বিপজ্জনক মধ্যবিত্ত
-শাহানাজ শাম্মী সোনালী
বাজারের পালিশ করা চাল খেতে পারি না বলে গ্রাম থেকে একজন নিয়মিত চাল দিয়ে যায়।লোকটা ধান কিনে চাল তৈরি করে বিক্রি করে,একেবারে নির্ভেজাল,দেশি চাল।মিনা সিং নাম তার। দিন চারেক আগেও সে চাল দিয়ে গেছে।মুসলিম ঘরে তার চাল বেঁচতে আপত্তি নেই,হিন্দুর কাছ থেকে আমাদেরও কিনতে আপত্তি নেই।সে পুজোর সময় পুজো করে,হাড়খাটুনি পরিশ্রমের পর একটু আধটু নেশা করে, ঝুপসি কাঁচা পাকা চুলগুলো সবসময়েই উস্কোখুস্কো থাকে তার।তাতে আমার কিছু যায় আসে না।ফোন করলেই ঠিক সময়ে বস্তাভর্তি চাল নিয়ে হাজির হয়। জুলুজুলু চোখদুটোয় সততা আর নম্রতা পষ্ট।চাল বেঁচে স্ত্রী সন্তানের মুখে দু মুঠো খাবার তুলে দেওয়াই তার পরম কর্তব্য বলে মনে করে।বাবরি আদতে মন্দির না মসজিদ, কোন দেশে কারা দুর্গা ঠাকুরের পায়ে কোরান রেখেছিল,কাশ্মীরে কোন সালে কত পন্ডিতের নিধন হয়েছিল,কোন শর্মা কি বলল,সে খবর জানার কোনদিনই প্রয়োজন বোধ করেনি সে। জয় শ্রীরাম যখন বলে ভক্তি ভরেই বলে।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
আমার বাড়িতে বাসন মাজতে আসে বেবি নামের যে বৌটা,মেশিনের মত হাত চলে তার।তিনবাড়ির কাজ সামলে বাড়ি ফিরে আবার নিজের সংসারের রান্না বান্না, ঘর সামলানো বাচ্চাদেরকে নিয়ে একটু পড়তে বসানোতেই তার দিন কাবার।ওর মধ্যেই সময় করে কোরান পড়ে,নামাজ পড়ে,এই গরমে সারা মাস রোজাও করেছে।কিন্তু কোন শর্মা কি বলল,গুজরাতের দাঙ্গায় কি হয়েছিল,হিজাবকান্ড,RSS কি জিনিস এসব জিজ্ঞাসা করলে ও বলতে পারবে না।
বেবির ছোট পাড়াটিতে বেশ কয়েকঘর হিন্দুর বাস।মিনা সিংরাও হিন্দু মুসলিম মিলে মিশেই থাকে।এক চাঁদ দেখেই ওরা নির্বিঘ্নে নিজের নিজের উৎসব পালন করে।
ওদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করি-বলোতো সম্প্রীতি মানে কি?
ওরা বলতে পারবে না এই শব্দটির মানে।ওরা জানেই না।কারণ জানার দরকার পড়েনি এতদিন।শরীরে যদি রোগই না থাকে তো ডাক্তার বদ্যি ঔষধের নাম কার আর জানার দায় পড়েছে।
বেবি জানে,যে মাটিতে জন্মেছে সেই মাটিই তার দেশ।যে ভাষায় কথা বলে সেটাই তার মাতৃভাষা,বাপ মাকে যাকে উপাসনা করতে দেখেছে ও তারই উপাসনা করে।পাশের বাড়ির শঙ্খধ্বনি কখনই তার কাছে কর্নবিদারক বলে মনে হয়নি।
মিনা সিং এরও কোনদিন মনে হয়নি যে তার ধর্ম ‘খতরে মে হ্যয়’।তাকে বাঁচাতে গেলে তার পড়শি ভাই চাচা যাদেরকে সে জন্মে থেকে দেখে আসছে তাদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে,কিম্বা বলতে হবে ‘তোমরা পাকিস্তান চলে যাও’।
মাঠে জমি নিড়ানোর সময় কুদ্দুসচাচারা মিনা সিংরা বিড়ি ভাগ করে খায়।
বাসের ড্রাইভার কখনো হিসেব করে দেখেনি তার বাসে কজন হিন্দু আর কজন মুসলিম বসে আছে।তার কাছে সব যাত্রীই সমান। বাসে উঠে সিট দখলের সময় কজনই বা বিচার করে দেখি আগের যে যাত্রী এই সিটে বসেছিল সে হিন্দু না মুসলিম।গায়ের গন্ধ কি আলাদা করে চেনা যায়!সেই সিট দখলের জন্য তো যথেষ্ট গলা বাজান,তারপর চেল্লাচেল্লি সেরে নিজের গলিতে যেই আপনি ঢুকবেন,পরিচিত বিপরীত ধর্মীয় মুখগুলো দেখবেন অমনি তখন শুচিবায়ী ভূতটা চেপে ধরবে আপনাকে,অমুকের হাতের পানি খেলে বা অমুকের হাতের জল খেলে ধম্ম খোয়াতে হবে এই ভাবনা ভেবে।বাজারে গিয়ে হিন্দু না মুসলিমের দোকান তা দেখে কি কেউ বাজার করে।আর যদি করেও তো সে যে জিনিসটা কিনছে সেটা ‘কিস খেত কি মূলি হ্যয় ‘ তা কি করে বিচার করবে।
চরম হাস্যকর ব্যাপার। তাই না!আর এই যে ভাবনা চিন্তা শুচিবায়গ্রস্ততা এগুলো কারা করে জানেন, আমার আপনার মত মধ্যবিত্ত মানুষগুলো যাদের প্রাত্যহিক কাজ কর্মের পর পি এন পি সি করার মত হাতে যথেষ্ট সময় থাকে।যারা ভদ্রলোকের মুখোশ পরে বুকের মধ্যে ধিকিধিকি অসহিষ্ণুতার আগুন পুষে রাখে।
যারা কলকারখানায় মাঠে ঘাটে পরের বাড়িতে পাহাড়ে জঙ্গলে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে তাদের সারাদিন খাটাখাটুনির পর চরম ঘুম পায়।তারা রাতে ঘুমায় দিনে কাজ করে। তারা এসবের ধার ধারে না।সারা বছরের গচ্ছিত কটা টাকায় ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামা কেনে,উৎসবে পরিমিত আনন্দ,নিদেনপক্ষে মেলায় গিয়ে বাচ্চাকে দু পয়সার খেলনা কিনে যে হাসিটুকু হাসে তার মধ্যেই তার জগৎ সীমাবদ্ধ। এই বোকা নিম্নবিত্তগুলোই বেশি সুখী নয় কি!এদের মধ্যে কিছু পুরুষ বৌ পেটায় কিছু স্ত্রীলোক চেঁচিয়ে ঝগড়া করে।তারপর রাত ফুরোলেই দিনের আলোয় সব ভুলে কাজে চলে যায়। উদরপূর্তিই যে তাদের কাছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
আর অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্ত আমার আপনার মত আপিস বাবু বিবিরা যারা সবসময় আপ টু ডেট থাকি;আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হল, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের হাল হকিকৎ,আফগানিস্তানে কেমন শাসন চলছে,লোকসভা বিধানসভার বাজেট কি পেশ হল,কোন নেতা কোন দলে কনভার্টেড হল,বল্লবভাই প্যাটেলের মূর্তির উচ্চতা কত,তাজমহলের ভিতরে কি আছে,শেয়ারবাজার ইত্যাদি ইত্যাদি নখদর্পনে না থাকলে প্রেস্টিজ যাবার ভয়ে মরি তারাই season বুঝে ধর্মপালন,ভোট রাজনীতি,পালনীয় দিন,বিশেষ বিশেষ কারও মন্তব্য ইত্যাদি ইস্যু ঘিরে ভয়ংকর রিঅ্যাক্ট করি, সেটা নিয়ে বাকবিতন্ডা করে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দুই দিকের/ দুই দলের লোককে (যারা যে কোন বিষয়ে ক্ষেপে ওঠার জন্য মাথা আগে থেকেই বন্ধক দিয়ে রাখে) ক্ষেপিয়ে দিই।আর আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠেপড়ে লাগে দায়িত্ব জ্ঞানহীন সংবাদমাধ্যমগুলো যারা টি.আর.পি আর বেস্ট নিউজ চ্যানেল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার লোভে কোন না কোন দলের চাটুকারিতা করে সর্বক্ষণ একতরফা খবর পেশ করতে উদ্যত থাকে।যারা ধর্ষকের থেকে ধর্ষিতার ছবি ফলাও করে ছাপিয়ে তাকে অন্ধকার একটা জীবন বেছে নিতে বাধ্য করে।তাদের কাছে খারাপ সংবাদ পরিবেশন করাটাই মূল লক্ষ্য।খেয়াল করে দেখবেন,করোনার সময় খবরে যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা দেখাচ্ছিল আপনার হার্টবিটও সেই হারে চলছিল। এখন খবরে আর করোনা নেই আপনার হার্টবিটও নর্মাল হয়ে গেছে।সবার কি ভ্যাক্সিনেশন হয়ে গেছে?হয়নি।কিন্তু করোনা পালিয়েছে(?)।এখনো অবশ্যি কিছু লোক বিশেষ জায়গায়(যেখানে দেখানো দরকার) মাস্ক পরে ঘুরে বেড়ায় খেয়ে বেড়ায় ।তাই বলে রোজ কি আর পরতে ভালো লাগে!খবরের চ্যানেলগুলো সেইসব মানবহিতৈষী লোকের কভারেজ করে কি যারা নিঃস্বার্থে মানুষের পাশে দাঁড়ায়।নতুন কিছু তৈরিতে উৎসাহ দেবে না,শুধু ভাঙতেই তাদের মজা।যে জিনিষটা ফেটেছে তার মেরামতিতে হাত না লাগিয়ে সেটাকে আরো গভীরে ফাটল ধরিয়ে ভাঙার তোড়জোড়।আর তারপরেই আগুন জ্বলে।সে আগুনে এই মিডিয়া,নেতা মন্ত্রী,শর্মা বা তার চৌদ্দপুরুষের কিছু যায় আসে না।কিছুটা পথ চলতি বাধাগ্রস্থ হয়ে আমার আপনার যায় আসে আর সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ হয়ে যায় বেবি বা মিনা সিংদের।তাদের টালির বাড়ি ভাঙা পড়ে,খড়ের ঘর জ্বলে যায়।স্টেশনে,ফুটপাতে ছোট দোকানটার উপর নির্ভর করে দিন গুজরান করা লোকটার পেটে লাথি পড়ে। আর তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়ে যায় দীন মহম্মদ চাচা আর বলাইচন্দ্র মন্ডল কাকার মত দুই চিরকুমার আবাল্যবন্ধুর যারা পিতৃদত্ত ধর্মের উর্দ্ধে উঠে কেবল মানুষ হয়েই এতগুলো বছর একসঙ্গে কাটিয়ে দিল।ক্ষতি হয়ে যায় স্কুল বা কলেজ বন্ধু অমল আর আলিমের যারা ধর্ম বোঝে না, বোঝে শুধু ইয়ারি মস্তি দোস্তি হুল্লোড়।তাদের তরুণ মনেও বাপ মা ঢুকিয়ে দেন বিষ–“সাবধান! ওদের পাড়ায় যাবি না।”
উচ্চবিত্তরা মধ্যবিত্তদের চলন দেখে নিজেদের চাল ঠিক করে।এইরকম ছোটখাট ব্যাপারে তারা শুধু তাদের লাভ লোকসানটুকুই দেখে,বাকি এইসব সুড়সুড়িকে পারতপক্ষে এড়িয়েই চলে।
রাজনীতি বিদরা তো কোন বিত্তের মধ্যেই পড়ে না।ওদের জাতটাই আলাদা।ওদের কাছে তো মধ্যবিত্তরাই চ্যালেঞ্জ।মধ্যবিত্তদের ব্রেন ওয়াশ করতেই তাদের যত কাঠখড় পোড়ানো।কেননা সমাজে মধ্যবিত্তের সংখ্যা টাই বেশি ।তাদের যেদিকে ঘোরানো যাবে ক্ষমতায়নও সেই পথ ধরেই হবে।অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মধ্যবিত্তরা যতই নিজেদেরকে চালাক ভাবুক,সবচেয়ে বড় বোকা কিন্তু তারাই কেননা তারা জানেই না দাবার ছকের বত্রিশটা ঘুঁটির সেই ষোলোজন সিপাহি যারা সামনের সারিতে থাকে,যাদের আড়ালে রাজা লুকোয়,যুদ্ধে যারা সর্বপ্রথম বলিপ্রদত্ত হয় তারা আসলে এই মধ্যবিত্তরাই।এই আমরা আপনারাই।এই কথার কচকচানি করা লোকগুলোই।আমরা বুঝি না আমরাই আমাদের শত্রু।
উচ্চশিক্ষিত কারা?সে বিশ্লেষণ না হয় নাই বা করলাম।
আমরা আমাদের দু কলম পড়া ডিগ্রি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানগম্যির হাজার পরিচয় প্রমান দিয়ে নিজেরা ইমোশোনাল হয়ে পাঁচজনকে গালমন্দভরা কমেন্টসে তাতিয়ে দিয়ে আত্মসুখ লাভ করব,ভাতঘুম দেব আর ভাবব, ‘বেশ একখানা শিক্ষা দিলাম ওদেরকে।’
এই ‘আমরা – ওরা’ বিভাজনকারী মধ্যবিত্তরাই এ জগতের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী।এদের হাত দিয়েই যেমন বাণী উঠে আসে দেওয়ালে তেমনি এদের হাত দিয়েই একটা দেশ, একটা জাতি ভস্মীভূত হয়ে যায়।যত সংস্কার কুসংস্কার ধর্ম অধর্ম হেনবাদ তেনবাদ নিয়ে মেতে থাকা এই ভয়ংকর মধ্যবিত্তদের যতদিন না এই আত্মশ্লাঘায় ঘা পড়বে ততদিন বিপদ খাঁড়ার মত ঝুলে থাকবে মানবসমাজের ঘাড়ের উপরে।অথচ এই শিরদাঁড়া ভাঙা ছাপোষা মধ্যবিত্ত সত্ত্বাটা ইচ্ছে করলেই সবকিছু উল্টেপাল্টে দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি কায়েম করতে পারে।কিন্তু এই সম্মিলিত ‘ইচ্ছেটা’ জাগবে কবে সেটাই বড় প্রশ্ন।
রঘুনাথপুর
আমতলা
নওদা
মুর্শিদাবাদ