Spread the love

২০২৩ এ পড়া ভালোলাগার বই

প্রশান্ত ভৌমিক 

 

চেষ্টা থাকে প্রতিদিন একটি করে বই পড়ার। পেশাগত ব্যস্ততাসহ নানা কারণে সবসময় হয়ে ওঠে না তা। তবে পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া লিখে রাখতে ভুল হয় না কখনোই। ২০২৩ এ পড়া সকল বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া পড়তে বসে দেখলাম বেশ কিছু বই পড়ে খুব আপ্লুত হয়েছি, আবার অনেকগুলো বই পড়ার পর ছিড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হয়েছে। ভালো-মন্দ তো মেশানো থাকবেই, তবে সবসময়েই চেষ্টা থাকে ভালোটুকু সবাইকে জানানোর। আর তাই পুরো বছরের পাঠপ্রতিক্রিয়া থেকে বাছাই করা ১০টি ভালোলাগার বইয়ের কথা আলোচনা করব আজ। উল্লেখ্য যে বইগুলোর ক্রম বইয়ের নামের অক্ষরানুযায়ী করা। কোনোভাবেই ভালোলাগার ক্রম অনুযায়ী করা নয়। পাশাপাশি এটাও উল্লেখ্য যে এই বইগুলো কবে প্রকাশ হয়েছে সেটা বিবেচ্য নয়। এখানে শুধু সেই বইগুলোকে বিবেচনা করা হয়েছে যেই বইগুলো আমি ২০২৩ সালের মধ্যে পড়েছি।

📑 অগোচরা। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের তিনটি বই পড়েছি এই বছর। সবগুলোই ভালো। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে অগোচরা। ইংরেজি স্নাইপারকে লেখক বাংলায় ‘অগোচরা’ বলে অভিহিত করেছেন। ঢাকা থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে ঢাকা– দারুণভাবে ডালপালা ছড়িয়েছে গল্পের। লেখার ভাষার কারণেই দুর্দান্ত লেগেছে পড়তে। সংলাপগুলোও যথাযথ। অনেক জায়গাতেই লেখকের পরিমিতিবোধের দারুণ উদাহরণ পাওয়া যায়।

 

📑 অন্দরমহল। সাদাত হোসাইন

সাদাত হোসাইনের পাঁচটি উপন্যাস পড়েছি এই বছরে। প্রত্যেকটিই দারুণ। তবে ‘অন্দরমহল’ অনন্য। এই উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া কী লিখব! একটা উপনাসের কাহিনিতে যা যা চাই, তার সবকিছুই পেলাম। লেখকের লেখার মাধুর্যে অবনীন্দ্রনারায়ণ, দেবেন্দ্রনারায়ণসহ সকলকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। বিনয়ের সঙ্গে বলি, আমার মনে হয় এই উপন্যাসটি সাদাত হোসাইনকে বাংলা সাহিত্যে এক দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যাবে।

 

📑 একাকিনী। সমরেশ মজুমদার

ইতিরানীর বিয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের গল্প। একলা লড়াইয়ের গল্প। সমরেশ মজুমদারের মিষ্টি কলমে বেশ উপভোগ করলাম এই উপন্যাসটি। মাঝখানে অল্প সময়ের জন্য কলকাতায় আসা ভালো লেগেছে। বাকি সময় গ্রাম, নদীপারের নির্জনতা এই উপন্যাসকে বেশ একটা গাম্ভীর্য দিয়েছে। সমরেশ নিজেকে ভেঙেছেন এই উপন্যাসে৷ চেনা উত্তরবঙ্গ থেকে বেরিয়ে চরিত্রদের নিয়ে কলকাতার কাছাকাছি কোনো গ্রামে।

 

📑 গ্রামের নাম কাঁকনডুবি৷ মুহম্মদ জাফর ইকবাল

দীর্ঘদিন পর আবার মুহম্মদ জাফর ইকবালের কয়েকটি কিশোর উপন্যাস পড়লাম। বলতে দ্বিধা নেই, কিশোর বয়সের সেই আনন্দ এখন আর অনেক লেখাতেই পাই না। কিন্তু সেদিক দিয়ে ব্যতিক্রম বলতে হবে এই উপন্যাসটিকে। লেখক যেন টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে কিশোর বয়সে। আমিও যেন কাঁকনডুবি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের মত পাড়ি দিচ্ছিলাম পথঘাট। চার পর্বে বিভক্ত দীর্ঘ এই উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে যেন নিজের চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছিলাম।

 

📑 জোছনাকুমারী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি বই পড়েছি এই বছর। ভালো লেগেছে কয়েকটি। কিন্তু বিশেষভাবে বলতে গেলে ‘জোছনাকুমারী’ নাম উল্লেখ করতেই হয়। দীর্ঘ উপন্যাস। গড়বন্দীপুরের কাহিনি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা এবং দুই দেশ জুড়ে ব্যপ্ত উপন্যাসটি পড়তে দারুণ লেগেছে। শুধু আপত্তি করার মত জায়গা একটিই। বাংলাদেশের লোকের সংলাপগুলো যথাযথ মনে হয়নি।

 

📑 দূর দ্বীপবাসিনী। সাইফুল ইসলাম জুয়েল

নি:সন্দেহে দারুণ একটি বই। সামুরাইয়ের গল্প, সামুরাইকে খুঁজে পাওয়ার গল্প। দুর্দান্ত লাগল। শেষে সামুরাইয়ের মেয়ে ও নাতনিকে নেপাল থেকে খুঁজে পাওয়ার অংশটা বেশ ভাল। বেশ ঝরঝরে লেখাটির মধ্যে শুধু একটিই খুঁত আমার কাছে মনে হয়েছে- দু-এক জায়গায় অতিরিক্ত উপমার ব্যবহার। তাছাড়া বাকিটার ক্ষেত্রে বলব, মনে হচ্ছিল লেখক সামনে বসে গল্প বলে যাচ্ছিলেন।

 

📑 পারো দরিয়া। বিমল লামা

লোচন দাস শব্দকর কিংবা বজ্রযোগিনী- বিমল লামার ভাষা কিংবা লেখার গণ্ডি একটি অন্যটির চাইতে আলাদা। যেমন এই বছর পড়া উপন্যাস ‘পারো দরিয়া’ একেবারেই আলাদা৷ আসামের এক মেয়ে পার্বতীর বিয়ে হয় রাজস্থানের এক গ্রামে। অশিক্ষিত বর্বর এক পরিবারের পারিবারিক কলহের জেরে প্রাণ যায় স্বামীর। দুর্বিসহ হয়ে ওঠে পার্বতীর জীবন। পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই খুব মন খারাপ লাগছিল। কিন্তু লেখকের লেখার প্রশংসা করতেই হয়৷

 

📑 মহাপুরুষ টু দি পাওয়ার টেন। মোস্তফা মামুন

জাবেদ কি সত্যিই মহাপুরুষ? অঞ্জনের দিক থেকে চিন্তা করলে তো বটেই। বেশ সরল গদ্যে লেখা মোস্তফা মামুনের এই উপন্যাসটি মনে দাগ কেটেছে। চরিত্রগুলোর সংলাপ কিংবা লেখার বর্ণনা- কোথাও অহেতুক পাণ্ডিত্য দেখাতে গিয়ে জটিল করে তোলেননি লেখক। সহজিয়া এই ব্যাপারটাই উপন্যাসে বেশ ভালো লেগেছে। প্রায় সবার ক্ষেত্রে নির্মোহ থাকলেও জাবেদের ব্যাপারে কোথাও গিয়ে যেন বুকটা হু হু করে ওঠে।

 

📑 সর্বংসহ কালীগুণীন৷ সৌমিক দে

কালীগুণীনের গল্প বরাবরই আমার প্রিয়। এই বইটিতে রয়েছে দুটি উপন্যাস আর একটি গল্প। গল্পের ভাষা, ভঙ্গি সব মিলিয়ে বেশ দারুণ লেগেছে। রহস্য শুরু থেকে শেষ অবধি বেশ জমজমাট, নড়ার সুযোগ নেই। সৌমিক দের গদ্যভঙ্গি নিয়ে খুব একটা বলার কিছু নেই।

 

📑 সেই সময়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দুই পর্বের দীর্ঘ এই উপন্যাসটির প্রথম পর্ব পড়লাম কেবল। এক পর্বেই দারুণ মুগ্ধ। ১৮৪০ থেকে কাহিনি শুরু। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রানী রাসমণি থেকে শুরু করে বাস্তবের অনেক চরিত্রই এসেছেন কাহিনির প্রয়োজনে। পুরো সময়টা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন লেখক। কখনো নবীনকুমারের জন্য মন কেমন করছিল তো কখনো চন্দ্রনাথের জন্য। কখনো বা মনে হয়েছে গঙ্গানারায়ণই বোধহয় হতভাগ্য। কিন্তু প্রথম পর্বের শেষে গিয়ে যে আকর্ষণ লেখক ঝুলিয়ে দিয়েছেন গঙ্গানারায়ণ আর বিন্দুবাসিনীর মধ্য দিয়ে, খুব দ্রুতই এই উপন্যাস শেষ করতে হবে। প্রশ্ন আসতে পারে, যে উপন্যাস পড়াই শেষ হয়নি তার পাঠপ্রতিক্রিয়া কীভাবে আসে! এক্ষেত্রে ক্ষমাপ্রার্থনা করে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, অসীম মুগ্ধতার কথা না বলে পারিনি।

 

পাদটীকা হিসেবে বলে যাই, এই বইগুলো নিয়ে আলোচনা কেবলই আমার ব্যক্তিগত মত। মনে আছে, ২০২৩ সালের শুরুর দিনে একটি লেখা লিখেছিলাম ২০২২ এ পড়া ভালোলাগার বইগুলো নিয়ে। এক প্রবীন লেখকের কাছ থেকে ব্যক্তিগত আক্রমণও সহ্য করতে হয়েছিল সেই লেখার কারণে। যাই হোক, কোনো বিতর্কে না গিয়ে সবার জন্য শুভ কামনা জানিয়ে শেষ করি৷ সবার পাঠ আনন্দময় হোক।

 

প্রশান্ত ভৌমিক : pbkchithi@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *