বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আমলেই মহালয়ার মন্ত্র পাঠ করেছিলেন নাজির আহমেদ
বটু কৃষ্ণ হালদার
“আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগণ্মাতার আগমন-বার্তা।”
শরতের হিমেল ভোর। আধো ঘুম আধো জাগরণে আলগা চোখের পাতা। কানে আসে এক মন্দ্রিত কন্ঠস্বর। আলোর বেণুর মতো বেজে ওঠে সেই কন্ঠ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবাহিত হয়। বিশ্ব জুড়ে বাঙালি বছর বছর কান পেতে থাকে তন্ময় ঘোর নিয়ে। বাঙালির শারদ উৎসবের তিনি ভগীরথ। তিনি বেতার সম্রাট। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। যাকে ছাড়া বাঙালিয়ানা অসম্পূর্ণ, যাকে ছাড়া বাঙালীর সব থেকে বড় উৎসব অসম্পূর্ণ, যাকে ছাড়া দুর্গা মা-এর আগমন অসম্পূর্ণ।
প্রথম দিকে টেপরেকর্ডিং করা অনুষ্ঠানের চল হয়নি। আকাশবাণী-তে সব অনুষ্ঠানই হত লাইভ। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে যাঁরা অংশ নিতেন তাঁরা অনেকেই আগে মহড়ার জন্য চলে আসতেন বেতারে। মহড়ার অবসরে চলত চা-পান, রঙ্গরসিকতা। একবার হয়েছে কী, যথারীতি কেউ আড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন, তো কেউ বা ঘুরছেন এদিক-সেদিক। বাণীকুমার বসে আছেন রেকর্ডিং-এ। ও দিনের আগে ভাষ্য অংশ পাঠ করা হত স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতে। সুরে নয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব ধারায় চণ্ডীপাঠ করছিলেন সুরেলা কণ্ঠে। হঠাৎই অলস রসিকতার ছলে বাংলা ভাষ্যটিও স্তোত্রের সুরের অনুকরণে বলতে শুরু করলেন। তাতে চারিদিকে বেশ একটা মৃদু হাসির ভাব জাগল। …কিন্তু বাণীকুমার দ্রুত রেকর্ডিং রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “আরে আরে থামলে কেন? বেশ তো হচ্ছিল।হোক।হোক না ওই ভাবেই…।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হেসে বললেন, “আরে না না একটু মজা করছিলাম।” কিন্তু বাণীকুমার গভীর আগ্রহ নিয়ে বললেন,“মোটেই না! দারুণ হচ্ছিল! ওইভাবেই আবার করো তো।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আবার শুরু করলেন, “দেবী প্রসন্ন হলেন…।”
সেদিনই বাংলার ইতিহাসে সংযুক্ত হল এক নতুন মাত্রা। অন্য ধারায় মহালয়ার পাঠ। দুর্গাপুজোর কার্টেন রেজার।এক হলদে রঙের রোদ্দুরে মায়া যেন! শরৎ এসে হাজির হয় পুজোর আকাশে। অনেকের বাড়িতে এক সময় রেডিয়ো এসেছিল মহালয়ার আগমনী হিসেবেই, আর এই রেডিয়ো বলতে আমরা বুঝি ওই মানুষটিকে। যাঁর নাম বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র।
সাল ১৯৭৬, আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ গোপনে সিদ্ধান্ত নিলেন,বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমার চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ করবেন। গোপন সেই বৈঠকে বাদ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। তিনি কিছুই জানেন না,তবে নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের দিন রেডিয়োয় বেজে উঠল নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। চুড়ান্ত ফ্লপ হল, সমালোচনার ঝড় থামছে না, কেউ কেউ নাকি এমনও ভেবেছিলেন মহালয়ার পুণ্য প্রভাত কলুষিত হল! মানুষের দাবির কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হলেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ,সেই বছর ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সম্প্রচার করতে হয়েছিল বেতারে৷
স্টাফ আর্টিস্ট হয়েই অবসর নিয়েছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। পেনশন জোটেনি। আসলে আখের গোছানোর কথা কখনও তো ভাবেননি। অবসরের পরে, শেষ পর্যন্ত ‘মহাভারতের কথা’ বলার জন্য ক’টা টাকা পেতেন। ক্রমশ স্মৃতিভ্রংশ হয়ে আসছিল। তাতে অস্বস্তিতে পড়ছিলেন তখনকার প্রোগ্রাম অফিসার। সেই অনুষ্ঠানও আর করানো গেল না! তখন অর্থাভাব মেটাতে পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে বেড়াতে লাগলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। সেখান থেকেও যে বেশি কিছু পেতেন, তা’ও নয়। সামান্য কিছু জুটত।
বড় অভিমান ছিল তাঁর। মুখে কিছু বলতেন না। আকাশবাণীর এমেরিটাস প্রোডিউসার-এর মতো সম্মাননার পদ জোটেনি তাঁর। বলতে গেলে কিছুই মেলেনি, না কোনও সরকারি খেতাব, না পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ। মিলেছে তো কেবল গুচ্ছের চাদর আর উত্তরীয়।
রেডিয়ো-র মস্ত দায় বয়ে বেড়িয়েছেন চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত। অথচ এমন মানুষকেও কী ভাবে যে বারবার অপমানের মুখে পড়তে হয়েছে।একবারের কথা বলি। অবসর নেওয়ার পর রেডিয়ো-য় কী একটা কাজে এসেছিলেন বীরেন বাবু। ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলেন। সিংহ নামের একজন সিকিউরিটি গার্ড বীরেন্দ্র কৃষ্ণর কাছে ‘পাস’ চেয়ে বসল। সেদিন মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল ওঁর, থরথর করে কাঁপছিলেন, ফর্সা চেহারায় শিরাগুলো দপদপ করছিল।
কেবলই চিৎকার করে বলছিলেন, “জন্ম দিয়েছি রেডিয়োকে আমি! জন্ম দিয়েছি! আমিই জন্ম দিয়েছি! আমার কাছে পাস চাইছ? পাস?” মনে হচ্ছিল এ শুধু চিৎকার করে ক্ষোভ উগরে দেওয়া নয়, এর গভীরে কি লুকিয়ে আছে কান্নাও? বছরের শুধু দূর্গোৎসবের সময়েই তাঁর কথা আমাদের মনে পড়ে। কণ্ঠ ভেসে আসে, মুখ দেখা যায় না…।
এখন রেডিওর যুগ আর নেই। তবুও বছরের মহালয়ার ওই একটা দিন বীরেন্দ্র কৃষ্ণের হাত ধরে রেডিও বেরিয়ে আসে৷ বাঙালিরা মহালয়া রেডিওতেই শুনতে চায়। টেলিভিশন বা ইউটিউবে নয়৷ আবেগপ্রবণতার আরেক নাম যদি ‘বাঙালি’ হয়, তাহলে রেডিওর আরেক নাম ‘বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র’।
শরতের পুজো, পুজোর কলকাতা, কলকাতার বেতার, বেতারের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।ইনি এমন এক বাঙালি, যাঁর অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণে বেতারের অনুষ্ঠানকেই ‘মহালয়া’ বলে ভুল করেন অনেকে। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। এই অনুষ্ঠানের এতটাই জনপ্রিয়তা যে, তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানান মিথ। ‘স্তোত্রপাঠ’ বলতেই আমরা যে কণ্ঠধ্বনি বুঝি, সেই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের জন্মদিন ছিলো গতকাল।
বাঙালি বারো মাসে তেরো পার্বণ।এই তের পার্বণের মধ্যে অন্যতম বড় উৎসবের নাম হলো দুর্গাপূজা। বছরের এই কয়েকটা দিনের জন্য জাত ধর্মনির্বিশেষে আমরা সবাই অপেক্ষা করে থাকি। এটাই ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতি ,যুগের পর যুগ সম্প্রীতির এই পরম্পরা বহন করে আসছে।তবে দূর্গা পূজার নামটি শুনলেই আমাদের শৈশবের স্মৃতি কে জাগরিত করে তোলে তা হল মহালয়া।গ্রামে গঞ্জে মায়েরা আজও ঘরের দরজায় দুর্গা ফোটা দিয়ে ঘরের মেয়ে উমার আগমনীর বন্দনা গান গায়।৮০-৯০ এর দশকে এখনকার মতো বাড়িতে বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। দুই এক জনের বাড়িতে সাদা কালো টিভি ছাড়া সবাই মহালয়ার শোনার জন্য নির্ভর করত রেডিও। ভোর না হতেই প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে ভেসে আসতো মহালয়ার সুর।আর সেই সুর অবশ্যই ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছাড়া আমরা মহালয়া ভাবতে পারি না।কিন্তু সেই চিরাচরিত প্রথা কে উপেক্ষা করে ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৬ সালে। সেই বছর প্রথম একজন অ_হিন্দু মহালয়ার চণ্ডীপাঠ পাঠ করেন।
১৯৭৬ এর ‘দেবী দুর্গতিহারিনী’তে উত্তম কুমার আর চিরাচরিত ভদ্রবাবু ছাড়াও বাঙালি কিন্তু মহালয়ার সকালে অন্য একজনের কণ্ঠেও চণ্ডীপাঠ শুনেছে।নাম ছিল নাজির আহমেদ।
আসলে ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৪২ এর মহালয়ার ভোরে।স্টুডিওতে আসতে দেরি করছেন ভদ্রবাবু, এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে,তরুণ বাচিক শিল্পী নাজির এসে প্রস্তাব দিল,আমি স্কুলে থাকতে সংস্কৃতে পাকা ছিলাম, ম্যাট্রিকে লেটার মার্কসও আছে, অনুমতি দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।
কোনো রাস্তা না পেয়ে পঙ্কজ মল্লিক বললেন, “বেশ তবে করো যদি পারো।”
কিছু পরে স্টুডিওতে এসে হাজির বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, স্ত্রোত্র উচ্চারণ শুনে তিনিও মুগ্ধ হয়ে বললেন, “নাজিরই করুক নাহ,বেশ করছে তো।”
অদ্ভুতভাবে পরের বছরও একই ঘটনা, ভদ্রবাবু বলেন,“আহাঃ পঙ্কজদা, নাজির উঠতি শিল্পী, আমরা বুড়োরা আর কতদিন করবো? এরপর থেকে ওইই করুক না। গলা তো ছেলের খাসা।”
এরপর থেকে ১৯৪৬ এর শরৎ পর্যন্ত এই দায়ভার সামলে গেছেন এই মুসলমান ছেলেটাই।
মাঝে একটা বেশ বড়ো বদল ঘটে গিয়েছিল অবশ্য, কিন্তু তার খোঁজও কেউ রাখে না। ১৯৪৪-৪৫ এর মধ্যে কতৃপক্ষের সাথে মনোমালিন্যের জন্য দ্বায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান পঙ্কজ মল্লিক, তার জায়গায় আসেন উঠতি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রথম বছর একই সুরে কোনোকিছু না পাল্টে একই ভাবে অনুষ্ঠান হলেও দ্বিতীয় বছরে অন্যরকম কিছু করতে গিয়ে জনগণের মধ্যে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ১৯৪৬ এ পঙ্কজ বাবু ফিরে এলে আবার পুরোনো মেজাজে ফেরে মহিষাসুরমর্দিনী।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৪৭ এর দেশভাগ। নাজির আহমেদ ফিরলেন নিজের মাটিতে।ঢাকা রেডিওতে যোগ দেন তিনি এবং আবার পুরোনো জায়গায় ফিরতেই হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে।
যেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্ত্রোত্র উচ্চারণ নিয়েই অনেক মানুষের আপত্তি ছিল সেখানে ভারতের স্বাধীনতার আগের শেষ পাঁচ বছর একটানা আকাশবাণীর সদর থেকে গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল একজন শুধু অব্রাহ্মণ না, একজন অহিন্দুর কণ্ঠ। দেশ ভাগ না হলে হয় তো আজও সেটাই শুনতাম আমরা।
দেশ ভাগ হওয়াতে কিছু স্বার্থপর মানুষের নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ হয়েছিল,কিন্তু ধ্বংস হয়েছিল অনেক কিছুই। বুকের কষ্ট,যন্ত্রণা,চোখের জল,স্মৃতি সবকিছু ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। যা তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক নেতারা উপলব্ধি করতে পারেনি।
তবে পরিশেষে বলা যায়,উৎসবের আবার বামুন-কায়েত কি?যে ভাষায় নজরুল ইসলাম কীর্তন থেকে শ্যামাসঙ্গীত সব লেখেন সেই ভাষায় কোনো জাতপাত টানা যায়?
বটু কৃষ্ণ হালদার,
কবর ডাঙ্গা লেন
কলকাতা ১০৪
এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। অধিকাংশ মানুষ জানে বলে মনে হয় না!