রেজাল্ট
মিলন পুরকাইত
বাপ মেয়ে স্কুলে এসেছি। ভীষণ উদ্বিগ্ন মেয়ে, ততোধিক উদ্বিগ্ন আমি। চাট্টি খানি কথা! ক্লাস টু এর রেজাল্ট যে আজ!
মেয়ে ভয়ে ভয়ে ভেতরে চলে গেল। আমরা অগণিত উৎকণ্ঠিত বাবা-মায়েরা দাঁড়িয়ে বাইরে। কেউবা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন বড় গেটটার সামান্য ফোকর দিয়ে। কেউবা এর তার কাছে খোঁজ নিচ্ছেন কখন রেজাল্ট আউট হতে পারে। অথবা যদি কিছু লেটেস্ট নিউজ পাওয়া যায়।
বাইরে গার্জিয়ানদের আলোচনা চলছে। ঘুরেফিরে আসছে টিউশন টিচারের কথা। ম্যাডামদের কথা, এমনকি গেট ম্যানের কথাও।
আধঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ খুলে গেল স্কুল গেটের দরজা। বাচ্চারা কিচিরমিচির করতে করতে ছুটে এসে বাবা মায়ের হাতে তুলে দিচ্ছে মার্কশিট। কি আনন্দ তাদের আজ!
দূর থেকে আমার মেয়েটাকে দেখলাম মনমরা হয়ে মাকশিট হাতে ফিরে আসছে ধীর পায়ে। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ।
এসেই কাঁদো কাঁদো হয়ে মেয়ে বলল, আগে বলো মারবেনা।
আমি অবাক। মেয়ে কাঁদছে কেন! অথবা তার এই ধারণা হলো কী করে যে আমি মারবো! আগে কোনদিন তো মারিনি! গায়ে হাত তোলার কথা ভাবিই নি।
অভয় দিয়ে বললাম, মারবো কেন?
মেয়ে আমার ঢোক গিলে হাত উঁচু করে দেখিয়ে বলল, জানো! ঐশীর মা ঐশীকে ঠাস করে একটা চড় মেরেছে।
আমি বললাম, কেন? চড় মেরেছে কেন?
অংকে কম নম্বর পেয়েছে বলে।
আমি অবাক। কে কাকে চড় মেরেছে তা নিয়ে মেয়ে এত উদ্বিগ্ন! এত আশঙ্কা! শেষে বললাম, কিন্তু, আমি তোমায় মারব কেন?
আমিও কম পেয়েছি বাবা!
চিন্তায় পড়ে গেলাম। মেয়ে ফেল করেনি তো! উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম দেখি মার্কশিট দেখি।
মার্কশিট হাতে নিয়ে দেখলাম সত্যি মেয়ে কম নম্বর পেয়েছে। হয়তো আরো ভালো নম্বর পেতে পারতো। অথবা আরও কম। কিন্তু ওর তো এই বয়সে নম্বর সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকারই কথা নয়। অথচ সে উদ্বিগ্ন। আশ্চর্য!
মেয়েকে কোলে তুলে বললাম, ঐশী দুষ্টুমি করেছে বলে মেরেছে। কম নম্বর পেয়েছে বলে মারেনি নিশ্চয়।
না বাবা! মারছিলো আর বলছিল, কেন কম পেয়েছিস বল! কেন কম পেয়েছিস বল!
কিন্তু তুমি তো অনেক বেশি নম্বর পেয়েছ। অনেক বেশি।
এই নম্বর নিয়েই তুমি উঁচু ক্লাসে পড়তে পারবে, অনেক বড় হতে পারবে। তোমার তো কোন চিন্তাই নেই। তুমি আমার থেকেও ভালো। তোমায় মারবো কেন? তুমি চিন্তা করোনা।
আশ্বাস পেয়ে মেয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, আমিও কম পেয়েছি, তাই ভাবলাম তুমি মারবে। কম পেলে তাহলে মারেনা বল!
না না কক্ষনো না। মারবে কেন?
মেয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আদরের সুরে বলল, তাহলে একটা ক্যাডবেরি কিনে দাও বাবা।
ক্যাডবেরি? নিশ্চয়ই কিনব, আজকে আমরা ক্যাডবেরি কিনব, খেলনা কিনবো, বারবি ডল কিনবো। আরো অনেক কিছু কিনব।
সত্যি!
সত্যি।
মেয়ে আমার খুব খুশি। খুব খুশি।
এটি একটি স্কুলের সামান্য ঘটনা মাত্র। বাচ্চারা দেখে যেমন শেখে তেমনি দেখে কষ্টও পায়। আতঙ্কিত হয়। মনে গভীর রেখাপাত করে।
শিশুমনের খবর আমরা কজনা রাখি। শিশুমনের চাহিদা আমরা কজনা বুঝি। শুধু নিজের শিশু নয় অন্য শিশুদেরও আতঙ্কিত করার দায়িত্ব আমি নিতে পারিনা। প্রকাশ্যে শিশুমনে আঘাত দেয়া পাপ, একপ্রকার অপরাধও।
স্কুল চত্বরে শিশুমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী এমন আচরণ বেদনাদায়ক। পাক না একটু কম নম্বর। তা নিয়েই আমরা আনন্দে থাকি। ওরাও থাক সুস্থ।