Spread the love

বুন্দেলখন্ডের দিনগুলি (প্রথম পর্ব)

নীরেশ দেবনাথ

EME College থেকে টেলিকমিউনিকেশন কোর্স এর গ্রেড III ট্রেনিং শেষে দু সপ্তাহের ছুটি দিলো, সেই ছুটি শেষ হলে যার যেখানে পোস্টিং হয়েছে সেই ইউনিটে যোগ দিতে হবে। দু সপ্তাহের ছুটি তো দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে গেল।

সেটা ১৯৭৩ এর নভেম্বর মাস। সাগর স্টেশনে যখন পৌঁছুলাম, রাত তখন তিনটে বাজে। স্টেশনে MCO (movement control officer) এর কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, আমাদের গাড়ী পাওয়া যাবে সকল আটটায়। এতক্ষণ কী করি! MCO অফিসটা খুবই ছোট। তবুও অফিসার আমাকে বলল, এখানেই রেস্ট করো। গাড়ি আয়েগা তো ভেজ দুঙ্গা। আমার বেডিংটা বিছিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম কিন্তু মশাগুলো নতুন রক্তের স্বাদ না নিয়ে কি করেই বা চুপ করে থাকে!

সকাল সাড়ে সাতটার দিকে গাড়ী পাওয়া গেলো। স্টেশন থেকে গাড়ি সাগর শহরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললো। একটা সুন্দর বিশাল দীঘির(তাল) পাশ কাটিয়ে পুব দিকে গিয়ে বেশ খানিকটা চড়াই চড়ে এগিয়ে চলল। ডান দিকে উঁচু পাহাড়শ্রেণী রেখে গাড়ী প্রায় দুই কিলোমিটার গিয়ে আমাকে নামিয়ে দিল। চালক দেখিয়ে দিল বাঁ দিকে আমাদের ইউনিট। কিন্তু বড় রাস্তা থেকে প্রায় এক ফার্লং দূরে আমাদের ইউনিটের ব্যারাক দেখা গেলো। বেডিং বাক্স নিয়ে কি ভাবে যাব ভাবছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

দূর থেকে হয়তো কেউ আমাকে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থাকবে। লক্ষ্য করলাম দু জন সৈনিক আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি। একজন জিজ্ঞেস করলো নতুন এসেছি কিনা। ‘হ্যাঁ’ বলতেই আবার জিজ্ঞেস করলো, কোন ইউনিট। আমি উত্তর দিতেই একজন আমার বেডিংটা, অন্যজন আমার ট্রাংকটা তুলে নিয়ে বললো, চলুন(কথোপকথন সবই হিন্দীতেই চলছিল)। আমি আমার ব্যাগটা তুলে নিয়ে ওদের অনুসরণ করলাম।

ট্রানজিট ক্যাম্পে একটা খালি খাটে আমার বেডিংটা এবং পাশে ট্রাঙ্কটা রেখে বললো, আসুন, হাত মুখ ধুয়ে ব্রেক ফাস্ট করে নিন, পরে হাবিলদার মেজরের সাথে দেখা করিয়ে দেবো।

দিন তিন চার কাটলো নিজের কাজগুলি গুছিয়ে নিতে। পোশাক – বুট, বেল্ট সমস্ত ঠিক ঠাক করে নেবার জন্য কয়েক দিন সময় পাওয়া গেলো। কমান্ড্যান্ট এর কাছে আমাদের পেশী হবে। ব্যাটেলিয়ান হাবিলদার মেজর কর্তার সিং আমরা যে তিনজন নতুন ট্রান্সফার হয়ে এসেছি তাদের বুঝিয়ে দিলো কিভাবে কর্ণেল সাহেবের সাথে কথাবার্তা বলতে হবে। যারা নতুন ট্রান্সফার হয়ে আসে বা যারা টান্সফার হয়ে অন্য ইউনিটে চলে যায় তাদের এরকম ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এর কাছে পেশ করা হয়। কিছু নয় – এটা ইন্টারভিউ – নতুনদের সাথে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের পরিচয়পর্ব আর যারা চলে যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে কোন অভিযোগ বা অন্য কোন সাজেশন আছে কিনা জানতে চাওয়া।

আমরা তিন জন। দু জন অন্য ইউনিট থেকে এসেছে এবং অন্যান্য ট্রেডের। আর আমি ট্রেনিং শেষে সোজা EME কলেজ থেকে, প্রথম পোস্টিং। এই দু জনের পরে আমার ডাক এলো। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পাঞ্জাবী হিন্দু। আমার প্রোফাইল দেখে বললেন, টেলিকম মেকানিক অর্থাৎ মেট্রিকুলেট ?
আমি বললাম, স্যার, আমি B.Sc.(Hons.). কমান্ডেন্ট বললেন, ও, আইসি, খুব ভালো, খুব ভালো, বেশ। BHM কর্তার সিং কে বললেন, কর্তার, টেকনিক্যাল সেল সে ক্যাপ্টেন সিং কো বুলাও।

ক্যাপ্টেন সিং এলে কমান্ডেন্ট সাহেব বললেন, সিং সাহেব, আপনার টেকনিক্যাল সেলে একজন এডুকেটেড লোক চেয়েছিলেন না, ইনি মিস্টার দেবনাথ, B.Sc.(Hons.). আপনাকে দিয়ে দিলাম, ঠিক আছে? এবার টেকনিক্যাল সেলের আর কোনো অনুযোগ যেন না পাই।

ইএমই(ইলেকট্রনিক্স এন্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)কোর সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত সমস্ত রকম টেকনিক্যাল সংক্রান্ত সমস্ত যন্ত্রপাতি ডিভাইস দেখাশোনা, রিপেয়ারিং, মেনটেনেন্স ইত্যাদি করে থাকে। একটি ব্যাটেলিয়ানে যেমন তিনটি ওয়ার্কশপ থাকে তেমনি একটি টেকনিকেল সেল থাকে। পুরো ব্যাটেলিয়ানের সমস্ত টেকনিক্যাল বিষয়গুলো মনিটরিং করার জন্য যা কিনা হেড কোয়ার্টার এর সাথে যুক্ত থাকে। আমাকে সেই সেলে নিযুক্ত করা হল।

টেকনিকেল সেল ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন সিং, সিএইচএম শর্মা, ভেহিকেল মেকানিক জার্নাইল সিং ও বেদ প্রকাশ – সবাই পাঞ্জাবী। আমি টেলিকম মেকানিক – পশ্চিমবঙ্গবাসী। ক্যাপ্টেন সিংয়ের চেম্বারে সকলে মিলে আমাকে ঠান্ডা রুহআফ্জা পান করিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনার সঙ্গে গ্রহণ করলো। সুন্দর সাজানো-গোছানো ছিমছাম সেল। সাজানো লাইব্রেরী – সমস্ত টেকনিক্যাল বই হ্যান্ডবুক অর্থাৎ মিলিটারীতে ব্যবহৃত সমস্ত রকম সরঞ্জামের জন্য প্রয়োজনীয় বই এবং হ্যান্ডবুক এখানে আছে।

আমাকে টেলিকম সাইডের কাজ গুলো দেখতে হবে। আমাদের এই ব্যাটেলিয়ানে যে তিনটি ওয়ার্কশপ আছে সেই ওয়ার্কশপ গুলিতে অন্যান্য মিলিটারি ইউনিট থেকে বা রেজিমেন্ট থেকে যতসব টেলিকম সেট, লাইন সেট আসবে রিপিয়ারের জন্য জন্য বা যে কোন কারনে সেগুলো ইন করা তারপর রিপেয়ার হওয়া তার স্ট্যাটাস সবকিছু আমাদের ওই ওয়ার্কশপ গুলি আমাদের এই হেড অফিসের টেকনিক্যাল সেলে পাঠাবে। এবং সে সবের মনিটরিং করা, compiling করা, হিসাব রাখা এ সব আমার কাজ। এবং প্রতিদিনের আপডেটেড হিসাব ওআইসি কে দিনের শেষে সাবমিট করা আমার কাজ। কাজ নতুন হলোও কিন্তু বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। যাইহোক, এইভাবেই আমার নতুন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পথচলা শুরু। ধীরে ধীরে কাজে খুব মন লেগে গেল।
রচনাকাল
১০ জুলাই, ২০২২
পুনে, মহারাষ্ট্র।

             -------------------------------

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *