হয়ে ছিল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে। ১৯৫০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ই. ভি. ডব্লিউ. জোন্স সর্বপ্রথম এ ত্রিভুজ নিয়ে খবরের কাগজে লেখেন। এর দু বছর পর ফেট ম্যাগাজিনে জর্জ এক্স. স্যান্ড “সী মিস্ট্রি এট আওয়ার ব্যাক ডোর” শিরোনামে একটি ছোট প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি ফ্লাইট নাইনটিন ইউ এস নেভী-র পাঁচটি ‘টি বি এম অ্যাভেঞ্জার’ বিমানের একটি দল, যা প্রশিক্ষণ মিশনে গিয়ে নিখোঁজ হয়। এর নিরুদ্দেশ কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তিনিই প্রথম এই অপরিচিত ত্রিভূজাকার অঞ্চলের কথা সবার সামনে তুলে ধরেন।
১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে ফ্লাইট নাইনটিন নিয়ে আমেরিকান লিজন ম্যাগাজিনে লেখা বের হয়। বলা হয়ে থাকে এই ফ্লাইটের দলপতি কে নাকি বলতে শোনা গিয়েছিল- “We don’t know where we are, the water is green, no white!” এর অর্থ হল “আমরা কোথায় আছি জানি না, সবুজ বর্ণের জল, কোথাও সাদা কিছু নেই”। এই ঘটনা টিতেই প্রথম ফ্লাইট নাইনটিনকে কোন অতি প্রাকৃতিক ঘটনার সাথে যুক্ত করা হয়। এরপর ভিনসেন্ট গডিস “প্রাণঘাতী বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল” নামে আর এক কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর উপর ভিত্তি করেই তিনি আরও বিস্তর বর্ণনা সহকারে লেখেন “ইনভিজিবল হরাইজন” মানে “অদৃশ্য দিগন্ত” নামের একটি বই। আরও অনেক লেখকই নিজ নিজ মনের মাধুরী মিলিয়ে এই বিষয়ে বই লিখেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জন ওয়ালেস স্পেন্সর, তিনি লিখেছেন “লিম্বো অফ দ্য লস্ট”, মানে “বিস্মৃত অন্তর্ধান” ; চার্লস বার্লিজ লিখেছেন “দি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল”; রিচার্ড উইনার লিখেছেন “দ্য ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গেল” “শয়তানের ত্রিভুজ” নামের বই। এ ছাড়া আরও অনেকেই লিখেছেন। এরা সবাই ঘুরে ফিরে ‘একার্ট’ দ্বারা বর্ণিত অতি প্রাকৃতিক ঘটনাই বিভিন্ন স্বাদে উপস্থাপন করে পরিবেশন করেছেন। এই বিষয়ে
কুস্চ এর ব্যাখ্যা যথার্থ গুরুত্বপূর্ণ বলে অনেকে মনে করেন”।
ভেবে ছিলাম ও হয়তো কুস্চ সম্পর্কে আর কিছু বলবে না। তাই আমি মুখ খুলতে যাব কী ও আবার বলতে শুরু করল।
“লরেন্স ডেভিড কুস্চ হলেন “অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি”-র রিসার্চ লাইব্রেরিয়ান এবং “ দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মিস্ট্রি সলভড (১৯৭৫)” এর লেখক। তাঁর গবেষণায় তিনি চার্লস বার্লিজ এর বর্ণনার সাথে প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বর্ণনার অসংগতি তুলে ধরেন। যেমন- যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকার পরেও বার্লিজ বিখ্যাত ইয়টসম্যান ডোনাল্ড ক্রোহার্ট এর অন্তর্ধানকে বর্ণনা করেছেন রহস্য হিসেবে। আরও একটি উদাহরণ হল- আটলান্টিকের এক বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়ার তিন দিন পরে একটি আকরিকবাহী জাহাজের নিখোঁজ হবার কথা বার্লিজ বর্ণনা করেছেন, আবার অন্য এক স্থানে একই জাহাজের কথা বর্ণনা করে বলেছেন সেটি নাকি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বন্দর থেকে ছাড়ার পর নিখোঁজ হয়েছিল! এ ছাড়াও কুস্চ দেখান যে বর্ণিত দুর্ঘটনার একটি বড় অংশই ঘটেছে কথিত ত্রিভূজের সীমানার বাইরে। কুস্চ এর গবেষণা ছিল খুবই সাধারন ভাবের। তিনি শুধু লেখকদের বর্ণনায় বিভিন্ন দুর্ঘটনার তারিখ, সময় ইত্যাদি অনুযায়ী সে সময়ের খবরের কাগজ থেকে আবহাওয়ার খবর আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন যা গল্পে লেখকরা বলেন নি। কুস্চ –এর গবেষণায় যা পাওয়া যায় তা হল-
“বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে যে পরিমাণ জাহাজ ও উড়ো জাহাজ নিখোঁজ হওয়ায় কথা বলা হয় তার পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য সমুদ্রের তুলনায় মোটেও বেশি নয়।
এ অঞ্চলে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় নিয়মিত আঘাত হানে, যা জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু বার্লিজ বা অন্য লেখকেরা এ ধরনের ঝড়ের কথা অনেক অংশেই এড়িয়ে গিয়েছেন।
অনেক ঘটনার বর্ণনাতেই লেখকেরা কল্পনার রং চড়িয়েছেন। আবার কোন নৌকা নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে দেরিতে বন্দরে এসে উপস্থিত হলে তাকে নিখোঁজ বলে প্রচার করা হয়েছে।
আবার কখনোই ঘটেনি এমন অনেক ঘটনার কথা লেখকেরা বলেছেন। যেমন- ১৯৩৭ সালে ফ্লোরিডার ডেটোনা সমুদ্র তীরে একটি বিমান দুর্ঘটনার কথা বলা হয়, কিন্তু সেই সময়ের খবরের কাগজ থেকে এ বিষয়ে কোন তথ্যই পাওয়া যায় নি”।
সুতরাং কুস্চ –এর গবেষণার উপসংহারে বলা যায়- “লেখকেরা বিষয় সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার কারণে অথবা ইচ্ছাকৃত ভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে মন গড়া রহস্য তৈরি করেছেন’।
এই বিষয়ে আরো অনেকে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন যেমন-
মেরিন বিমা কোম্পানি “লয়েড’স অব লন্ডন” বলেছে যে , এই ত্রিভুজে অন্য সমুদ্রের চেয়ে উল্লেখ্য করবার মত ভয়ংকর কিছু নেই। তাই তারা এই অঞ্চল দিয়ে গমন কারী কোন জাহাজের উপর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাশুল আদায় করে না। যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড লেখকদের বর্ণনার উপর ব্যাপক অনুসন্ধানের পর অনুমোদন করেছে যে এই অঞ্চলে অস্বাভাবিক কিছু নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ১৯৭২ সালে ভি এ ফগ নামের একটি ট্যাঙ্কার মেক্সিকো উপসাগরে বিস্ফোরণের পর ডুবে যায়। কোস্ট গার্ডরা সেই বিধ্বস্ত ট্যাঙ্কারের ছবি তোলেন এবং বেশ কিছু মৃত দেহও উদ্ধার করেন। কিন্তু কতিপয় লেখক বলেছেন নাকি ঐ ট্যাঙ্কারের সব আরোহী অদৃশ্য হয়ে গিয়ে ছিলেন, শুধুমাত্র এর ক্যাপ্টেন কে তার কেবিনের টেবিলে হাতে কফির মগ ধরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল! টিভি সিরিয়াল এর “ দ্য কেস অব দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল (১৯৭৬-০৬-২৭)” পর্বে বলা হয়েছিল যে , যে সব দুর্ঘটনার কথা বলা হয় সেগুলো মনগড়া ও ভিত্তিহীন। সংশয়বাদী গবেষকগণ, যেমন আর্নেস্ট টেভস এবং ব্যারি সিঙ্গার দেখিয়ে ছিলেনন যে , মিথ্যে রহস্য তৈরি করা বেশ লাভ জনক। কারণ তখন ঐ মিথ্যে রহস্যের উপর ভিত্তি করে বই লিখে বা টি ভি তে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে প্রচুর অর্থ কামানো যায়।
আবার বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল টি কিছু স্থল ভাগের উপর দিয়েও গিয়েছে এমন দেখানো হয়। যেমন পুয়ের্তো রিকো, বাহামা এমন কি বারমুডার নিজেরই কিছু স্থল ভাগ আছে। কিন্তু এসব জায়গায় কোন স্থল যানের নিখোঁজ হবার খবর জানা যায় নি। এ ছাড়া এই ত্রিভূজের মধ্যে অবস্থিত ফ্রী পোর্ট শহরে বড় সড় জাহাজ কারখানা রয়েছে আর রয়েছে একটি বিমান বন্দর, যা কোন গোলযোগ ছাড়াই বছরে প্রায় ৫০,০০০ টি বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা করে চলেছে ঐ পথে।
এই অঞ্চলে জাহাজ ডুবি কে কেন্দ্র করে বেশ কিছু কারণ কে দায়ী করা হয়ে থাকে। যেমন-
১। কন্টিনেন্টাল সেলভে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ মিথেন হাইড্রেট অনেক জাহাজ ডোবার কারণ বলে মনে করেন অনেকে। অস্ট্রেলিয়ার পরীক্ষাগারের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বাতাসের বুদবুদ জলের ঘনত্ব কমিয়ে দিয়ে থাকে। তাই সাগরে যখন পর্যায়ক্রমিক ভাবে মিথেন উদগীরন হয়, তখন জলের প্লবতা(জলে কোন কিছুকে ভাসিয়ে রাখার ক্ষমতা) কমে । যদি এমন ঘটনা ঐ এলাকায় ঘটে থাকে তবে সতর্ক হবার আগেই কোন জাহাজ দ্রুত ডুবে যেতে পারে।
১৯৮১ সালে “ ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে” একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যাতে বর্ণিত আছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ উপকূলের বিপরীতে “ব্লেক রিজ” এলাকায় মিথেন হাইড্রেট যথেষ্ট পরিমানে রয়েছে। আবার ইউ এস জি এস(ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে) এর ওয়েব পৃষ্ঠা থেকে জানা যায়, গত ১৫০০ বছরের মধ্যে ঐ এলাকায় তেমন হাইড্রেট গ্যাসের উদগীরন ঘটেনি।
২। কম্পাসের ভুল দিক নির্দেশনা বা কম্পাসের পাঠ নিয়ে যে বিভ্রান্তি তা অনেক অংশে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাহিনীর সঙ্গে জড়িত। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে কম্পাস থেকে চুম্বক মেরুর দূরত্বের উপর ভিত্তি করে এর দিক নির্দেশনায় বিচ্যুতি আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র উইসকনসিন থেকে মেক্সিকো উপসাগর পর্যন্ত সরল রেখা বরাবর চৌম্বকের উত্তর মেরু সঠিক ভাবে ভৌগোলিক উত্তর মেরুকে নির্দেশ করে। এই সাধারণ তথ্য যে কোন দক্ষ পথ প্রদর্শকের জানা থাকার কথা। কিন্তু সমস্যা হল সাধারণ মানুষকে নিয়ে, যারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না। ঐ ত্রিভুজ এলাকা জুড়ে কম্পাসের এমন বিচ্যুতি তাদের কাছে রহস্যময় মনে হয়। কিন্তু এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা।
৩। তার ওপর আছে হারিকেনের দাপট! অনেক জাহাজ ডুবিতে হারিকেন কেই দায়ী করা হয়। হারিকেন হল শক্তিশালী ঝড়। ঐতিহাসিক ভাবেও এর বর্ণনা আছে। সেখান থেকেও জানা যায় আটলান্টিক মহাসাগরে বিষুব রেখার কাছাকাছি অঞ্চলে শক্তিশালী হারিকেনের কারণে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে, আর ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি । রেকর্ড অনুসারে ১৫২০ সালে স্প্যানিস নৌবহর “ফ্রান্সিসকো দ্য বোবাডিলা” এমনি একটি বিধ্বংসী হারিকেনের কবলে পড়ে ডুবে যায়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাহিনীর সাথে জড়িত অনেক ঘটনার জন্য এ ধরনের হারিকেন অনেক ক্ষেত্রে দায়ী।
৪। আরো একটি মতকে জাহাজ ডুবির জন্য কারণ হিসাবে গণ্য করা হয়। তা হল “গলফ স্ট্রিম মতবাদ”। গলফ স্ট্রিম মতবাদ হল মেক্সিকো উপসাগর থেকে
স্ট্রেইটস অব ফ্লোরিডা হয়ে উত্তর আটলান্টিকের দিকে প্রবাহিত হওয়া উষ্ণ সমুদ্র স্রোত। একে বলা যেতে পারে মহা সমুদ্রের মাঝে এক প্রবাহ মান নদী। নদীর স্রোতের মত গলফ স্ট্রিম ভাসমান বস্তু কে স্রোতের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বর “ উইচক্রাফট” নামের একটি প্রমোদ তরীতে। মিয়ামির তীর হতে এক মাইল দূরে এর ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলে তার নাবিকরা তাদের অবস্থান কোস্ট গার্ডকে জানায়। কিন্তু কোস্ট গার্ডরা তাদেরকে ঐ নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে আর খুঁজে পায়নি।
৫। অনেক জাহাজ ডুবিতে দৈত্যাকার ঢেউকে কারণ বলে মনে করা হয়। অনেক জাহাজ এবং বিমান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার তদন্তে দেখা গিয়েছে এগুলির অধিকাংশই ঘটেছে চালকের ভুলের কারণে। তারা নিজেদের ভুলেই দুর্ঘটনার কবলে পতিত হয়েছে। মানুষের ভুল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, আর এমনি ভুলের কারণে দুর্ঘটনা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলেও ঘটতে পারে। যেমন কোস্ট গার্ড ১৯৭২ সালে ভি এ ফগ এর নিখোঁজ হবার কারণ হিসেবে বেঞ্জিন এর পরিত্যক্ত অংশ অপসারণের জন্য দক্ষ শ্রমিকের অভাব কেই দায়ী করেছেন। সম্ভবত ব্যবসায়ী হার্ভি কোনভার এর ইয়ট টি তার অসাবধানতার কারণেই নিখোঁজ হয়। অনেক নিখোঁজ ঘটনারই উপসংহারে পৌঁছান যায় নি, কারণ অনুসন্ধানের জন্য তাদের কোন ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি!
৬। ইচ্ছাকৃত ভাবে বেশ কিছু জাহাজ ধ্বংস করা হয়েছে। যুদ্ধের সময় অনেক জাহাজ শত্রু পক্ষের অতর্কিত আক্রমণে ডুবে গিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হয়। এ কারণেও জাহাজ নিখোঁজ হতে পারে। তবে বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু জাহাজ, যাদের মনে করা হয় এমনি কারণে ডুবেছে, তাদের উপর অনুসন্ধান করা হয়। তবে শত্রু পক্ষের নথিপত্র, নির্দেশনার লগ বই ইত্যাদি পরীক্ষা করে তেমন কিছু প্রমাণ করা যায়নি। যেমন- মনে করা হয় ১৯১৮ সালে ইউ এস এস সাইক্লপস এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিস্টার শিপ প্রোটিউ এবং নিরিয়াস কে জার্মান ডুবোজাহাজ ডুবিয়ে দেয়। যদিও পরবর্তীতে জার্মান রেকর্ড থেকে তার সত্যতা প্রমাণ করা যায় নি।
আবার ধারণা করা হয় জল দস্যুদের আক্রমণে অনেক জাহাজ নিখোঁজ হয়ে থাকতে পারে। সে সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাংশে এবং ভারত মহাসাগরে মাল বাহী জাহাজ চুরি হওয়া খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। মাদক চোরা চালান কারীরা সুবিধা মত জাহাজ, নৌকা, ইয়ট ইত্যাদি চুরি করত মাদক চোরা চালানের জন্য। ১৫৬০ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ছিল জল দস্যুদের আখড়া। কুখ্যাত জল দস্যু এডওয়ার্ড টিচ এবং জেন ল্যাফিট্টি ছিল ঐ অঞ্চলের বিভীষিকা। তবে শোনা যায় জেন ল্যাফিট্টি নিজেই নাকি এক সময় এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের শিকার হয়েছিল।
আর এক ধরনের দস্যু বৃত্তির কথা শোনা যায়, যা পরিচালিত হত স্থল ভাগ থেকে। এ ধরনের দস্যুরা সমুদ্র ধারে রাতে আলো জ্বালিয়ে জাহাজের নাবিকদের বিভ্রান্ত করত। নাবিকরা ঐ আলোকে বাতি ঘরের আলো মনে করে সে দিকে অগ্রসর হত। তখন জাহাজগুলি ডুবো পাহাড়ের সাথে সংঘর্ষে ডুবে যেত। আর তার পরে ডোবা জাহাজের মালপত্র তীরের দিকে ভেসে এলে দস্যুরা তা সংগ্রহ করত। হয়তো ডুবন্ত জাহাজে কোন নাবিক বেঁচে থাকলে দস্যুরা তাদেরকেও হত্যা করত!”
বরিসের বারমুডা সম্পর্কে জ্ঞান ও আগ্রহ শুনে আমি মুগ্ধ হলাম। বুঝলাম ও এখানে আসবে বলে একেবারে যথাযথ জ্ঞান সংগ্রহ করে এসেছে। আমি এই সব জেনে আসার প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে তার কাছে সব গল্প শুনতে বেশ ভাল লাগছে। আর মনে মনে আরো বেশি কিছু শোনার আগ্রহ জন্মাচ্ছে। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম। “ফ্লাইট নাইনটিন সম্পর্কে কিছু জানা থাকলে বলোতো শুনি?”
ও তখন আবার শুরু করল- “ফ্লাইট ১৯, ৫টি টি ভি এম আভেঞ্জার টর্পেডো বোমারু বিমানের একটি। যেটি প্রশিক্ষণ চলা কালে ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর আটলান্টিক মহাসাগরে নিখোঁজ হয়। বিমান বাহিনীর ফ্লাইট পরিকল্পনা ছিল ফোর্ট লডারদেল থেকে ১৪৫ মাইল পূর্বে এবং ৭৩ মাইল উত্তরে গিয়ে, ১৪০ মাইল ফিরে এসে প্রশিক্ষণ শেষ করা। বিমানটি সঠিক ভাবে অগ্রসর হয়ে আর ফিরে আসে নি। নেভি তদন্তকারীরা নেভিগেশন ভুলের কারণে বিমানের জ্বালানি শূন্য হয়ে যায় ও তাকেই বিমান নিখোঁজের কারণ বলে চিহ্নিত করেন। বিমানটি অনুসন্ধান এবং উদ্ধারের জন্য পাঠানো বিমানের মধ্যে একটি বিমান পি বি এম ম্যারিনা ১৩ জন ক্রু সহ নিখোঁজ হয়। ফ্লোরিডা উপকূল থাকা একটি ট্যাঙ্কার একটি বিস্ফোরণ দেখার রিপোর্ট করে। সেখানে ব্যাপক তেল দেখার কথা বলে কিন্তু উদ্ধার অভিযানে এর সত্যতা পাওয়া যায় নি। দুর্ঘটনা শেষে আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠে। সূত্র মতে, সমসাময়িক কালে বাষ্প লিকের কারণে পুরো জ্বালানি ভর্তি অবস্থায় তার বিস্ফোরণ ঘটার ইতিহাস বর্ণনা করা হয়ে ছিল!”
বলে সে তার কথা বন্ধ করে চুপ করে রহিল। আমি শুনে বেশ জ্ঞান সমৃদ্ধ হচ্ছিলাম। তা ছাড়া চুপ চাপ থাকাটা আজ আর ভাল লাগছে না। তাই তাকে বললাম-“আরো কিছু এই সম্পর্কে জানা থাকলে বল। শুনতে বেশ ভাল লাগছে”।
আমার বলার পর সে আবার বলতে শুরু করল-
“যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধ ছাড়া ক্ষতি হয়েছিল ইউ এস এস সাইক্লপস নিখোঁজ হয়ে যাওয়াতে। অতিরিক্ত ম্যাঙ্গানিজ আকরিক ভর্তি বিমানটি ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ বার্বাডোস দ্বীপ থেকে উড্ডয়নের পর এটির একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে এবং ৩০৯ জন ক্রুসহ নিখোঁজ হয়। যদিও কোন শক্ত প্রমাণ এই ঘটনার সপক্ষে নেই তবুও অনেক কাহিনী শোনা যায়। কারো মতে ঝড় দায়ী, কারো মত জলে ডুবে গেছে, আবার কেউ এই ক্ষতির জন্য শত্রুপক্ষকে দায়ী করে। উপরন্তু, সাইক্লপস-এর মত আর দুইটি ছোট জাহাজ প্রোটিউস এবং নেরেউস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলা কালীন সময়ে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে নিখোঁজ হয়। সাইক্লপসের মত এই জাহাজ দুটিতেও অতিরিক্ত আকরিক ভর্তি ছিল। তিনটি ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত মাল ধারণে অক্ষম ছিল ডিজাইন গত ভাবে তার কারণেই জাহাজ ডুবি হয় বলেই ধারণা করা হয়।
২৮ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে একটি ডগলাস ডি সি – ৩, ফ্লাইট নাম্বার এন সি ওয়ান সিক্স জিরো জিরো টু, সান জুয়ান, পুয়ের্তো রিকো থেকে মিয়ামি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়। বিমানে থাকা ৩২ জন সহ বিমানটির কোন হদিস পাওয়া যায়নি। সিভিল এরোনটিক্স বোর্ডের তদন্তের নথিপত্র থেকে বিমানটি নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাব্য একটি কারণ পাওয়া যায়, সেটি হল – বিমানের ব্যাটারি ঠিকমত চার্জ না করে পাইলট সান জুয়ান থেকে রওনা দেয়। কিন্তু এটা সত্যি কিনা তা জানা যায়নি”।
আমি ওর কথা বলার মাঝেই বললাম-“এ তো সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বলছ। আমিতো এই সবের কিছু কিছু আগে থেকেই শুনে রেখেছি। তবে এটিও শুনেছি যে এই ঘটনার সঙ্গে এলিয়েনের বেশ একটা যোগাযোগ আছে বলে অনেকেই মনে করেন। এক সময় বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও এই ঘটনা ঘটার সঙ্গে এলিয়েন জড়িত বলে ভাবনা শুরু করে ছিলেন।
বারমুডা রহস্যে অতি প্রাকৃতিক শক্তির একটা হাত অবশ্যই আছে। আর সেটা থাকা মোটেই অসম্ভব না বলে অনেকেই মনে করেন। সেই অতি প্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে এলিয়েন সম্পর্ক একটা চমকপ্রদ ধারণা বলেই গন্য হয় আজও। সে সম্পর্কে কিছু কী জানো? যদি জানা থাকে তাহলে বলতে পার?”
আমি বুঝেছিলাম ও এই বিষয়েও যথেষ্ট জ্ঞান সংগ্রহ করে রেখেছে। আমার কথা শুনে ও ওর বলা প্রসঙ্গটা বাদ রেখে এলিয়েন প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে শুরু করল-
“অনেকেই আজও মনে করেন যে ঐ অঞ্চলের সমুদ্রের তল দেশে এলিয়েন বসবাস করে। তাই ওদের বিশেষ রকমের তৈরী যান ছাড়া আর কিছুই সেখানে ঠিক ভাবে যেতে পারে না। অনেকেই সেখানে ইউ এফ ও এর আনাগোনার দর্শন পেয়েছে বলে দাবি করে। এই নিয়েও বহু মত পার্থক্য রয়েছে!”
বলে সে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে বলে মনে হল। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল ও আর কোন কথাই বলছে না। আমি ভাবলাম ওর কথা বোধহয় এখানেই শেষ হয়ে গেল। তাই বললাম- “এই টুকুতেই সব শেষ করে দিলে?”
ও বলল-
“না। মানে এই বিষয়ে আমার তেমন বিশেষ জ্ঞান নেই।“
বলে সে কথা শেষ করে দিলো।
ছেলেটি খুব সত্যবাদি এবং সৎ ও সাহসী। অকপটে আমার কাছে ওর অজ্ঞানতার কথা স্বীকার করে নিলো। ওর এই স্বভাব আমাকে মুগ্ধ করল। এখন তো দেখি সকলেই নিজেকে বিজ্ঞ দেখাতে ব্যাস্ত। সে যে কিস্যু জানে না তা মানতেই চায় না। যে কোন কথাতেই বানিয়ে বানিয়ে আবোল তাবোল তর্ক করে নিজেকে বিজ্ঞ জাহির করতে লেগে পড়বে। আরে বাবা সকলেই কী সব বিষয়ে পণ্ডিত হতে পারে? না হয়? এই কথাটা বলাতে সে কী ছোট হয়ে যায়? আমি তো তা মনে করি না। তবে ওরা আমাকে তো ওদের দলে নেয় না। তাই আমার কথা বাদ দাও।
ও আমাকে জিজ্ঞেস করল-“আপনার কী এই বিষয়ে কিছু জানা আছে?”
ওর এই প্রশ্ন করাতে বুঝলাম ওর ঐ বিষয়ে জানার আগ্রহ আছে। আমি কারো আগ্রহ নিরসন করতে খুব ভালবাসি। তবে যদি তার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা থাকে তো তাকে সেই উত্তর জানিয়ে দিই। এর ক্ষেত্রেও আমি তাই করলাম। বললাম-“অল্প কিছু জানি”।
-“তাহলে বলুন না? আমার জানার খুব আগ্রহ”। ও বলল।
ওর ব্যাকুলতা দেখে আমি বলতে শুরু করলাম-
“ মহাবিশ্বে কোথাও না কোথাও এলিয়েন আছে বলে অনেকেই মনে করেন। তবে তা কেউ আজ পর্যন্ত চোখে দ্যাখে নি বলে প্রকাশ করেন। যদিও আমি তাদের সচক্ষে একবার নয় বহু বার দেখেছি। তবে ঐ বারমুডাতে তাদের কোন আস্তানা আছে কি তা বলতে পারবো না। তবে অনেকে ইউ এফ ও দেখেছে এবং ঐ অঞ্চলেও দেখেছে বলে দাবি করেন। ইউ এফ ও এর ফুল ফর্ম জানো তো? ইউ এফ ও এর ফুল ফর্ম হল আন আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট আসলে অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তু বা সংক্ষেপে ইউ এফ ও, এমন একটি উড়ন্ত বস্তু যা সেটির প্রত্যক্ষদর্শী দ্বারা এবং তদন্ত করার পরেও শনাক্ত করা যায় না। আসলে শনাক্ত করাটা সহজ কাজ নয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, আকাশে দৃশ্যমান যে কোনো অচেনা অজানা বস্তু বা আলোকেই ইউ এফ ও বলা হয়। এই সংজ্ঞা অনুসারে উড়ন্ত আকাশ বস্তুকে, একটি ইউ এফ ও বিমান হিসেবে শ্রেণী ভুক্ত করা যায়, যেটি এর পরিচয় দেওয়ার পূর্বেই বিমান নিয়ন্ত্রণকারী রেডার গুলোতে হঠাৎ আবির্ভূত হতে দেখতে পাওয়া যায় এবং উধাও হয়েও যায়। যাই হোক, সাধারণ ভাষায় ও কল্পনায় অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তু বলতে বোঝায় ভিন গ্রহ হতে আগত জীবের যান। এগুলি উড়ন্ত উল্টো করা চাকতি বা প্লেটের মত দেখা যায় বলে প্রকাশিত হয়। মোটামুটি ১৯৪০-১৯৯০ এর দশক গুলোতে এই বিষয়টি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে ছিল। কারণ যে সব অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তু আকাশে দেখতে পাওয়া যেত তার বেশির ভাগ উড়ন্ত বস্তুগুলো উল্টো চাকতি বা প্লেটের আকৃতির হয়ে থাকতো। অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তুর বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ইউফোবিদ্যা এবং যারা এ সব নিয়ে গবেষণা করেন তাদের ইউফোলজিস্ট বলা হয়। জানা যায় নিউ জার্সির প্যাসাইক এ ১৯৫২ সালের ৩১ জুলাই তে একটি এমন উড়ন্ত বস্তুর ছবি তোলা হয়েছিল। বলা হয় ঐ টিই প্রথম অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তুর ছবি। কিছু ইউফোলজিস্টদের মতে, ইউ এফ ও বলতে আকাশ বা মহাশূন্যের পর্যবেক্ষকরা যেসব অ প্রাকৃতিক বা অজানা বস্তুর দেখা পায় সেগুলোই হলো ইউ এফ ও। এগুলোকে কোনো কর্তৃপক্ষ বা বিশ্লেষক কৃত্রিম বস্তু যেমন কৃত্রিম উপগ্রহ, যান বাহন,বেলুন অথবা প্রাকৃতিক বস্তু উল্কা, গ্রহ, উল্কা বৃষ্টির উল্কা ইত্যাদি হিসাবে সহজে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। আর যে অ শনাক্ত ভাসমান বস্তু বা ইউ এস ও গুলো সমুদ্র পৃষ্ঠের উপর দেখতে পাওয়া যায় তাকে অ শনাক্ত ভাসমান বস্তু বা ইউ এস ও বলা হয়। যদিও পূর্বে এমন অনেক বস্তু দেখা গেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে পরেই ১৯৪৭ সালের ২৪ জুনে ইউ এফ ও এর জন্ম হয়েছে বলে ধরা হয়। সাধারণত এটিকে বৈজ্ঞানিক বিশ্বে একটি ছদ্ম বিজ্ঞানের ধারা বলে গণ্য করা হয়। সাম্প্রতিক বছরে, ইউ এফ ও–এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃত জাদুঘর বানানো হয়েছে। একটি হলো নিউ মেক্সিকোরে রজওয়েলে আন্তর্জাতিক ইউ এফ ও জাদুঘর এবং অপরটি হলো এর শাখা যে টি ইস্তাম্বুলে।
অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তু বা ইউ এফ ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিবেদন করা হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু ছিল নিঃসন্দেহ প্রাকৃতিক জ্যোর্তিবিদ্যা সংক্রান্ত, ধুমকেতু, উজ্বল উল্কা, একটি বা পাঁচটি গ্রহ যা খালি চোখে দেখা যায়, যুক্ত গ্রহ, অথবা বায়ুমন্ডলীয় দৃষ্টি বিভ্রান্ত আলোক মালা যেমন- প্রতি সূর্য বা পারহেলিয়া এবং লেন্স আকৃতির মেঘ মালা”।
আমার কথার মাঝেই সে জিজ্ঞেস করল –“প্রতিসূর্য মানে?” সেই কথাটি ওকে বুঝিয়ে বললাম যে-“প্রতি সূর্য হল সূর্যের প্রতিবিম্ব। যা আকাশে বরফের কেলাস দ্বারা সূর্যের আলোর প্রতিসরণ ঘটে গঠিত হয়”। তাকে বলে আবার প্রসঙ্গে ফিরে এলাম- “এখানে উদাহরণ হিসাবে তুমি মনে করতে পার হ্যালির ধুমকেতুর কথা। যেটি চীনের জ্যোর্তির্বিজ্ঞানীরা সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব ২৪০ বছর অথবা প্রায় ৪৬৭ বছর আগে প্রথম আকাশে দেখেছিল এবং রেকর্ডও করে ছিল। যাই হোক, ঐ সব কিছুর প্রকৃত কারণ ইতিহাস জুড়ে অপ্রাকৃতিক, স্বর্গদুত অথবা অন্যান্য ধর্মীয় অশনি পূর্বাভাস বলে মনে করা হয়ে ছিল। কারণ এদের আগমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত বহন করে আনে। মধ্যযুগেও এমন কিছু বস্তুর চিত্রাঙ্কন করা হয়েছে যা দেখলে ইউ এফ ও বলে মনে হয়ে থাকে। মধ্য যুগে এবং আধুনিক যুগের সূচনার প্রাথমিক সময়ে এমন অন্যান্য চিত্র অঙ্কন গুলকে ইতিহাস বিদগণ প্রায়ই ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শেন কুও যাঁর সময় কাল (১০৩১–১০৯৫) বলে মনে করা হয়, যিনি মধ্যযুগীয চীন সরকারের আমল একজন পণ্ডিত ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন, বহু রকমের বিদ্যায় তিনি পারদর্শী ছিলেন, এমন বহু আবিষ্কারও তিনি করেছিলেন, তিনি অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তুর সম্বন্ধে তার লেখা “ড্রিম পুল এসেই” নামক বইটিতে ১০৮৮ সাল নাগাদ একটি অনুচ্ছেদ লিখে ছিলেন। ১১তম শতাব্দীতে চীনের ইয়ং চৌ শহরে আনহুই ও জিয়ান সু নামের দুই জন মনিষী ইউ এফ ও সচক্ষে দেখেছেন বলে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাঁরা রাতে এক দরজা বিশিষ্ট উড়ন্ত চাকি দেখেছিল বলে দাবি করেন। যে টির দরজার ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছিল উজ্বল আলোক। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছিল প্রাণী। আপাত দৃষ্টিতে তারা ছিল ভিন গ্রহের প্রাণী। সেই চাকির নীচে থেকে বের হয়ে আসা আলো প্রায় দশ মাইল ব্যাসার্ধ জায়গা জুড়ে আলোকিত করেছিল সেখানের ভূমিকে যেখানে সেটি অবতরণ করেছিল। ঐ দু জনের বলা বক্তব্য অনুসারে বোঝা যায় চাকিটি প্রচণ্ড গতিতে তার নিজ স্থান থেকেই আকাশে উড়ে যেতে সক্ষম হয়।
২৪শে সেপ্টেম্বর, ১২৩৫ সালের রাতে মধ্যযুগীয় জাপানে জেনারেল ইয়োরি তসুমে এবং তার সৈন্য বাহিনী কিয়োতো শহরের কাছে অস্থির প্রকৃতির আলো দেখতে পান। তার পরামর্শ দাতা তাকে পরামর্শ দেন “চিন্তা না করার জন্য। কারণ এটি ছিল প্রবাহ মান বায়ু যা তারা কে কাঁপাচ্ছিল।”
১৪ই এপ্রিল ১৫৬১, জার্মানির নুরেমবার্গ শহর তখন যুদ্ধে ব্যস্ত, ঠিক তখন শহরের মানুষ একটি রিপোর্ট করেছিল যে, তারা গোলক আকৃতির একটি বস্তু এবং গোলকের বাইরে অনেক নলের আকার বস্তু দেখেছিল। ১৫৬৬ সালে হান্স গ্ল্যাসার এই ঘটনাটি চিত্র এঁকে বিবরণ দেন।
১৮৬৮ সালের জুলাই মাসে চিলিতে যে প্রথম ইউ এফ ও দেখার রিপোর্ট করা হয়, গবেষকদের মতে এটিই আধুনিক সভ্যতার ইউ এফ ও প্রত্যক্ষ করার প্রমাণ পত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি কপিয়াপো শহরের একটি সনাম ধন্য সংবাদ পত্র এলকোনস্তিত্যুয়েন্ত তে প্রকাশ করা হয়েছিল এবং ইউ এফ ও টিকে অন্যগুলোর মতই দেখা গিয়েছিল। ঠিক তার কয়েক মাস পর একই বছরে, একদল “তারকা সারি” যা “রেসের গাড়ির” মতো বস্তু আকাশে অতিক্রম করে যেতে দেখা গেল। তার রিপোর্ট করা হল। তার পর থেকে চিলির ইউ এফ ও গবেষকরা এই ধরনের বিষয় গুলকে লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন।
২৫শে জানুয়ারি ১৮৭৮ তে দৈনিক ডেনসন, সংবাদ পত্র লিখেছিল যে, স্থানীয় এক কৃষক জন মার্টিন বলেছিল সে একটি বড়, কালো, বৃত্তাকার বেলুন আকৃতির বস্তু আকাশে উড়তে দেখেছে, সেটাও নাকি যথেষ্ট গতিতে। মার্টিন আরও বলেছিলেন, “যে মনে হচ্ছিল সেটা প্লেট আকৃতির।” এই প্রথম বারের মতো ইউ এফ ও কে “প্লেটের” সঙ্গে তুলনা করা হল।
১২ই আগষ্ট ১৮৮৩ মেক্সিকান অধ্যাপক ও জ্যোর্তিবিদ জোসেফ ওয়াই বোনিল্লা বর্ণনা করেছিলেন যে, তিনি দূর বীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা পর্যবেক্ষণ করার সময় তাঁর দূর বীক্ষণ এবং সূর্যের মাঝে দীর্ঘ কিছু সংখ্যক রঙিন মণির মত বস্তু দেখতে পেয়ে ছিলেন। বোনিল্লার দেখা উড়ন্ত বস্তু অস্তিত্বের কথা তাঁর দ্বারা তোলা একটি ছবি প্রমাণ করেছিল, যেমন অতীতের ছবিগুলোতে উড়ন্ত বস্তুর অস্তিত্বের কথাও প্রমাণ করেছিল। তবে সেগুলি কতটা যথাযথ তা বলতে পারব না।
২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ সান ফ্রান্সিসকো থেকে ৩০০ মাইল পশ্চিমে তিন মার্কিন নাবিক ইউ এফ ও দেখেছে, এমন কথা এল ফ্রাঙ্ক স্কলফিল্ড দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি মার্কিন নৌ বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে চিফ কমাণ্ডার হয়ে ছিলেন । সে সময় স্কলফিল্ড লিখেছিলেন “গোলাক আকৃতির তিনটি উজ্বল বস্তু মেঘের নীচে দিয়ে যাচ্ছিল, পরে গোলকটি তার পথ পরিবর্তন করে মেঘের উপর ওঠে, দুই তিন মিনিট পর পৃথিবী ত্যাগ করে। বড় গোলকটি প্রায় ছয়টা সূর্যের আকারের মত বড় ছিল।”
৩১শে জানুয়ারি ১৯১৬ এক জন বৃটিশ বিমান চালক রিপোর্ট করেছিল যে রোচ ফোর্ডের কাছে এক সারি আলো দেখতে পেয়ে ছিলেন তিনি, যেন একটি জানালা রেল পথকে আলোকিত করেছে, পরে আলোটি আরো উজ্বল হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে উধাও হয়ে যায়।
জানুয়ারি ১৯২৬ একজন বিমান চালক প্রতিবেদন করেছিল যে, সে ছয়টা “ম্যানহোলের ঢাকনা” উই চিতা, কানসাস সিটি ও কলোরাডো স্প্রিং শহরের মাঝে উড়তে দেখছে। একই বছর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে নেভাডাতে একটি বড় ও উড়ন্ত পাখা হীন নল ওয়ালা বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ্যঃ করে ছিলেন। সেটি দেখার পর একজন বিমান বাহিত ডাক পাইলট কে অবতরণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
৫ই আগষ্ট ১৯২৬ সালে তিব্বতের কো কোনর অঞ্চলের হুম্বলড পর্বতমালা ভ্রমণের সময় নিকোলাস রয়রিচ প্রতিবেদন করেছিলেন যে, তাঁর ভ্রমণ সাথীরা দেখেছে, “কিছু একটা বড়, স্বচ্ছ ও সূর্যের আলো প্রতিফলন করে, এমন বড় ডিম্বাকার মত যা নড়াচড়া করছে প্রচণ্ড গতিতে! আমাদের শিবির অতিক্রম করে জিনিসটা দিক পরিবর্তন করছিল দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং আমরা দেখেছিলাম সেটাকে গাঢ় নীল আকাশে হারিয়ে যেতে! এমনকি আমাদের সময় ছিল চশমা পরে দেখার মত এবং আমি দেখেছিলাম, যথেষ্ট দূরে, উপরি ভাগ উজ্বল ডিম্বাকার আকৃতি, তার একপাশে সূর্যের মতো উজ্বল।” নিকোলাসের অন্য একটি বর্ণনায় ছিল যে একটি দেহ উজ্বল দক্ষিণ থেকে উত্তরে উড়ছিলো। এইটি একটি বিশাল আকৃতির। একপাশে সূর্যের নিচের দিকে উজ্বল হয়ে এবং ডিম্বাকার আকৃতির। তারপর এইটি দিক পরিবর্তন করে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে হারিয়ে যায়।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরের ইউরোপীয় যুদ্ধ জাহাজ গুলিকে ধাতব গোলক, আলোর বল এবং অন্যান্য আকৃতির জিনিস যা যুদ্ধ বিমানকে প্রায়ই অনুসরণ করতো। তা প্রতিবেদন করা হয়েছিল এবং বিমান চালক ও তাদের উপস্থিত কমাণ্ডার দ্বারা এগুলোর বিভিন্ন ছবি তোলা হয়েছিল।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ সালে আমেরিকার সৈন্যরা পর্যবেক্ষণের যে প্রতিবেদন করেছিলেন তাতে বলা হয় লস অ্যাঞ্জেলেস ও ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের উপর “অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তু” দৃশ্যমান হয়েছে এবং রাডারে ধরা পড়েছে। রাজকীয় জাপানি যুদ্ধ বিমান মনে করে তারা এন্টি এয়ারক্রাফ্ট মিশাইল নিক্ষেপ করে। তবে পরিষ্কার ব্যাখ্যা না দেওয়ায় কিছু কর্মকর্তা বিমানের ঐ রিপোর্ট টিকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তারা ওই সময় ক্যালিফোর্নিয়াতে জাপানি বিমান আক্রমণের বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। যাই হোক, সৈন্য বাহিনী প্রধান জেনারেল জর্জ সি মার্শাল ও যুদ্ধ সচিব হেনরি স্টিমসন মনে করেন যে, জাপান এই অ শনাক্ত বিমানের ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত। এই ঘটনার পরবর্তীকালে এটি “লস অ্যাঞ্জেলিসের যুদ্ধ” ও “প্রাচ্য দেশের উপকূলীয় বিমান আক্রমণ” হিসেবে পরিচিত হয়েছিল।2:07
বিমানবাহিনী অবশ্য বলছে টেক্সাসের ইউ এফ ও গুলো প্রকৃত পক্ষে জেট বিমান ছিল।
১৯৪৬ সাল জুড়ে ইউএফও নিয়ে ২০০০ এরও বেশি রিপোর্ট করা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই সুইডিশ সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে সংগ্রহ করা হয়। স্ক্যাডিনেভিয়াতে অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তু দেখা গিয়েছিল। কেবল ফ্রান্স, পর্তুগাল,গ্রীস ও ইতালির রিপোর্ট আলাদা করে রাখা হয়েছে। এগুলোকে তারা প্রথমে রশ হেল এবং পরবর্তী কালে ভুত রকেট হিসেবে উল্লেখ করেছিল। কারণ তারা চিন্তা করেছিল যে, এগুলো সম্ভবত সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে যাওয়া জার্মানির ভি ওয়ান অথবা ভি টু রকেট যা ছিল রহস্যময় টেস্টের বস্তু। যদিও অনেকেই ভেবেছিল এটা হবে উল্কার মত প্রাকৃতিক ঘটনা। রাডারের মাধ্যমে ২০০ টির ওপর ধরা পড়েছে এবং সুইডিশ সৈন্য বাহিনী দ্বারা “প্রকৃত ভৌত বস্তু” হিসাবে গণ্য করেছিল। ১৯৪৮ সালে, একটি টপ সিক্রেট ফাইলে সুইডিশ সৈন্য বাহিনী ইউরোপে থাকা আমেরিকান সৈন্য বাহিনীকে বলেছিল যে, ঐ গুলকে “তাদের তদন্তকারীরা ভিন্ন গ্রহের জীব বলে বিশ্বাস করেছিল।”
তবে প্রথম আধুনিক প্রতিবেদন পাওয়া যায়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত নিয়মিত ইউএফও দেখা শুরু হয়েছিল, এর মধ্যে ২৪শে জুন, ১৯৪৭ সালে একজন বিখ্যাত মার্কিন ব্যবসায়ী ক্যানেথ আর্নল্ড যখন তার ব্যক্তিগত প্লেন ওয়াশিংটন এর রাইনা পর্বতমালার কাছে উড়ছিলো, তখন তিনি উড়ন্ত চাকি দেখার দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নয়টা অতি উজ্জ্বল বস্তু রাইনরের দিকে মুখ করে উল্টো পাশে উড়ছিলো। অনুরূপ বস্তু ১৯৪৭ সালে আমেরিকাতে আরও দেখা গিয়েছিল।
আর্নল্ডের এই বিষয় টিতে প্রথম মিডিয়া প্রচার করেছিল এবং জনগণের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিল। আর্নল্ড বর্ণনা করেছিলেন যা তিনি দেখেছিলেন, “একটি পিঠার মত চ্যাপ্টা, চাকতির মতো আকৃতির এবং এতো পাতলা ছিল যে ঠিকমত দেখা যাচ্ছিল না, অর্ধেক চাঁদ অকৃতি, পিছনের দিক চ্যাপ্টা ডিম্বাকার এবং সামনের দিক উত্তল। তার মনে হচ্ছিল ঐ টি একটা বড় চ্যাপ্টা চাকি এবং এমন ভাবে চড়ছে, যেন একটা জীব জলের উপর লাফাচ্ছে।” অল্প দিনের মধ্যে আর্নল্ডের “উড়ন্ত বস্তু” বা “উড়ন্ত চাকতি”-এর বিষয়টি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আর্নল্ডের দেখাকে অনুসরণ করে অন্যান্যরাও একই ধরনের বস্তু দেখেছে বলে কয়েক সপ্তাহে শত শত রিপোর্ট করেছিল। এর বেশির ভাগই আমেরিকাতে। কিন্তু একই সময়ে অন্যান্য দেশসমূহ তেও এরকম জিনিস দেখেছিল বলে রিপোর্ট করা হয়েছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে এ ধরনের অন্যান্য বিষয়ের রিপোর্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। যেমন ৪ঠা জুলাই, সন্ধ্যাবেলা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমান দল ইডাহোর উপর নয়টারও বেশি একই রকম চাকি দেখেছিল।
মার্কিন ইউফোলজিস্ট টেড ব্লোচার তার সংবাদপত্র প্রতিবেদনে আর্নল্ডের বর্ণনা সহ অন্যান্য রিপোর্টগুলো নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা করেন, তিনি ৬-৮ জুলাইয়ের সঙ্গে ৪ঠা জুলাইয়ের ঘটনার উপর হঠাৎ অপ্রত্যাশিত মিল খুঁজে পান। ব্লোচার লক্ষ্য করেছিলেন যে, পরবর্তী কয়েক দিন সর্বাপেক্ষা মার্কিন সংবাদপত্রের প্রধান পাতা “উড়ন্ত চাকতি” বা “উড়ন্ত চাকির” ঘটনায় ভরা ছিল। ৮ই জুলাইয়ের পর যখন বিমান কর্মকর্তারা রজওয়েলের বিখ্যাত উড়ন্ত চাকি বিধ্বস্ত হবার ঘটনাটি সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করতে শুরু করেছিল, তারা তখন একে একটি পরীক্ষামূলক বস্তুর ধ্বংসাবশেষ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিল।
মধ্য যুগে ও ক্যামেরা আবিষ্কারের পুর্বে যে সকল অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তু দেখার দাবি করা হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগেরই উৎস সীমিত, অনির্ভরযগ্য ও কল্পনা প্রবণ, এর একটি সহজ ব্যাখ্যা ইতিহাসবিদেরা দিয়েছেন। যেমন: কসোভোর ডেটজানি সন্ন্যাসীদের মঠের প্রাচীন চিত্রের বহির্জাগতিক নভোচারিদের প্রতীক হিসাবে দেখানো হয়েছে সূর্য ও চাঁদকে যেমন এই সময়ে বিজানতিনোর ধর্মীয় শিল্পে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। অতএব, এটি ভিনগ্রহী প্রাণীর আগমন নয়, ধর্মীয় প্রতীক মাত্র পাওলো উচেল্লোর সারণীর মধ্যে যে একটি গোল উড়ন্ত বস্তু দেখা যায়, সেটি মিশরের তেবেইদ এলাকার একটি টুপির প্রতীক।
১৬৮০ সালে ফ্রান্সে এক চিত্রশিল্পী আকাশের ওপর দিয়ে একটি ইউ এফ ও উড়ে যাওয়ার চিত্র অঙ্কন করে, আসলে এটি একটি খেলার প্রতীক, এটি ভাগ্যের চাকার উপর নকশা করা হয়েছে।
প্রাচীনকাল হতেই আকাশে অদ্ভুত অদ্ভুত সব বস্তু দেখার খবর শোনা গেলেও ১৯৪৭ সালে যখন আমেরিকাতে প্রথম UFO দেখা পাবার খবর ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়, তারপর থেকে এটিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। তখনি বারমুডার সঙ্গে এলিয়েন যোগ করা হয়। এর পর আরো কয়েক হাজার UFO দেখার খবর পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে প্রায় শতকরা ৯০ ভাগই মিথ্যা। সাধারণ মানুষ প্রায়ই উজ্জ্বল কোন গ্রহ কিংবা তারা, বিমান, পাখি, বেলুন, ঘুড়ি বা ডিমের আকারের মেঘ দেখে তা UFO ভেবে ভুল করেছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সময় সাপেক্ষ তদন্ত। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনা করে মার্কিন বিমানবাহিনী ১৯৪৭ সালে UFO তদন্তে নামে। তদন্তের কাজ শেষ হয় ১৯৬৯ সালে। এ সময়ে প্রাপ্ত সর্বমোট ১২,৬১৮ টি ঘটনার মধ্যে ৭০১ টি ঘটনার কোন ব্যাখ্যা তারা দিতে পারে নি। মার্কিন বিমানবাহিনী তাদের তদন্ত শেষ করে এই বলে যে “বিমান বাহিনীর তদন্তে কোন UFO এর প্রতিবেদন করেনি এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ভয়ের কোন ইঙ্গিত দেয়নি।” ১৯৬৯ সালের পর আর কোন মার্কিন সংস্থা UFO তদন্ত কাজে সরাসরি হাত দেয়নি। এরপর ১৯৯৭ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা মার্কিন সামরিক বাহিনীর উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন গোয়েন্দা বিমান ব্যবহারের কথা ফাঁস করে দেয়। ১৯৫০ হতে ১৯৬০ পর্যন্ত যতগুলো UFO দেখা গেছে তার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ ঘটনার জন্য দায়ী Lockheed U 2A ও Lockheed SR 71 নামের এই বিমান দুটি। যদিও কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, তারপরও অনেকেই এটিকে ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দাদের আকাশ যান বলে মনে করেন। আর বিষয় টিকে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এই মহাশূন্যে কোথাও না কোথায় অতিমানবীয় বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। এরিয়া ফিফটীওয়ান্ এর নাম হয়তো শুনে থাকবে। এটি হলো নেভাডা পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ সীমার মধ্যে অবস্থিত মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর একটি উচ্চ শ্রেণীবদ্ধ অপারেশন ঘাঁটি। এটি মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের নেভাডা অঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চলের লাস ভেগাস থেকে প্রায় ১৩৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে “এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল হাইওয়ে” এর উপর রেচেল শহরের কাছে অবস্থিত। এটি একটি বিরাট গোপনীয় সামরিক বিমান ঘাঁটি যা ঠিক গ্রুম হ্রদের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। এটির ভিত্তির প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল পরীক্ষামূলক এরোপ্লেন তৈরি, অস্ত্রশস্ত্রের সিস্টেমের পরীক্ষা করণ এবং উন্নতি সাধন ও সমর্থন করা।
ভিত্তিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর বিশাল নেভাডা পরীক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সীমার মধ্যে অবস্থান করে। ভিত্তির সুবিধার্থে “স্বপ্নের ভূমি”, “জলের শহরের অংশ”, “গ্রুম হ্রদ” এবং সর্বাপেক্ষা সাম্প্রতিক কালে “সুখা বহ বিমানবন্দর” হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়। প্রায়ই সামরিক বিমান চালকরা ভিত্তির চারিদিকের আকাশ সীমাকে “বাক্স” বলে অভিহিত করে। ভিত্তিটি যে উচ্চ স্তরের গোপনীয়তা পালন করে তা মার্কিন সরকার কেবল অস্পষ্টভাবে স্বীকার করে না। এই ভিত্তির একটি দল চক্রান্তের তত্ত্ব সমূহ এবং অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তু উপকথার নায়ক বলে মনে করে।
২০০৯ সালে অবসর প্রাপ্ত বিভিন্ন কর্মকর্তারা যাদের এরিয়া ৫১-তে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল বলে দাবী করে তারা বলেন, এরিয়া ৫১ উন্নতি সাধন এবং সাম্প্রতিক প্রযুক্তির পরীক্ষা করণের (সামরিক জেট প্লেন, চন্দ্র মডিউল, ইত্যাদি) কাজের জন্য অনেক গোপনীয়তা পালন করে ব্যবহার করা হয়।
ভিত্তিতে সাতটি বিমান উড্ডয়নের পথ রয়েছে, তার মধ্যে এখন এক টিকে বন্ধ বলে মনে হয়। বন্ধ উড্ডয়নের পথটি হল 14R/32L, যার দৈর্ঘ্য ৭,১০০ মিটার (২৩,৩০০ ফুট) প্লেন থামার জায়গা বাদে। অন্য উড্ডয়নের পথ দুটি খুব কালো রঙের। 14R/32L উড্ডয়ন পথটির দৈর্ঘ্য ৩,৬৫০ মিটার (১২,০০০ ফুট) এবং 12/30 উড্ডয়ন পথটির দৈর্ঘ্য ১,৬৫০ মিটার (৫,৪০০ ফুট)। অন্য উড্ডয়ন পথ চারটি লবণ হ্রদের সামনে অবস্থিত। এই চারটি উড্ডয়ন পথ হল 09R/27L এবং 09R/27L, এদের উভয়েরই দৈর্ঘ্য ৩,৫০০ মিটার (১১,৪৫০ ফুট) এবং 03L/21R আর 03R/21L, এদের উভয়েরই দৈর্ঘ্য ৩,০৫০ মিটার (১০,০০০ ফুট)। ভিত্তিতে হেলিকপ্টার নামার জন্য একটি জায়গাও রয়েছে। এই সব নথিপত্র এক এক সময় ফলাও করে প্রকাশ হয়েছে।
২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, যাত্রিবাহী বিমান চালকরা লক্ষ্য করেছিলেন যে, ভিত্তিতে তাদের বিমান দিক নির্ণয় পদ্ধতি পরিমার্জন করেছে। KXTA এর ICAO বিমান ঘাঁটির চিহ্নিত কোডের সঙ্গে সাম্প্রতিক জাপানি ডেটাবেস পরিমার্জন এবং “হমেয় বিমানবন্দর” কে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বিমান ঘাঁটির ডেটার সম্ভবত অসাবধানতা ও মুক্ত সত্ত্বাধীকারী প্লেন এবং বিমান চালক সমিতির উপদেশে ও নেতৃত্বে এ সব পরিবর্তন করে নেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে ছাত্র বিমান চালকদের KXTA সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে সাবধান করা উচিৎ। যে কোন উড্ডয়নের জন্য এইটি নির্দিষ্ট করলেও এটিকে একটি রাস্তা অথবা গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা না করা। যদিও জনগণ এই দিক নির্ণয় ডেটাবেসে এখনও অবগত হয় নি।
ঐ ভাবেই রজওয়েলের ঘটনাটি ঘটেছিল ৮ই জুলাই ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে নিউ মেক্সিকো, রজওয়েলের মরুভূমিতে এখানে একটি অ শনাক্ত উড়ন্ত বস্তুর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এবং সরকার এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকার করে। মার্কিন সামরিক বাহিনী জানায় যে, এগুলো একটি পরীক্ষামূলক বস্তুর ধ্বংসাবশেষ এবং তাকে উচ্চ সতর্ক কারী বেলুনের শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করে। এই প্রোগ্রামটি মুগুল নামকরণ করা হয়েছিল। সেখানে প্রকৃত পক্ষে কী ঘটেছিল তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। অনেক ইউ এফ ও বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ জনগণ মনে করেন যে, এটি একটি ভিনগ্রহী মহাশূন্য যান যা এখানে ধ্বংস হবার পরে এর পাইলটের (এলিয়েন) দেহ পুনরুদ্ধার করে এবং সামরিক বাহিনী তা লুকিয়ে ফেলে।
উই এফ ও এর ঘটনাটি একটি সর্ব জন পরিচিত জন সংস্কৃতি হয়ে যায় এবং রজওয়েল নাম টিকে পরিবর্তন করে একে ইউ এফ ও রজওয়েল রাখা হয়। ভিনগ্রহী প্রাণী ধরার ব্যাপারটা তখন মিডিয়া এবং গবেষকদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। রজওয়েলের ঘটনাকে বিশ্বের বহুচর্চিত বিখ্যাত ঘটনা এবং সবচেয়ে নিখুঁত ভাবে তদন্ত করা ঘটনা ও ইউ এফ ও এর প্রত্যক্ষ করণের দাবির সর্বোচ্চ প্রমাণ হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
বোধহয় তুমিও জেনে থাকবে রজওয়েল হল নিউ মেক্সিকোরে মরুভূমিতে একটি শহর, ১লা জুলাই ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রাত্রিতে প্রচণ্ড ঝড় ও বজ্রপাতের সময় “৫০৯তম বোমারু দল” এর বিমান ঘাঁটির রাডারে একটি অদ্ভুত ঘটনা ধরা পড়ে ছিলো। রাডারে পর্দার এক কোণে বার বার একটি বস্তু দেখা যাচ্ছিল। যেটি এমন গতিতে যাচ্ছিল যে, ওই সময়ের সেনা বাহিনীর বিমানগুলোও এমন কী বর্তমান গতির বিমানগুলোও সেই গতিতে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। রাডারের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বজ্রপাতের মতো দিক পরিবর্তন করতে দেখা যায়। যেটি ছিলো ব্যাখ্যাতীত বিষয়! তারা রাডারের দ্বারা উৎপন্ন হওয়া তড়িৎ-চুম্বকীয় সমস্যার জন্য এটি হচ্ছে ভেবে রাডার পরীক্ষা করেন। কিছুই গোলযোগ খুঁজে পাওয়া যায় না। পরবর্তী সময়ে রাডারে একই ঘটনা ঘটতে লক্ষ্যঃ করা গেল। সেটিও আগের মতোই বজ্রপাতের ন্যায় দিক পরিবর্তন করছে। তারা ভেবেছিল যে, কোনো বস্তু বিপদজনক ভাবে অজানায় বা সম্ভবত যুদ্ধপ্রিয় যা তাদের আকাশ সীমা পার করছিল। পরে ৮ই জুলাই তারিখে রজওয়েল দৈনিক রেকর্ড নামে একটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় তা প্রকাশ পেয়ে ছিল এই ভাবে যে, “রজওয়েলের খামার অঞ্চলে আর এ এ এফ উড়ন্ত বস্তু ধরা পড়েছে”। ঘটনাটি অন্যান্য স্থানীয় সংবাদপত্রেও দেখা গিয়েছিল। ঐ দিন বিমান বাহিনীর রেডিও এবং সংবাদ পত্রে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, রহস্যময় দুর্ঘটনাটি একটি উড়ন্ত বস্তুর দ্বারা ঘটেছিল। এই ঘটনাটির জন্য রজওয়েল শহরে ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (FBI) এসে ছিলো ব্যাপারটি পরীক্ষা করার জন্য। বিতর্কের কিছু দিন পরে, রজওয়েল সামরিক বাহিনীরা একটি বেলুনের ছিন্নাংশ দেখিয়ে ছিলো, যেটি মুগুল নামের প্রোগ্রামটি জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এ সিস্টেমটি পারমাণবিক ক্ষেত্রের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কতিপয় বছরগুলোতে রজওয়েলের বাসিন্দাদের থেকে বিভিন্ন সংবাদ এসেছে বিমান বাহিনী এবং ফেডারেল সম্বন্ধে। কিছু লোক বলেছিল যে, “কখনও কখনও বিমান বাহিনীর কর্মচারীরা ধ্বংসাবশেষ এবং ফেডারেলের ট্রাকে দেহ (মানুষের না এমন কিছু) বহন করে”। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের দ্বারা এগুলো সব অস্বীকার করা হয়েছে”।
“সুতরাং বুঝতে পারছ যে ইউ এফ ও এর ঘুরে বেড়ান বা এলিয়েন দেখা ঘটনাটি এখনও বেশ জটিল পর্যায়ে রয়েছে। এদের কেউ এখনো তেমন জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারছে না। ঐ একই ভাবেই বলতে পারা যাচ্ছে না যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্যের মধ্যে কোন এলিয়েন যোগাযোগ নেই। এটি অতি সাধারণ একটি অঞ্চল! তাহলে বুঝতে পারছ যে এটি এখনো মানো আর না মানো পর্যায়ে দাঁড়িয়ে। এই অভিযানে জীবণের ঝুঁকি আছে কী নেই তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তুমি সে পথে ঠিক ঠাক অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসতেও পার আর নাও ফিরতে পার! এই ঝুঁকি তোমাকেই নিতে হবে যে তুমি কী করবে?”
আমার কথা গুলি শুনে বরিস একটু ভীত হয়ে গেল বলে মনে হল। ওর চোখের আর মুখের আকার আকৃতি দেখে আমার তাই মনে হল। তবে বারমুডা যে ট্রাপিজিয়াম নয় এটি একটি ত্রিভুজ তা এক্ষুনি প্রমাণ হল। আমরা এই মাত্র মেক্সিকো উপসাগরের উপর দিয়ে এলাম। সেখানে কিছু অঘটন ঘটল না। ট্রাপিজিয়ামে মেক্সিকো উপসাগরকে যোগ করা হয়েছে।
আমারা কিউবার জোসে মার্টি ইন্টার ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ এই মাত্র পদার্পণ করলাম। এখানে আমার বন্ধু বেনি থাকে। সে এখানে চিনি গবেষণার কাজে যুক্ত। ও আমাকে এখানে একটি বক্তৃতা দেবের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বিট থেকে কী ভাবে সহজে বানিজ্যিক চিনি তৈরী করা যায় সে সম্পর্কে কিছু বলার জন্য। এতে ওদের বহু বিট নষ্টের হাত থেকে বাঁচবে ও আরো বৃহত্তর চিনি রপ্তানি কারক দেশ হিসাবে তাদের নাম উঠে আসবে।
কিউবার মাটিতে পা দিতেই ও আমার সঙ্গ ত্যাগ করল। যদিও তখন আমি বুঝতে পারলাম না যে ও আর আমার সঙ্গে অভিযানে যাবে না। কিউবাতে গিয়ে ও আমকে জানাল যে ও এখানে টাইনো উপজাতির খোঁজে যেতে চায়। টাইনো হল রেড ইন্ডিয়ান উপজাতি।
কিউবা ক্যারিবিয়ান দ্বীপ পুঞ্জের বৃহত্তম ও সবচেয়ে পশ্চিমে অবস্থিত দ্বীপ। দ্বীপটি আশেপাশে অনেকগুলি ছোট দ্বীপের সঙ্গে মিলে কিউবা প্রজাতন্ত্র গঠন করেছে এটির এক দিকে উত্তর ও আর এক দিকে দক্ষিণ আমেরিকা তার মধ্য স্থলে অবস্থিত এই কিউবা। ক্যারিবিয়ান সাগর ও মেক্সিকো উপসাগরের মধ্য দিয়ে সমস্ত সমুদ্র পথের উপর দেশটি অবস্থিত। কিউবার উত্তরে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাহামা দ্বীপ পুঞ্জ, পূর্বে টার্কস ও কেইকোস দ্বীপ ও হাইতি, পশ্চিমে মেক্সিকো আর দক্ষিণে জামাইকা ও কেইমান দ্বীপ পুঞ্জ। এখানের উর্বর ভূমি এবং আখ ও তামাকের ফলনের প্রাচুর্যের ফলে কিউবা ইতিহাসের অধিকাংশ সময় ধরেই ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র বলে পরিচিত হয়ে আছে। হাভানা এ দেশের রাজধানী। এখানের জনসংখ্যা খুব বেশি না। তা হলেও এখানে প্রচুর লোক থাকে। এরা পাশি পাশি হাইতি মার্কিন মুলুক মেক্সিকোর ইউকাতান উপদ্বীপ ও জামাইকা থেকে আসা যাওয়া করে। বলে
এর ফলে কিউবাতে বহু ধরনের জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির সহাবস্থান ঘটেছে। কৃষিতে সমৃদ্ধ হলেও কিউবা খুব কম কৃষি দ্রব্যই রপ্তানি করতে পারে, এর মধ্যে আছে চিনি, তামাক, লেবু জাতীয় ফল এবং বিভিন্ন ধরনের উৎপাদিত দ্রব্য।
উর্বর ভূমি, অসংখ্য পোতাশ্রয় এবং খনিজের ভাণ্ডারের জন্য দেশটিকে অনেকের কু নজরে পড়তে হয়েছে। স্পেন, মার্কিন এরা বিভিন্ন সময়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তবে বর্তমান রাশিয়া সমাজ তান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে কিউবার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিউবা প্রায় ৪০০ বছর ধরে স্পেনের একটি উপনিবেশ ছিল। স্পেনের কনকিস্তাদোরেরা এই দ্বীপকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকাতে আক্রমণ চালাত। ১৯শ শতকের মধ্য ভাগে স্পেনের অধিকাংশ উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও এটি পরাধীন থেকে যায়। তার বহু দশক পর কিউবার লোকেরা একটি স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৮৬৮ সালে কিউবার লোকেরা তাদের তিনটি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম টিতে লড়াই করা শুরু করে। ১৮৯৮ সালে মার্কিনীরা এই যুদ্ধে প্রবেশ করে কিউবার পক্ষ নিয়ে স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তারা কিউবাকে মার্কিন প্রতিরক্ষার অধীনে স্বাধীন ঘোষণা করে।
১৯০২ সালে কিউবা স্বায়ত্তশাসন শুরু করে, যদিও দেশ টিতে মার্কিন প্রভাব তখনও প্রবল ছিল। ১৯০৩ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী কিউবার গুয়ান্তা নামো উপসাগর এলাকায় মার্কিন নৌ ঘাঁটি এখনো রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে অধিকাংশ সময় জুড়ে কিউবার সরকার ধারাবাহিক ভাবে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রপতি ও স্বৈর শাসকের অধীনে শাসিত হয়। ১৯৩৪ সাল থেকে সামরিক অফিসার ফুলগেনসিও ব্যাতিস্তাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কখনো সামরিক স্বৈর শাসক, কখনো বেসামরিক রাষ্ট্রপতি, কখনও পর্দার আড়ালে সামরিক নেতা হিসেবে দেশটি শাসন করা শুরু করেন। ১৯৫০-এর দশকের মধ্য ভাগে বহু কিউবান ব্যাতিস্তার স্বৈর শাসন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। বাতিস্তার বিরুদ্ধ প্রতিবাদ পরবর্তীতে যা কিউবান বিপ্লবে রূপ নেয়।
১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি ব্যাতিস্তার সরকারকে ক্ষমতা চ্যুত করে এবং কিউবায় একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই নেতা কাস্ত্রো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সব রকম নীতিবিষয়ক সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৬০-এর দশকে কাস্ত্রো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিশ্বের প্রধান সমাজ তান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৬১ সালে কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবা সরকারি ভাবে মার্কস বাদ গ্রহণ করে।
কাস্ত্রো সে সময় সোভিয়েতে মার্ক্স বাদের যে রূপটি প্রচলিত ছিল, সেই মডেলটি গ্রহণ করেন। তখন থেকে কিউবা সমাজ তান্ত্রিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক নীতি মেনে শাসিত হয়ে আসছে। সমাজ তন্ত্রে কিউবার জনগণের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়টি বিসর্জন দেওয়া হয়। কমিউনিস্ট আদর্শ অনুসারে ধর্মপালন নিরুৎসাহিত করা হয়, তবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু কিউবার ইতিহাস ও সংস্কৃতি পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির মত না হওয়ায় কিউবার সমাজ তন্ত্র সোভিয়েত মডেল পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারেনি। যদিও কিউবার প্রশাসনিক দফতর ও সংস্থাগুলির কাঠামো সোভিয়েত ধাঁচের ছিল, তা সত্ত্বেও কাস্ত্রোই মূল প্রশাসনের মূল পরিচালক।
কিউবার প্রথম লিপিবদ্ধ ইতিহাস জানা যায় ১৪৯২ সালের ২৮ শে অক্টোবর থেকে। এই দিন দিগ্বিজয়ী নাবিক কলম্বাস তার প্রথম অভিযানে কিউবায় পৌঁছে এই অঞ্চল টিকে স্পেনের অধীন বলে দাবি করেন। কলম্বাস যুবরাজ জুয়ানার নামানুসারে এই দ্বীপটির নাম রেখেছিলেন আইলা জুয়ানা। তখন এই দ্বীপে আমেরিকার আদিবাসীরা বসবাস করতো যাদের নাম ছিল টাইনো ও সিবোনেই। এরা মূলত উত্তর, দক্ষিণ এবং মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক শতাব্দী পূর্বে এই দ্বীপে অধিবাসী হয়ে এসেছিল। টাইনোরা মূলত কৃষি কাজ করতো এবং আর সিবোনেইরা কৃষি কাজ এবং পশু শিকার উভয় কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। প্রাথমিক টাইনো সংস্কৃতিতে উল্লেখ আছে তারা তামার ব্যবসা করত। ও ওদের সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছে এখনো কিছুটা আদিম সভ্যতা ওদের মধ্যে বেঁচে আছে। বোধহয় সেই কারণে ও ওদের গ্রাম দেখতে যাওয়াতে আগ্রহী হয়। আমার মিটিং থাকায় আমি আর ওর সঙ্গে যেতে পারলাম না।
আমার জানা আছে টাইনো গ্রামটি মাতানজাস প্রদেশের সিয়ানাগা দে জাপাটার লেগুনা দেল টেসোরোতে অবস্থিত। কিউবান এবং বিদেশী উভয়ই প্রতিদিন শত শত মানুষ এখানে আসার কারণে এটি আজ দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন স্থান।
এটি 47 বছর আগে কিউবার বিপ্লবের একজন নায়িকা সেলিয়া সানচেজ মান্দুলেই তৈরি করেছিলেন, দ্বীপের একটি আদিবাসী সম্প্রদায় টেনোসের জীবনকে বিশ্বাস করে, নিজেদের মাছ শিকার ও কৃষি কাজ থেকে শুরু করে গড়ে তোলে জীবনের আধ্যাত্মিকতার পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।
আমি একবার ওখানে আগে গিয়ে ছিলাম। সাইটটি মূল ভূখণ্ড থেকে 8 কিলোমিটার মিঠা জল দ্বারা পৃথক করা হয়েছে। আমি ওখানে ২৫ টি মুর্তি দেখেছি যা মাটি আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরী করা। ঐ গুলি নাকি শিল্পী রিতা লঙ্গার বানানো। তবে ক্যাসিকের বাড়ির প্রতিলিপি, উপজাতির বেহাক, ঝুপড়ি, শিকার এবং মাছ ধরার যন্ত্র এবং বেতের প্রতিলিপিও রয়েছে সেখানে।
এই টাইনো গ্রামটি ঠিক ভিলা দে গুয়ানমের প্রবেশ দ্বারে এবং এর কাজটি কিউবার সাংস্কৃতিক শিকড়কে উৎসাহিত করা। এই বিনোদনগুলি উপস্থাপন করা এবং লাইভ শো গুলি দেখায় যে এই জায়গার প্রাচীন বাসিন্দাদের স্বতঃসত্ত্বা যোগাযোগ এবং কিংবদন্তি গুলি পুনরায় তৈরি করা হয়।
ও আগ্রহ নিয়ে টাইনো গ্রাম দেখতে চলে গেল। আমি মিটিং এ যোগ দিলাম। মিটিং শেষ হয়ে গেল বাহিরে বের হয়ে দেখলাম সে বাহিরে নেই। আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল যে আগে এসে আমার কনফারেনস অডিটোরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি অডিটোরিয়ামের থেকে রাস্তায় নেমে এলে একটি ছেলে একখানা চিঠি হাতে ধরিয়ে দিলে। খুলে দেখলাম বরিসের চিঠি। সেখানে লেখা ও এখন আসতে পারবে না। আমি ওকে বাদ দিয়েই অভিযান করতে পারি। এটি আমি আগেই বুঝে ছিলাম। রাস্তায় আমার জন্য বন্ধু গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। ওর গাড়ি করে ওর বাসায় গেলাম। যাবার পথে ও আমার হাতের চিঠির কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। ওকে সব গল্প করলাম। ও আমাকে সাহায্য করতে পারবে বলল।
ওর বাড়িতে খাবার টেবিলে বসে, তখন একটি কম বয়সী ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আমার কাছে সে জানতে চাইল কখন যাব! আমি তার ঐ কথার কিছু বুঝতে পারছি না বললে। বন্ধু বলল তাকে ও নিয়োগ করেছে। আমাকে বারমুডা দর্শনে নিয়ে যাবে বলে। আমি বললাম কাল সকালেই বের হওয়া যাবে।
ছেলেটির নাম ফ্রাঙ্ক। পরের দিন সকালে সে হাজির হল গাড়ি নিয়ে। গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ি করে আমরা ওর বাড়ি যাব। সেখানে ওর জ্যাম্বো হেলিকপ্টার চড়ে আমরা রওনা দেব বারমুডার ভয়ংকর অঞ্চলে। যদিও তার সঠিক অবস্থান আমাদের জানা নেই। আমরা মোটামুটি ট্রায়াঙ্গেলটির মধ্যবর্তী অঞ্চলটুকু ঘুরে বেড়াব বলে ঠিক করলাম। ও আমাকে বলল ঐ জায়গাটিকে বেশির ভাগ লোকে ভয়ংকর বলে অভিহিত করে। ও আশাবাদী আমার কৌতুহলের নিরসন ঐ খানেই হবে।
নিজেকে সব দিক থেকে সজ্জিত করে এসেছি। সেই বটিকা, বিপদ নিরুপন যন্ত্র ইত্যাদি সব কিছুই সঙ্গে আছে। প্রয়োজন মত সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হব।
ইতিমধ্যে ফ্রাঙ্কের বাড়িতে আমরা পৌঁছে গেছি। চারিদিকে গাছ গাছালিতে ঘেরা। শুধু সবুজ না। লাল সাদা হলুদ ইত্যাদি কত রকমের পাতা বিশিষ্ট গাছ। দেখে মনে হল ছেলেটির একটু সখ আছে এই সব দিকে। কি সুন্দর ছিমছাম ভাবে সাজিয়ে রেখেছে সে সর্বত্র। জিজ্ঞেস করলাম-“এই সব বাগান করার সখ আছে নাকি?” ও বলল “হ্যা”। সে নাকি নিজের হাতে ঐ বাগানের দেখাশোনা করে। বেশ অবাক হলাম! ছেলেটির দম আছে। এত বড় বাগান সে একা নিজে হাতে পরিচর্যা করে!
সেই বাগানের মাঝে একখানি ঘর। বেশ বড় সড় আকারের আর আধুনিক ডিজাইনের। বাড়িটির চারিদিকে চঙ মঙ করে চেয়ে দেখছি, ও যে বলেছিল জাম্বো হেলিকপ্টারে চেপে আমরা বারমুডা দর্শনে যাব। আর সেটি ওর বাড়িতে আছে? তাহলে কই সেটি? মনে মনে প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। এত বড় হেলিকপ্টার সে তো বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে রাখা যাবে না। তাহলে?
ও আমার মনের কথা বুঝতে পারল কী জানি না। আমাকে বলল-“চলুন উপরে একবার ঘুরে আসবেন। এখানে উপর থেকে আমার এই বাড়ির চারি পাশের পরিবেশ দেখতে বেশ মনোরম লাগে। আপনি নিজের চোখে না দেখলে সেই সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবেন না।
ও এমন করে বলল যে ওর কথা আর ফেলতে পারলাম না। ওর সঙ্গে ওর বাড়ির ছাদে উঠে পড়লাম।
সত্যি সেখান থেকে তার চতুর্দিকের পরিবেশ দেখতে বেশ মনোরম লাগছে। একেবারে চোখ জুড়িয়ে যাবার মত দৃশ্য। ঠিক তখন কিছু বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম দূরে একখানা হেলিকপ্টার রাখা রয়েছে। তখন জিজ্ঞেস করলাম-“ঐ হেলিকপ্টার টিই কী আপনার?” সে উত্তর করল “হ্যাঁ”।
উপরে ছাদের মাঝে একটা চা খাবার চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে। ও আমাকে সেখানে বসতে বলল। একজন বেয়ারা এসে সেই টেবিলে চা দিয়ে গেল। দু জনে সেখানে বসে চা আর স্নাক্স খেলাম। তার পর নীচে চলে গিয়ে ও আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। যখন বের হল তখন অন্য মানুষ! এত ক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম যে ও কিউবার সৈন্য বিভাগের লোক। ওর গায়ে জড়ানো পোশাক সেই কথা বলছে।
আগে আমার সন্দেহ যে একেবারে হয়নি তা বলব না। বুঝেছিলাম এমন সাহসী কাজে এগিয়ে আসতে যে সাহস করে সে নিশ্চিতরূপে কোন সাহসী কাজ করে। তবে একেবারে সৈন্য! এমন কথা মনে আসে নি। সে যাই হোক। তার পর দু জনে বাগানের পথ দিয়ে হেঁটে গিয়ে উঠলাম তার হেলিকপ্টারে। ও তখন সেটিকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল।
আমরা উড়ে চলেছি দক্ষিণ পশ্চিম কোন বরাবর মেক্সিকো উপসাগরের উপর দিয়ে। নীচে দেখছি শুধু জল আর জল। মাঝে মাঝে বেশ কিছু ছোট ছোট দ্বীপের উপর দিয়ে আমরা উড়ে চলেছি। কিছুটা পথ পেরিয়ে যেতে আর কোন দ্বীপ বেশ সময় ধরে আর চোখে পড়ছে না। তাকে জিজ্ঞেস করলাম-“ এবারে কি আটলান্টিক মহা সাগরে এসে পড়লাম?” ও উত্তর করল-“না। এখনো বেশ কিছুটা মেক্সিকো উপ সাগরের সীমা আছে”। আমাদের কন্যা কুমারীর কথা মনে পড়ে গেল। ধন্য আমরা যে একটি স্থানেই আমরা সাগর মহাসাগর আর উপসাগর দেখতে পাই। এটির পশ্চিমে আরব সাগর। পূর্বে বঙ্গ উপো সাগর আর তার দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। সাগর আর মহাসাগরকে একটা সীমানা দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। সেটি এখানে কতটা তা আমার জেনে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। তাই ঐ বিষয়ে গুরুত্ব নেই আমার। বিপুল জল রাশি পথ বেশ কিছুটা পেরিয়ে যাবার পর ও আমাকে বলল-“এই বার আমরা আটলান্টিকে এলাম”। আমি একবার সেখান থেকে চারিদিকে চেয়ে দেখলাম। চারি দিকে শুধু জল আর জল! থৈ থৈ করে নাচছে যেন। যেন তার বড় বড় ঢেউ এর হাত আমাদের আলিঙ্গন করার জন্য উপর দিকে উঠে আসতে চাইছে। ফ্রাঙ্ক এতক্ষণ জলের বেশ গা ঘেঁসে তার হেলিকপ্টার টি উড়িয়ে নিয়ে চলেছিল। এখন সে এটিকে একটু উপরের দিকে উঠিয়ে নিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-“উপরে কেন ওঠালে? কাছা কাছি বেশ ভাল লাগছিল তো”। ও বলল-“না। এখানে জল ও তার বাষ্প মাঝে মাঝে আবর্তাকারে ঘোরে। সহজে আমরা সেই আবর্তের কবলে পড়ে সমুদ্রের জলে পড়ে যাব”। আমি তো জানি ওতে আমার কোন অসুবিধা নেই। তাই বলে ও বেচারার কী হবে? ওকে এখানে টেনে এনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া আমার উচিৎ হবে না। তাই বললাম-“তুমি যেটি ভাল বোঝ কর”।
এখন আমরা বেশ কিছুটা মহাসাগরের সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে গেছি। আর তার জল রাশির বেশ অনেকটা উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। এখান থেকে পৃথিবী টাকে গোল বলেই মনে হচ্ছে।
হঠাৎ আমার সংকেত যন্ত্র আমাকে বিপদ সংকেত দিতে শুরু করল। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ভরে রয়েছে ধোঁয়া। ওকে বললাম “আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেও না। পেছনের দিকে ফিরে চল তাড়াতাড়ি”। ও তখন কিছু না জিজ্ঞেস করে হেলিকপ্টার ঘুরিয়ে পেছনের দিকে চলে এল। একটু পেছনের দিকে উড়ে যেতে দেখি আর বিপদ সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আমি পকেটের যন্ত্র টিকে বের করে দেখলাম সেটি ঠিক ঠাক নির্দেশ দিচ্ছে। তখন মুখ ফসকে বের হয়ে গেল একটা কথা “এখানে ঠিক আছে”। ও তখন আমেকে জিজ্ঞেস করল “ব্যাপার কী?” তাকে বুঝিয়ে বললাম যে” আমার এই যন্ত্রটি বিপদের আগাম আভাস দিতে পারে। ওটি ওখেনে সেই আভাস দিয়েছে। তাই আমি তোমাকে ফিরে যেতে বলেছিলাম। আবার এখানে সেটি কোন বিপদ সংকেত দিচ্ছে না”। কথা গুলো আমার মুখ থেকে শুনে ও কিছু ক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রহিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম-“আমার সম্পর্কে তুমি কি কিছু শুনেছ আমার বন্ধুর কাছে?” ও বলল “হ্যাঁ। তবে এই চাক্ষুস দেখাটা একটু অন্য রকম”।
মনে ভাবলাম এ কী দেখেছ বাপু? এবার তো দেখবে? তখনই তাকে বলে দিলাম সেই হাড় কাঁপানো কথাটা। বললাম-“তোমাকে এখানে কিছুক্ষণ হেলিকপ্টার নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে আমার জন্য। আমি ঐ বিপদ সঙ্কুল জায়গাতে যাব!”
“যাব মানে! আপনি কী পাগল হয়ে গেছেন?” ঠিক এমন ভাবেই সে প্রতিক্রিয়া দিল। আমি বললাম “ওরে বাবা, আমি যাব আবার ফিরেও আসব। সেই জন্য তো তোমাকে এখানে অপেক্ষা করার কথা বলছি”। ও আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি যে ঐ জলে ভয়ংকর পরিস্থিতিতে যেতে পারি এবং সেই পরিস্থিতি থেকে বের হয়েও ফিরে আসতে পারি ও মানতে পারছে না। আমি ওকে ভাল করে বুঝিয়ে বললাম। তবুও ও মানতে পারছে না যে আমি ঐ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসতে পারি।
ওর সঙ্গে আমার কথা কাটা কাটি চলছে। ও আমাকে কিছুতেই যেতে দিতে নারাজ। আর আমি তো যাব। যেটি মনে মনে স্থির করি তা আমি করেই ছাড়ি। আমাকে দেখতেই হবে এখানের আসল সত্যটি কী? কথা বলতে বলতে আমি পকেট থেকে একটি বেলুন বের করে ফু দিয়ে ফুলিয়ে ফেললাম। তার পর তাকে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম হেলিকপ্টার থেকে বাতাসে। উড়ে যেতে যেতে ওকে বললাম-“আমার জন্য দুই ঘন্টা এখানে ঘুরতে ঘুরতে অপেক্ষা করবে”। বাতাসের টানে বেলুন আমাকে টেনে নিয়ে চলল সেই বিপদের দিকে। সেটি হবার ছিল আমি বুঝেছি। বাতাস সেখানা আবর্তাকারে ঘুরছে তবে তার গতি তেমন নয়। তাই আমার সংকেত যন্ত্র তা বিপদের বলে দেখায় নি। আমি ধীরে ধীরে সেই ঘূর্ণির কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমি জানি এমন আবর্তাকারে মাধ্যমে ভারী বস্তু গুলো সব ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্রের দিকে ছুটে যায়। ক্রমেই আমার সেই কেন্দ্রের দিকে ছুটে যাবার গতি বেড়ে যাচ্ছে। এখনও নীচের জল রাশিকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
হঠাৎ আমার বেগের পরিবর্তন ঘটে গেল! বেলুন হাত থেকে ছিটকে গেল একটা জোর ধাক্কায়। আমি বাতাসের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছি। চারি দিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া দেখছি। নীচের জল আর দেখতে পাচ্ছি না। আমার নিজের আর করার কিছু ক্ষমতা নেই। বাতাস আমাকে যা করাচ্ছে আমি তাই করছি। সে একেবারে আমাকে উল্টে পাল্টে যেন সেই ধোঁয়া তে আছাড় পাছাড় খাওয়াচ্ছে। আমি কোন রকমে পকেট থেকে আমার চশমাটি বের করে পরে ফেললাম। সেটি পরলে আমি জলে ধোঁয়াতে এমন যে কোন পরিস্থিতিতে সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাব। এইটি আসলে চোখে পরলে অ স্বচ্ছতা কে স্বচ্ছে পরিবর্তিত করতে পারে। এবার আমি সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। নীচে জল রাশি আনন্দে নাচছে আমাকে গ্রহণ করবে বলে। আর চারিদিকে জলের বাষ্প পাগলের মত বন বন করে ঘুরে চলেছে। নীচে আরো ভাল করে তাকিয়ে দেখি, ও মা! সেখানে জল রাশি সব মৃত্যু কূপের মত বৃত্তাকারে চারিদিক ঘুরে খেলা দেখাচ্ছে! তার সেই খেলায় তার নিজের মৃত্যু হবে আবার যে পড়বে সেই কূপে তারও মৃত্যু ঘটবে। অনেকে মনে করতে পারে জলের আবার মৃত্যু কী? জল কণারা যে বাষ্প কণায় পরিবর্তিত হয়ে গগনের পানে উড়ে যায় তা কী তাদের মৃত্যু নয়? তারা আবার নতুন ভাবে জল কণা রূপে জন্ম গ্রহণ করে আকাশের কোলে। ঘুরতে থাকা বাষ্পের মধ্যে আমি তার বসে ঘুরে চলেছি আর ভাবছি। এমটা তো হবার কথা না! এত বাষ্প তো এই একটি জায়গাতে এতক্ষণ ধরে স্থির থাকতে পারে না। সে তো বাতাসের প্রবাহে ভেসে চলবে বাতাসের গতি অনুসারে সেই পথে। যে পথে বাতাস চলতে চায়। তবে এ এখানে স্থির কেন? মনে সন্দেহ দেখা দিল।
ঠিক তখন আমি বুঝলাম কে যেন আমাকে জোরে নীচের দিকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে! আমি প্রাণ পণ চেষ্টা করছি তার সেই টান থেকে নিজেকে মুক্ত করার। কিছুতেই আমি নিজেকে মুক্ত করতে পারছি না। তখন পকেট থেকে সেই বটিকা বের করে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেলাম সেই জলে ঠিক ঘূর্ণির মাঝখানে!
অবাক কান্ড! দেখি তার দু দিকের জল দু রকমের। তার এক দিকের জল বরফের মত হিম শিতল। আর অন্য দিকে চা গরম করা জলের মত গরম। তখন বুঝলাম এই বাষ্পের কারণ! ঠান্ডা আর গরম দুটি জল পরস্পরের সংস্পর্শে এলেই বাষ্পে পরিণত হচ্ছে। আর দুটি দু মুখি প্রবাহ বেগে এই ঘূর্ণাবর্ত তৈরী হয়েছে। এ তো শেষ হবার ন! এ তো চলবে পৃথিবীর পরিবেশ পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত! তবে এত বিশাল সমুদ্রের এই জায়গা টুকুতে না এলেই বা ক্ষতি কী? তবে ভূল করে যদি এসে পড়ে তবে তার রক্ষা নেই। নিয়তি তাকে নিজে টেনে আনবে এই পথে।
আমি তো জলের মধ্যে পড়ে হাঁড়িতে ভাত ফোটার মত খালি জলের ওপরে আর নীচে ওলোট পালট খাচ্ছি। এই বুঝি প্রাণ যায় যায় অবস্থা! ঠিক সময়ে আবার ওষুধটাও কাজ করতে দেরী করছে! তা নয় সে তার সময় মত কাজ শুরু করবে। এদিকের তোলপাড় হতে থাকা দেহ যেন সেই সময় টুকুকেই বলছে অনেক সময়। এমনই তার খেলা! শরীরটা নিস্তেজ হতে হতে মনে হচ্ছে যেন সে আবার বল ফিরে পাচ্ছে! শরীরটা ফুলে উঠছে! পেশী গুলো যেন আর জলের সেই তুমুল দাপটকে আর পাত্তা দিচ্ছে না! এবার নিজের শরীরটাকে জলের ওপরে তুলে ধরে জোরসে মারলাম লাফ! সেই লাফে একেবারে বাষ্প গণ্ডি ভেদ করে বেরিয়ে এলাম ফ্রাঙ্কের হেলিকপ্টারে। আমার সেই আকার আর ঐ রকম কল্পনার অতীত দৃশ্য দেখে সে তো অবাক! আমি তার হেলিকপ্টারে বসা মাত্র সে আমাকে নিয়ে চলল কিউবার দিকে। ধীরে ধীরে আমার শরীর আগের রূপে ফিরে এল। সে তাও প্রত্যক্ষ করল। এতক্ষণ সে কোন কথা বলে নি। চুপ চাপ হেলিকপ্টার উড়িয়ে চলছিল। এবার সে মুখ খুলল। বলল-“ এত দিন হলিউডের ছবিতে সুপার ম্যানের কাণ্ড দেখেছি। মনে করেছিলাম ও সব কল্পনা। কখনো বাস্তবে এমন দেখতে পাব তা স্বপ্নেও ভাবি নি”। আমি ওর উত্তরে একটি কথাই বলে ছিলাম যে, তুমি যা দেখেছ দেখেছ তা কাউকে প্রকাশ করবে না। তাতে সমাজে বিপদ নেমে আসবে সবার জন্য”। ও আমার সেই কথা রেখেছে। এত দিন তো হয়ে গেল আমি ঘরে ফিরে এসেছি। কাউকে বলেছে তা শুনি নি। সে কেন বলেনি এমন কথা? ভয়ে নাকি ভালোবাসায় তা বলতে পারব না। তবে সেখান থেকে কিউবাতে ফিরে আর জামাইকা বা পুয়ের্তো রিকোতে যাওয়া হয়নি। ওখানের প্রোগ্রাম বাতিল করে দেশে ফিরে এসেছিলাম। এলিয়েন নিয়ে ভাবনা চিন্তা করব বলে।