Spread the love

অণুগল্প : মায়ের ভাষা
কলমে : ডঃ রমলা মুখার্জী

ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলে পড়ুয়া দশ বছরের মৌ তার বাবাকে প্রশ্ন করে, “কি বই কিনলে O my dear dad?”
সুজয় বলে, “কিনিনি রে, আজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষের বার্থ ডে অনুষ্ঠানে দিয়েছে। এটা বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ। ঠিক দুশো বছর আগে জন্মগহণ করে এই মহামানব বিদ্যাসাগর বাংলাভাষা, বাঙালির পড়াশোনা, মেয়েদের উন্নতি, বিধবাদের বিয়ে, বাল্য-বিবাহ রোধ এসবের জন্য জীবন-পণ করে লড়েছিলেন। বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম যে এই বইতেই আমার প্রথম বাংলা অক্ষর পরিচয়, বাংলাকে প্রথম চেনাশোনা হয়েছিল। তুই তো বাঙালি হয়ে একবর্ণও বাংলা লিখতে দূরে থাক, পড়তেও পারিস না।”
-সেটা কি আমার দোষ? তুমিই তো দায়ী, ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি তো করালেই, আবার সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি রাখলে। মাম্মী তো বাংলা মিডিয়ামেরই পক্ষপাতি ছিল।”
-ঠিক আছে তোকে রোজ একটু সময় করে প্রথমে “প্রথম ভাগ”, তারপর “দ্বিতীয় ভাগ”, “কথামালা” এসব পড়াবো।

  • আর ঐ উইডো ম্যারেজ, আর্লি ম্যারেজ ঐ গল্পগুলো বলবে না। মাম্মী বলছিলো উনি নাকি পঁয়ত্রিশটা গার্লস স্কুল করেছেন বেঙ্গলে, আরও অনেক কিছু করেছেন, সব গল্প কিন্তু বলা চাই। এত বড় গ্রেট ম্যান, কিন্তু কিছুই জানি না। এখন তো এনাফ টাইম, তোমার আমার দুজনেরই তো স্কুল নেই।
    -বলবো তো নিশ্চয়ই, তবে তুই বাংলাটা ভালো করে শিখে নে, বড় হলে ওনার “শকুন্তলা”, “ভ্রান্তিবিলাস” এইসব অনুবাদ সাহিত্যগুলোও পড়তে পারবি। কি সুন্দর সব অনুবাদ, ঠিক মনে হবে যেন মৌলিক রচনা!
    -হিন্দি “বেতালপচ্চিশি”র কনসেপ্ট নিয়ে কি যেন বই লিখেছিলেন মাম্মী বলছিলো?
    -হ্যাঁ, “বেতাল পঞ্চবিংশতি”। তোকে বিদ্যাসাগরেরই শুধু নয়, আরও সব বাঙালি লেখকের অনেক বই কিনে দেবো। নে এখন তো তোর হাতেখড়িটা সেরে ফেলি।”
    -সেটা কি গো dad?
    -আমার ব্যাগে দেখ একটা প্যাকেট আছে, নিয়ে আয়।
    -এগুলো কি গো dad?
    -এই দেখ না, এটা হল স্লেট আর এই হল স্লেট পেন্সিল।
    -কি হবে dad এসব দিয়ে? ঐ যে হাতেখড়ি না কি যেন বললে তাই হবে?
    তোমাকে কিন্তু আমি এবার থেকে বাবা বলবো আর মাম্মীকে মা। দেখো না দুর্গা ঠাকুরকে বলে সবাই মা দুর্গা। আমার মাও তো আমার কাছে মা দুর্গাই তো নাকি বল আর তুমি আমার কাছে বাবা ভোলানাথ। ঐ যে তারকেশ্বরে সেদিন আমরা গিয়েছিলাম, সবাই বলছিল না যে “ভোলে বাবা।”
    -হ‍্যাঁ তাই বলিস মা। তুই তো আমার মা রে। মা-এই ডাকটার মধ্যে কত শান্তি! আঃ প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। তোর মা ঠিকই বলে যে শেকড়টা বাদ দিলে গাছ শুকিয়ে যাবে। নিজের মাতৃভাষা না শিখলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে রে মা। শোন মা, এবার আমার কাছে বোস মা। তোর হাতেখড়িটা মা সরস্বতীর ফটোটার সামনে সেরে ফেলি।
  • কি করে হাতেখড়ি দেবো শিখিয়ে দাও বাবা।
  • হ্যাঁ দিচ্ছি মা, আমি এই স্লেটে “অ” লিখে দেবো, তারপর তোর হাত ধরে বোলানো করাবো, তাকেই বলে হাতেখড়ি।
    মৌকে বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষ জন্ম-জয়ন্তীর শুভক্ষণে বাংলা বর্ণে হাতেখড়ি দিল সুজয়।মৌয়ের মাম্মী সব দেখেশুনে ভাবে, “যাক দেরিতে হলেও চৈতন্যের উদয় হয়েছে সুজয়েরর। কিন্তু এভাবে আর কদিনই বা বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে? বাংলাভাষা কি তবে হারিয়ে যাবে? না, না, একি ভাবছি আমি! বাংলাভাষাকে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবো না আমরা। সমবেত চেষ্টায় আমরা বাংলাভাষীরা বাংলাভাষাকে উজ্বল মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবোই করবো।”

বৈঁচী,
জেলা হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *