রহস্য আর রহস্য নেই
*মৃন্ময় ভট্টাচার্য*
ভারত তথা পৃথিবীর সবথেকে রহস্যময় ব্যক্তির জীবন রহস্য আজ উন্মোচিত, শুধু সরকারি স্বীকারোক্তিটুকু বাকি।
আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন ” You can fool some of the people all of the time and all of the people some of the time, but you cannot fool all the people all of the time.” সুতরাং সকল ব্যক্তিকে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো কখনোই সম্ভব নয়।
গত ৭৫ বছর ধরে ভারত সরকার জনগণকে বোকা বানানোর এক অন্যায়, অনৈতিক প্রচেষ্টা করেছে এবং এখনো করেই চলেছে, বিভিন্ন প্রকার মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে । কংগ্রেস ও অকংগ্রেস সরকারের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই।
ভারত তথা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী সন্ন্যাসী নায়ক, যিনি বৃটিশ শাসকের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতেছিলেন, পরাধীন ভারতের মুক্তিদাতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল, তা জনগণের জানার অধিকার থেকে আমাদের জাতীয় সরকার ছলে বলে কৌশলে বঞ্চিত করে চলেছে,এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। কষ্ট হয় যখন দেখি নেতাজির পরিবারের সদস্যরাও এই ষড়যন্ত্রের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত।
সরকারি খরচে তিন তিনটে কমিশন বসিয়েও এই রহস্যের সমাধান করা সম্ভব হয়নি, তার প্রধান কারণ, প্রথম দুটি কমিশন জহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর হাতের পুতুলদের দিয়ে গড়া। তাই তাদের উদ্দেশ্যই ছিল সরকারি মতবাদে সীলমোহর দেওয়া, আর তার ফলস্বরূপ বিভিন্ন সরকারি উপঢৌকন পাওয়া। শাহনওয়াজ খান নেতাজীর সাথে বিট্রে করেন। মন্ত্রীত্ব, গাড়ি, বাংলোর লোভে নেহরুর পদলেহন করেছিলেন, আর বিচারপতি খোসলা, সম্পূর্ণ নেতাজী বিরোধী ব্যক্তিত্ব ও নেহরুর প্রিয়পাত্র, সেইসঙ্গে ইন্দিরা বেঁচে থাকতেই তার জীবনীগ্রন্থ লিখে নেত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু বিচারপতি মনোজ কুমার মুখার্জী ছিলেন সৎ ও নিরপেক্ষ সত্যসন্ধানী ব্যক্তিত্ব, তাই ওই সময় যে তাইহোকুতে কোন বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি তা তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করতে ভয় পাননি, সরকার তার অনুসন্ধান প্রচেষ্টায় পদে পদে বাধার সৃষ্টি করেছিল, গোয়েন্দা দপ্তরের গোপন ফাইল তাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। গুমনামী বাবা ( এটা সাংবাদিকদের দেওয়া নাম, এই কথার মানে যার কোনো নাম নেই ) যাঁকে মানুষ নেতাজী বলে বিশ্বাস করেন, তাঁর হাতের লেখার সঙ্গে নেতাজীর হাতের লেখা পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তরেখা বিশেষজ্ঞরা পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা পদ্ধতি না জানিয়ে এক কথায় “Not Matched” লিখে তাকে হতাশ করেছিল, কিন্ত রিটায়ার্ড সরকারি হস্তরেখাবিদ্ বিশ্ববিখ্যাত বি. লাল, নেতাজী ও গুমনামী বাবার হাতে লেখা প্রতিটি অক্ষরকে ম্যাগনিফাই করে ডিটেলড রিপোর্টে বলেছিলেন, দুটি চরিত্রর হাতের লেখা সম্পূর্ণ এক, এরা একই ব্যক্তি। ( Youtube এ বি. লালের বক্তব্য অতি সহজলভ্য, যখন খুশি দেখে নিন ) পরবর্তী কালে আমারিকার CIA র হস্তরেখাবিদও দুটি হাতের লেখা যে একই ব্যাক্তির তা প্রমাণ সহ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি রিপোর্টকে নাকচ করার দৃঢ়তা বিচারপতি মুখার্জি দেখাতে পারেননি।
সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরী, কলকাতা, গুমনামী বাবার দাঁতের মিথ্যা রিপোর্ট পাঠিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করেছিল। তাই তিনি পারিপার্শ্বিক অন্যান্য প্রমাণের মাধ্যমে গুমনামী বাবাই যে নেতাজী তা ১০০% বিশ্বাস করেও রিপোর্টে সে কথা লিখতে পারেননি, সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে।
কেন সে রিপোর্ট মিথ্যা ছিল বললাম, তা বিস্তারিতভাবে ব্যখ্যা করার দায়িত্ব আমারই নেওয়া উচিত।
আমরা সকলেই জানি X-Ray করলে, একটা X-Ray প্লেট ও একটা ডাক্তার দ্বারা লিখিত রিপোর্ট আমাদের দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা কিন্তু শুধু রিপোর্টের ওপর নির্ভর না করে, ঐ প্লেটটাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন।
এক্ষেত্রে আসল হলো প্লেটটাই।
DNA টেষ্টের ক্ষেত্রেও ডাক্তারী রিপোর্টের সাথে থাকে ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম।
ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম হল ইলেক্ট্রোফোরেসিস স্বয়ংক্রিয় সিকোয়েন্সিং দ্বারা করা একটি বিশ্লেষণ থেকে ফলাফলের একটি প্লট। একটি ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম ডেটার একটি ক্রম সরবরাহ করে যা একটি স্বয়ংক্রিয় ডিএনএ সিকোয়েন্সিং মেশিন দ্বারা উৎপাদিত হয়। ইলেক্ট্রোফেরোগ্রামগুলি এখান থেকে ফলাফল অর্জনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে: বংশগত ডিএনএ পরীক্ষা এবং পিতৃত্ব পরীক্ষা এভাবেই করা হয়।
যেহেতু DNA টেষ্ট সংখ্যায় খুবই কম হয়, তাই এই বিষয়টি সাধারণের কাছে অজানা ব্যাপার। এই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে সরকারি সংস্থাটি বিচারপতি মুখার্জীকে শুধুমাত্র রিপোর্টটিতে নেগেটিভ লিখে পাঠিয়েছিল। ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম তাঁকে দেওয়া হয়নি।
বিচারপতি মুখার্জী সাংবাদিক অম্লান কুসুম ঘোষ মহাশয়ের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় ক্যামেরা বন্ধ আছে ভেবে বলে ফেলেছিলেন “আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত যে গুমনামী বাবাই নেতাজী ” Youtubeএ এই সাক্ষাৎকারটি দেখতে পাবেন। কিন্তু যেহেতু সরকারি সংস্থাগুলি তাঁকে ভুল ও মিথ্যা রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তাই তাঁর হাতে কোনো ক্লিনচিং এভিডেন্স না থাকায়, “গুমনামী বাবাই নেতাজী” তা তিনি লিখতে পারেন নি।
বর্তমান মোদী সরকার নেতাজীকে বিভিন্নভাবে সম্মনিত করে চলেছেন। কিন্তু এনাদেরও শাক দিয়ে মাছ ঢাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত। শুধুমাত্র নিরামিষ ফাইলগুলো ডিক্লাসিফাই করে বলছেন, সমস্ত ফাইল প্রকাশ করা হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ও গোয়েন্দা দপ্তরের টপ সিক্রেট আমিষ ফাইলগুলো এখনো তারা সিন্দুকে বন্দী করে রেখেছেন। প্রায় পঁচাত্তর বছর আগের ফাইল প্রকাশ পেলে নাকি “আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়বে, দেশের অভ্যন্তরে নাকি রায়ট বেধে যাবে!”
এই একই বক্তব্য বলা হলো গুমনামী বাবার দাঁতের DNA টেষ্টের ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম প্রকাশ্যে আনলে।
তার মানে দুই আর দুয়ে চার হয়ে গেল। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে নেতাজী ও গুমনামী বাবা ছিলেন একই ব্যক্তি। তবে যারা জেগে জেগে ঘুমানোতে অভ্যস্থ তাদের কথা আলাদা।
আমরা অনেকেই জানি, গুমনামী বাবার তথাকথিত মৃত্যু (১৬|০৯|১৯৮৫)র পর, নেতাজীর দাদা সুরেশ বসুর মেয়ে, ললিতা বসু ফৈজাবাদে যান। গুমনামী বাবার রেখে যাওয়া সামগ্রীর মধ্যে তিনি দেখতে পান তাঁর মা’য়ের নিজ হাতে লেখা দেবরের উদ্দেশ্যে চিঠি, দেখতে পান তাঁর বাবার লেখা শাহনওয়াজ কমিশনের বিরুদ্ধে অরিজিনাল ডিসেন্ডেন্ট রিপোর্ট। দেখেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর স্বহস্তে লিখিত চিঠি। তিনি অশ্রুসজল চোখে বলেন উনি আমার রাঙাকাকাবাবু ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারেন না। এই সব জিনিস সংরক্ষণ করা অবশ্যই দরকার। তিনি ছোটেন তখনকার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর সিং-এর কাছে। তিনি যেহেতু কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী তাই তিনি বলেন এ ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। তিনি পরামর্শ দেন ফৈজাবাদ কোর্টে আবেদন করতে। তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে কোর্ট আদেশ দেয়, ঐ অজানা সন্ন্যাসীর রেখে যাওয়া প্রতিটি সামগ্রী ভিডিও গ্রাফি ও ফটো কপি করে সিরিয়াল নাম্বার দিয়ে যত্ন সহকারে ফৈজাবাদ কোর্টের ট্রেজারিতে জমা রাখতে হবে। পরে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এক রায়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে ঐ সামগ্রী সাজিয়ে একটি মিউজিয়াম করার আদেশ দেয়। অখিলেশ যাদব মিউজিয়ামটি তৈরী করেন ফৈজাবাদের রাম কথা সংগ্রহশালার দ্বিতলে। তা উদ্বোধন হওয়ার আগেই ২০১৭ সালে যোগী আদিত্বনাথ মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসলে, সেটি উদ্বোধন না করে আজও অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে । এর থেকে প্রমাণ হয় বিজেপি নেতৃত্বও মুখে যতোই নেতাজী ভক্তি দেখাক না কেন, বাস্তবে নেতাজীর মৃত্যু রহস্য তারাও উন্মোচিত করতে চায় না।
নেতাজীর ভাইপো বৌ কৃষ্ণা বসু তার মৃত্যুর কদিন আগেও বলে গেছেন, নেতাজীর মতো সাহসী বীর যোদ্ধা যে সন্ন্যাসী হতে পারেন তা তিনি বিশ্বাস করেন না, নেতাজীকে অপমান করার জন্যই এসব রটানো হচ্ছে।
কৃষ্ণা দেবী কি সুভাষ চন্দ্রের কৈশোর জীবনে তাঁর প্রিয় বন্ধু ডি.এল.রায়ের পুত্র দিলীপ রায়ে( যিনি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কেমব্রিজে পড়তেন, ভারত বিখ্যাত গায়ক, পদ্মভূষণ প্রাপ্ত গায়িকা এম.শুভলক্ষ্মীর গুরু ও ঋষি অরবিন্দের ঘনিষ্ঠ শিষ্য ও আমৃত্যু সন্ন্যাসী)-র সঙ্গে সন্ন্যাসী হওয়ার লক্ষ্যে গৃহত্যাগ করে হিমালয়ে যাওয়ার ঘটনা জানতেন না, যুদ্ধক্ষেত্রেও তাঁর পকেটে সবসময় একটি ভগবত গীতা থাকতো, সিঙ্গাপুরে প্রতিদিন মধ্যরাত্রে রামকৃষ্ণ মঠে গিয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন হতেন, তা কি তাঁর অজানা ছিল।
নেতাজীর আর এক নাতি যিনি বিজেপির নেতা, তিনি কিছুদিন আগেও টিভির পর্দায় গলা ফাটাতেন এই বলে যে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়নি, সেই তিনিই এখন একশোআশি ডিগ্রি ঘুরে বলছেন বিমান দুর্ঘটনাতেই তাঁর মৃত্যু ঘটেছে, রেনকোজির মন্দিরে রাখা চিতাভষ্ম অবিলম্বে ভারতে আনতে হবে! ঈশ্বর তুমি কি এদের ক্ষমা করতে পারবে!
মিশন নেতাজীর অনূজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষ এক DNA বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে পারেন। পরে মিশন নেতাজীর সদস্য কোন্নগরের বাসিন্দা সায়ক সেন এক RTI করে CFL কলকাতার কাছে ইলেক্ট্রোফেরোগ্রামটি প্রকাশ করতে আবেদন করেন। উত্তরে প্রথমে CFL জানায় তাদের কাছে কোনো ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম নেই, সেটা হারিয়ে গেছে। তখন সায়ক আবার RTI করে বলেন যে তার মানে CFL কোনো DNA টেষ্ট করেনি বলেই তারা ধরে নিচ্ছে, কারণ X-RAY প্লেট না থাকলে যেমন তার রিপোর্ট লেখা সম্ভব নয়, তেমনই ইলেক্ট্রোফেরোগ্রাম ছাড়া তারা কি করে DNA mismatched রিপোর্ট মুখার্জী কমিশনকে পাঠিয়েছিল?
এবার CFL ফাঁপরে পড়ে যায়, উত্তরে তারা বলে ” এটি তাদের কাছেই আছে, কোনো ব্যক্তি বা বেসরকারী সংস্থার হাতে তা দেওয়া যাবে না, শুধুমাত্র কোর্ট বা সরকারের আদেশে এটি প্রকাশ করা যেতে পারে, তাছাড়া এটি প্রকাশ্যে আনলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পরবে, দেশের অভ্যন্তরে রায়ট বেধে যাবে!”
ভাবুন একেকবার তাদের বক্তব্য একেক রকম। ঐ সন্ন্যাসী যদি নেতাজী না হয়ে থাকেন, তাহলে একজন সাধারণ সন্ন্যাসীর জন্য কিভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে? কেন একজন সাধারণ মানুষের পরিচয় প্রকাশ্যে এলে দেশে দাঙ্গা বেধে যাবে?
মিশন নেতাজীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, ভারতের দেশনায়কের প্রতি তাদের যে ভালোবাসা ও সত্য উদ্ধারে যে নিরলস শ্রম তারা ব্যয় করছে তার জন্য। সুভাষের সুবাসে আজ নব প্রজন্ম উদ্বেলিত, আর দেরী নেই, সত্যের জয় অতি নিকটেই। আমরা করবো জয়, নিশ্চয়।
জয় হিন্দ্।
চুঁচুড়া
তথ্যসূত্র – কোনানড্রম- চন্দ্রচূড় ঘোষ
অনূজ ধর
ঐ মহামানব আসে – চারণিক
চক্রবূহে নেতাজী –
কেশবলাল ভট্টাচার্য