Spread the love

ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য

★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★-Jan-23
কাব‍্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– ৩৮
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

।। শল্য পর্ব ।।
১। কৃপ– দুর্যোধন সংবাদ।

কৌরবের দুরবস্থা করি দরশন,
কৃপাবিষ্ট কৃপাচার্য দুর্যোধনে কন,
যুদ্ধ ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম ক্ষত্রিয়ের কাছে।
এর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আর কিবা আছে।।
প্রতিপক্ষে যদি রয় আত্মার আত্মীয়,
তথাপি যুঝিতে হইবে হইলে ক্ষত্রিয়।।
যুদ্ধ-মৃত্যু ধর্ম তার জানে সেই জন।
অধর্ম তাহার কাছে যুদ্ধ পলায়ন।।
হয়েছেন গত স্বর্গে কত মহারথ।
গত ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আর জয়দ্রথ।।
কেবা দেবে উপদেশ কৌরব আশ্রয়।
যারে পেয়ে সেনাগণ সমরে নির্ভয়।।
সাধুস্বভাব পাণ্ডব অতি সৎ জন।
গরহিত আচারণ কেন অকারণ।।
তার ফল উপস্থিত হলো এইক্ষণে।
মৃত্যু শিয়রে মোদের জানি আমি মনে।।
বৃহস্পতি-নীতি কথা করহ শ্রবণ।
অবশ্যই সেই নীতি করিবে পালন।।
বিপক্ষ হইলে ক্ষীণ যুদ্ধ তার সনে।
নচেৎ সন্ধি করিবে রেখ ইহা মনে।।
কুরুদল হীনবল অতএব সন্ধি।
যুধিষ্ঠির যুদ্ধে স্থির নাই তার ফন্দি।।
কৃষ্ণ-বচনে দেবেন তিনি রাজপদ।
সন্ধির কারণে মুক্ত হইবে বিপদ।।

দুর্যোধন চিন্তান্বিত ক্ষণিকের তরে।
উচিত বাক্য আপনি কহিলেন মোরে।।
কিন্তু যেমতি রোগীর ঔষধে অরুচি,
আমারও সৎ বাক্যে নাই কোন রুচি।।
রাজ্য হ’তে যুধিষ্ঠিরে করি নির্বাসন।
প্রেরিত দূত কৃষ্ণেও করি প্রতারণ।।
তাই মম বাক্য নাহি করিবে শ্রবণ।
সন্ধি ভিক্ষা তাই কেন চাহি অকারণ।।
চক্রব্যূহে অভিমুন্যে করিনু নিধন।
কৃষ্ণার্জুন করিবে না হিত আচারণ।।
কোপন স্বভাব ভীম করিয়াছে পণ,
যুদ্ধক্ষেত্রে সে আমারে করিবে নিধন।।
নির্যাতিতা দ্রৌপদীও চাহিয়া নিধন,
প্রতিদিন হোমস্থানে করিছে শয়ন।।
এই সকল কারণে জ্বলে বৈরানল।
তাই সন্ধি নাহি কভু হইবে সফল।।
সসাগরা পৃথিবীর আমি অধিশ্বর।
কেমনে হইব আমি পাণ্ডব নির্ভর।।
পাণ্ডব প্রসাদে নেই সেই রাজ্য সুখ।
পাণ্ডব দাসত্বে রবো আমি আহম্মুক ?
ক্লীব ন্যায় নাহি করি কভু আচারণ।
তাই সন্ধি নহে কভু শ্রেয় এই রণ।।
মোদের লাগি নিহত যত বীরগণ।
রণিবই তাহাদের করিয়া স্মরণ ।।
যায় যদি যাক প্রাণ আমি অর্বাচীন।
রণি রণে করি শোধ তাহাদের ঋণ।।

দুর্যোধনের বচন করিয়া শ্রবণ,
‘সাধু’ ‘সাধু’ রব করে যত বীরগণ।।
পরাজয় নিমিত্ত না করিয়া শোচন,
প্রস্তুত হইল সবে করিবারে রণ।।

২। শল্যের সেনাপতিত্বে অভিষেক।

দুর্যোধনে কহিলেন কুরু বীরগণ।
চালনা করিবেন কে এই মহারণ ।।
অতঃপর দুর্যোধন করেন গমন,
অশ্বত্থামা সকাশেতে ল’য়ে আবেদন।।

অশ্বত্থামা মহাবীর জানে চরাচর।
তেজ তাঁর সূর্য তুল বুদ্ধিতে প্রখর।।
গুণের সাগর তিনি রূপে অনুপম।
ভূয়োদর্শী সর্ব বিদ্যায় তিনি পারঙ্গম।।

সবিনয়ে দুর্যোধন শুধালেন তাঁরে,
কৌরবের সেনাপতি কেবা এই বারে।।
কুরুদল রক্ষিবারে আপনিই গতি।
আদেশ করুন মোরে কেবা সেনাপতি।।
অশ্বত্থামা কহিলেন শল্য সর্ব গুণী।
কুল তেজ নাম যশে সর্বগুণে গুণী।।
নিযুক্ত করুন তাঁরে কুরু সেনাপতি।
অতি দক্ষ মহাবীর মদ্র নরপতি।।

অতঃপর দুর্যোধন শল্যে তিনি কন,
কেবা শত্রু কেবা মিত্র পরীক্ষা এখন।।
মহামতি আপনিই কুরুসেনা গতি।
কুরুসেনার দায়িত্বে কুরু সেনাপতি।।

যে দায়িত্ব দিলে মোরে তুমি কুরুরাজ,
করিলাম গ্রহণ আমি কন মদ্ররাজ।।
রাজ্য ধন প্রাণ যাহা রয়েছে আমার,
সব তাহা দিতে পারি হিতার্থে তোমার।।
পুলকিত হ’য়ে তাঁরে কন দুর্যোধন,
সেনাপতি পদে আজি করিনু বরণ।।
দেবগণের রক্ষক কার্তিক যেমতি,
কুরুদলের রক্ষক আপনি সেমতি।।

দুর্যোধনে কহিলেন শল্য মদ্ররাজ,
কৃষ্ণার্জুন রথীশ্রেষ্ঠ নহে মহারাজ।।
মনে যদি কর শ্রেষ্ঠ অতি বড় ভুল।
বাহুবলে নহে তারা কভু মম তুল।।
সুরাসুরে রোধিবারে অস্ত্র মোর আছে।
পাণ্ডবেরা সকলেই শিশু মোর কাছে।।
তাই বলি দুর্যোধন নাই কোন ভয়।
পাণ্ডবে করিব আমি সহজেই জয়।।

অভিষিক্ত হইলেন শল্য সেনাপতি।
হইলেন পুলকিত তাহে কুরুপতি।।
আনন্দিত কুরুসেনা করে ব্যাঘ্রনাদ।
শ্রবণে পাণ্ডবগণ গণিল প্রমাদ।।
*
শল্য কুরুসেনাপতি মহা ধনুর্ধর।
হে কৃষ্ণ, কিবা কর্তব্য কহ অতঃপর।।
তুমি নেতা তুমি ত্রাতা তুমি মহাবীর।
পাণ্ডব শিবিরে কৃষ্ণে কন যুধিষ্ঠির।।
হেন বচন শ্রবণে কৃষ্ণ তাঁরে কন,
বিক্রমে ব্যাঘ্র আপনি ভরত নন্দন।।
জানি আমি শল্য রণে অতীব নিপুন।
যুদ্ধ বিশারদ তিনি আছে নানা গুণ।।
ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ তুল হয় শল্য-বল।
তথাপি বধিতে শল্যে আপনি সফল।।
মদ্ররাজ আপনার সম্পর্কে মাতুল।
তথাপি বধিতে তাঁরে কভু নহে ভুল।।
ক্ষত্রধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম রাখিবেন মনে,
ধর্মযুদ্ধে পিতা-পুত্র স্থান নেই মনে।।
ভীষ্ম – দ্রোণ – কর্ণ সিন্ধু হ’য়ে উত্তরণ,
শল্যের মত গোষ্পদে নহে নিমজ্জন।।

যুধিষ্ঠিরে কৃষ্ণ দিয়া হেন উপদেশ,
প্রদোষকালে শিবিরে করেন প্রবেশ।।
★★★★

।। শল্য বধ।।
[ অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধ ]

পরদিন প্রাতে যত কুরুবীরগণ,
একসাথে সবে মিলি করে আলোচন।।
একা একা যুদ্ধ নয় পাণ্ডবের সনে।
মিলিত হইয়া সবে রণিবেন রণে।।

সর্বোতভদ্র ব্যূহ শল্য করেন রচন।
ব্যূহ অগ্রে স্থিত যত মদ্রবীরগণ।।
ত্রিগর্তসেনা বামেতে কৃতবর্মা সাথে।
যবনসেনা ডাহিনে কৃপাচার্য সাথে।।
স-কম্বোজ অশ্বত্থামা পৃষ্ঠদেশে স্থিত।
দুর্যোধন মধ্যদেশে সাথে কুরু যত।।

ব্যূহবদ্ধ হলো যত পাণ্ডুসেনাগণ।
দ্বিধা ভঙ্গ হ’য়ে তারা করিল গমন।।
আরম্ভিল মহারণ ভীষণ তুমুল।
রথ ছোটে হস্তি ছোটে লাগে হুলুস্থূল।।

শল্য-পুত্র পরাভূত সহদেব-হাতে।
শল্য-অশ্ব হলো নষ্ট ভীম-গদা ঘাতে।।
শল্যের তোমরে বিদ্ধ ভীম বৃকোদর।
করিল আহত তাঁরে শল্যের তোমর।।

তিন শত রথী সাথে অশ্বত্থামাবীর,
অর্জুনের সাথে যুঝে মহারণবীর।।
যুধিষ্ঠির কহিলেন তাঁর ভ্রাতাগণে,
শল্যে বধিব আজিকে এই মহারণে।।
নতুবা শল্যের হস্তে মরণে বরণ।
লভিয়া মরণ স্বর্গে করিব গমন।।
পূর্ণ কর রথ মোর অস্ত্রের সম্ভারে।
মহারণ হবে আজ শল্য সংহারে।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন বামে আর সাত্যকি ডাহিনে।
অর্জুন থাকুক পিছে আমারে রক্ষণে।।
ভীমসেন অগ্রভাগে যদি থাকে ঠিক।
শল্যাপেক্ষা শক্তি মম হইবে অধিক।।

যুধিষ্ঠিরের আদেশ করিয়া শ্রবণ,
প্রিয়কামিগণ তাহা করেন পালন।।
যুধিষ্ঠির মদ্ররাজ মত্ত তাঁরা রণে।
দুই শার্দূল যেমতি পরস্পরে রণে।।
যুধিষ্ঠির যিনি চির মৃদু ও নরম,
রণিছেন রণে তিনি অতি পরাক্রম।।
বিনষ্ট রণে শল্যের রথাশ্ব সারথি।
আইলেন অশ্বত্থামা অতি দ্রুত গতি।।
শল্যে ল’য়ে যান তিনি তফাতে অদূরে।
ক্ষণপরে শল্য রণে আইলেন ঘুরে।
যুধিষ্ঠিরের রথাশ্ব হত শল্য হাতে।
শল্যের রথাশ্ব হত ভীম-গদাঘাতে।।

যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ-বাক্য করিয়া স্মরণ,
বধিতে মাতুলে তিনি করেন যতন।।
‘পাপী তুমি হত হও’ কহিয়া তখন,
মন্ত্রসিদ্ধ অস্ত্র এক করন ক্ষেপন।।
যেমতি পতিত উল্কা ধরণীর টানে,
সেমতি ধায়িল অস্ত্র দ্রুত শল্য পানে।।
বিদীর্ণ বিশাল বক্ষ ভেদি বর্ম তাঁর।
দেহ পড়ে ভূমে বাহু করিয়া বিস্তার।।
হেরি তাই কুরুসেনা ভয়ে সবে ভীত,
হাহাকার করি সবে হলো পলাইত।।
সাত শত কুরুরথী তাহারা সকলে,
ত্যাজি কুরুদল আসে পাণ্ডবের দলে।।
দুর্যোধন-অনুরোধে আসিয়া আবার,
প্রবৃত্ত হইল সবে যুদ্ধে পুনর্বার।।
আসিয়া অর্জুন রণে হেনকালে তথা,
করেন পীড়ন শত্রু ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্র যথা।।
কুরুসেনা তারা হলো অতি ভয়ে ভীত।
চঞ্চল হইয়া তারা সবে পলাইত।।
বিজয়ী পাণ্ডব দল পুলকিত মন।
শঙ্খ-ধ্বনি, ব্যাঘ্র-নাদে কাঁপিল ভুবন।।
★★★
( চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *