মাস্টার মশাই
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
আজ আশি বছর পূর্ণ হোল মাস্টার মশায় এর, অর্থাৎ শ্রী দেবাঞ্জন দাশের। ছেলে-বৌ-নাতি-নাতনিরা থাকে বোস্টনে। আর মেয়ে-জামাইরা Settled লিসবনে। স্ত্রী অনুরাধা গত হয়েছেন দু-বছর আগে। হৃদয়পুরের পায়োনিয়ার পার্কের বাড়ীতে উনি থাকেন একা। কাজের লোক গদাই আছে বটে; কিন্তু, সব কাজই নিজে করে নেন; করে নিতে ভালোও বাসেন। কবে যে birth day, কবে যে marriage day, এসব তাঁর ঠিক থাকে না, আজও ঠিক নেই। কিন্তু, সব না হলেও, কিছু ছাত্র ছাত্রী আছে, যারা আজও তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসে। এদেরই মধ্যে রাজিবুল, শাজাহান, মলয়, তপন, চয়ন, এই আট দশজন প্রাক্তন ছাত্র ফুল, মিষ্টি উত্তরীয় নিয়ে হাজির স্যারের বাড়িতে। স্যার তখন বাড়ীর সামনের বাগানের বেড়া বাঁধছেন।
সেই অবস্থাতেই সবাই স্যারকে প্রণাম কোরলো, মালা পরালো, মিষ্টি মুখ করালো।
আপ্লুত হয়ে বৃদ্ধ শিক্ষক বললেন– চল বাবা, সবাই ঘরে চল। তোমাদের মাসীমা আজ থাকলে যে কি খুশী হতেন!
নিত্য সহচর গদাইকে হাঁক পেড়ে বললেন–কোথায় গেলিরে বাবা। এই দাদা বাবুদের জন্যে মোগলাই বানা।
–না না, স্যার, ওসব কিছু লাগবে না।
–তাহলে তোমাদের দেওয়া ভালোবাসার আতর-কস্তুরী মাখা এই ফুল, উত্তরীয় মিষ্টিগুলোও আমার লাগবে না। তোমরা ফেরৎ নিয়ে যাও।
— আমাদের অন্যায় হয়েছে স্যার। আমরা গদাইদার হাতে বানানো খাবার সবাই খাবো।
খুশীতে ডগমগ হয়ে দেবাঞ্জন বাবু বললেন–পেটভরে সবাইকে মোগলাই খাওয়াতে হবে গদাই।
–ঠিক আছে জ্যাঠাবাবু। আমি এক্ষুনি সব ব্যবস্থা করছি।
–জানো বাবা রাজিবুল, মলয়, শাজাহান। জীবনে আমি অগুন্তি ছাত্র ছাত্রী তৈরি করেছি। অধিকাংশই উচ্চপ্রতিষ্ঠিত, এবং খুব বুদ্ধিমান। তাই তারা কেউ আমায় মনে রাখেনি, মনে রাখেনা। এই দেশটাকেও না, দেশের মানুষগুলোকেও না। দেশের মানুষ গুলোকে, বিশেষকরে গরীব মানুষগুলোকে তারা ঘেন্না করে, ওদেরকে ভিখিরি জ্ঞানে তাচ্ছিল্য করে। অথচ ওদেরকে গড়তে এই মানুষগুলোর মেহনতের কত পয়সা যে দেশ ওদের পিছনে ব্যয় করে, তা ওরা স্বীকার করে না। আর আমায় দেখলে না চেনার ভান করে ওরা সিগারেট ফোঁকে, তার ধোঁয়া দেয়।
একটু থেমে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে স্যার বলেন– তোমরাও প্রতিষ্ঠিত, তবে অতোটা উচ্চ প্রতিষ্ঠিত নও; আর তার চেয়েও বড় কথা, তোমরা ওদের মতো অতো বুদ্ধিমান নও, আমি তোমাদেরকে অতো বুদ্ধিমান হিসাবে গড়ে তুলতে পারিনি। তোমরা বোকাই রয়ে গেছো। তাই মনে করে আজ আমার কাছে এসোছো। আমি আশীর্বাদ করি, তোমরা সারা জীবন এমনই বোকা থেকো এবং সব সময় সাধ্যমতো গরীবদের পাশে দাঁড়িয়ো।
–স্যার, আপনার এই আশীর্বাদ আমাদের পাথেয় হবে। চয়ন উত্তর কোরলো–কিন্তু স্যার, আমাদের সবার একটা বিনীত প্রশ্ন আপনার কাছে।
–কি বলো বাবা। অবশ্যই উত্তর দেব।
স্যার, এই বয়সেও কি আপনার এত পরিশ্রম না করলে নয়?
পরিশ্রম কোথায়? এটা তো আমার দায়বদ্ধতা বাবা।
–তার মানে স্যার?
–দেখো বাবা, আমি Science-এর শিক্ষক ছিলাম। তোমাদেরকে Physics ও Chemistry পড়াতাম। আবার, আমার পারিবারিক ঐতিহ্য ও জানার আগ্রহ থেকে দর্শনও নিবিড়ভাবে পড়েছি। অনেকে বলে Where Science ends, Philosophy begins. অর্থাৎ, যেখানে বিজ্ঞানের শেষ, দর্শনের সেখানে শুরু। কিন্তু আমার উপলব্ধি হোল যে একথাটি একেবারেই ভুল। বিজ্ঞান ও দর্শন একই জ্ঞানের দুইটি ধারা: ভিন্ন ভিন্ন পথে বয়ে অবশেষে গিয়ে মিশেছে একই মহাসাগরে। দর্শনের সার কথা হোল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের সত্তা পঞ্চভূতে মিশে যায়। আবার বিজ্ঞানও বলে প্রতিটি বস্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে অজস্র অণু পরমাণুতে পরিণত হয়ে এই মহাবিশ্বেই বিরাজ করে। বিজ্ঞান ও দর্শনের একই রা: এখানে কোন কিছু নতুন করে সৃষ্টি হয় না। কোন কিছু লয়ও হয় না; শুধু রূপান্তর হয় মাত্র; সবাই খোলস পাল্টায় মাত্র। এই মহাবিশ্বে সবাই থাকে। আমিও মৃত্যুর পরে এখানেই থাকবো। দর্শনের ভাষায় পঞ্চভূতে মিশে, বিজ্ঞানের ভাষায় অণু পরমাণুর মাঝে। হয়তো বা জলবিন্দু হয়ে, হয়তো বা মহাশূন্যে নীল আকাশের বুকে। তাই আমার বিরাম নেই মলয়, বিরাম নেই রাজিবুল, জীবনে মরণে এই পৃথিবীটাই তো আমার স্থায়ী ঠিকানা। তাই তাকে সুন্দর রাখতে আমি নিরন্তর কাজ করি; এই যেমন বেড়াটা বাঁধছিলাম।
মলয়-অয়ন-রাজিবুলরা সবাই হয় কলেজ শিক্ষক, না হয় উচ্চ পদের শিক্ষা-অধিকর্তা। বসিরহাটের দক্ষিণ বাগুণ্ডী প্যারীলাল হাইস্কুলের বহু স্মৃতিসুধা মাখা অশীতিপর বৃদ্ধ, বহু বছরের চেনা জানা স্যারকে যেন তারা আজ নতুন করে চিনলো। জ্যাঠাবাবুর জন্মদিনের খুশীতে গদাই এদিকে তখন ওঁর প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতের গানের সিরিজ ছেড়ে দিয়েছে।
ঠিক ওই মুহূর্তে ভেসে আসছে–
আমার মাথা নত করে দাও হে
তোমার চরণ ধূলার তলে।”
পরম শ্রদ্ধায় দশটি মাথা নত হয়ে আসে বৃদ্ধ শিক্ষকের এই কথা শুনে।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত