বালেশ্বর/চাঁদিপুর/পঞ্চলিঙ্গেশ্বর ও রেমুনা’য় খীরোচরা মন্দির
*************
রাজকুমার সরকার [ঝাড়খণ্ড]
——————————
১৯৯৭ সাল।আজ থেকে ২৭ বছর আগের ঘটনা।মনে পড়ে মার্চ মাসের কোনো একদিন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম উড়িষ্যা’র অভিমুখে।ছোট আমবোনা রেলস্টেশনে ট্রেন ধরে এক ঘন্টার পথ আসানসোল।সেখান থেকে আসানসোল আদ্রা রুটের ট্রেন ধরে আদ্রা।আদ্রা রেলস্টেশনটি বিভিন্ন ধরনের কেক এর জন্য বিখ্যাত। কেক খেয়ে, কিছু কেক সাথে নিয়ে আদ্রা-খড়্গপুর পথের ট্রেন ধরে খড়্গপুর রেলস্টেশনে নেমে উড়িষ্যা’র অভিমুখে যাত্রা করেছিলাম।খড়্গপুর থেকে বালেশ্বর। ট্রেন চলতে শুরু করেছে।মন পুলকিত তার কারণ এই প্রথম এ’পথে যাচ্ছি।জানালার ধারে সিট নিয়ে বসেছি।অনেকগুলো স্টেশন পার করে গাড়ি থামলো জলেশ্বর স্টেশনে।জলেশ্বর স্টেশনটি উড়িষ্যা’র প্রবেশপথ।
বালেশ্বরে থাকতো এক পিসতুতো দাদা সুকুমারদা।বৌদি প্রায়ই বলতো, একবার ঘুরে যাও।আমি তো ঘোরাঘুরির ব্যাপারে এক পা উঠিয়েই রাখি।আমি ও এক পিসতুতো দাদা দুজন মিলেই গেছিলাম। মনে পড়ে ঠিক সন্ধ্যে হব হব সেরকম সময়ে বালেশ্বর পৌঁছলাম। সম্পূর্ণ এক অচেনা অজানা জায়গা।বালেশ্বর রেলস্টেশনে নেমে আমরা উভয়েই দিশেহারা।একদম সম্পূর্ণ অপরিচিত এলাকা তারপর উড়িয়া ভাষা জানি না সেটাও এক সমস্যা।যেহেতু উড়িষ্যা তাই উড়িয়াভাষী মানুষ বেশি তবুও হিন্দি সবাই বোঝেন…বাংলাও…তবুও তো…. নেমে আমরা একটি গাড়ি করে…….
জায়গাটির খোঁজ নিয়ে গেলাম। জায়গাটির নাম ‘বালিয়া’, তখন হাতে মোবাইল ছিল না।সেখানে নেমে খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম। ভাড়া বাড়ি।ঘরের মালিকের নাম নিলাম। তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা।আমাদের টেনশন হচ্ছিল খুব। অবশেষে বাড়ি খুঁজে পেলাম। বৌদি তো মহা খুশি।পাড়ার আশে পাশের ছেলে মেয়েদের আমাদের দিকে নজর। বৌদি বললো- মোর দেওর আছে।
সকালে উঠেই মনে মনে ভাবলাম জায়গাটি ঘুরে দেখতে হবে।দাদা-বৌদির সাথে আলোচনা করলাম কি কি দেখার; ঘোরার মত জায়গা বা দর্শনীয় স্থল আছে এখানে?
সুকুমারদা বললো সে দেখার অনেক জায়গা আছে।চাঁদিপুর নাম তো শুনেছিস্?
কাছেই।এখান থেকে ১৪ কিলোমিটার। আমি বললাম সে তো খুব বিখ্যাত জায়গা।নাম শুনেছি।এটাই তো সুযোগ । এ সুযোগ কি ছাড়া যায়???
আমরা গাড়িতে করে চাঁদিপুর সমুদ্র সৈকত ঘুরতে বের হলাম। বালেশ্বর থেকে যেতে যেতে এক জায়গায় এসে দাদা বললো – এই যে দেখছিস না এখান থেকে ডিফেন্স এর এলাকা।ওই দেখ,এখানেই পৃথ্বী,অগ্নি উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল।মনটা ভরে গেল দেখে।এই এলাকাটিতে ঢোকার অনুমতি নেই। এক ঝলক তারিয়ে তারিয়ে দেখে নিলাম। সোজা এলাকাটি সমুদ্রধার পর্যন্ত। সম্পূর্ণ ডিফেন্সের এলাকা।বাঁহাতি ঘুরে চাঁদিপুর সমুদ্র সৈকত।চাঁদিপুরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সুপ্রশস্ত সমুদ্র সৈকত। জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত এগিয়ে আসে।শক্ত বেলাভূমিকে ভিজিয়ে দিয়ে আবার ভাটার টানে ধীরে ধীরে নেমে যায়।সমুদ্র সৈকতে সেই সময় অসংখ্য ঝিনুক উঠে আসে।আমি ও বৌদি মনের সুখে ঝিনুক কুড়োতে থাকলাম। আমাদের বৌদি বরাবরের খুব হুচুকে ও ফুর্তিবাজ।পর্যটকের জন্য এ সমুদ্রের জুড়ে নেই।দেখলাম প্রচুর ডাব বিক্রি হচ্ছে।তাজা ডাব খেলাম ও সমুদ্র ঘুরতে শুরু করলাম। অনেক ঘোরাঘুরি করার পর সোজা রাস্তায় খানিকটা গেলাম। জায়গাটির নাম- বলরামগুড়ি।বলরামগুড়িতে গিয়ে দেখলাম মাছের হাট।নানান ধরনের মাছ দেখে মন আনন্দে ভরে উঠল। আসলে এটি একটি মৎস্য কেন্দ্র। এখানেই বুড়িবালাম নদী এসে সমুদ্রে মিশেছে।দাদা দেখালো ওই দেখ এখানেই নদী মিশেছে সমুদ্রে।মনটা ভালো হয়ে গেল।মাছ দেখে দেখে মন ভরে গেল। নানান ধরনের বিচিত্র বিচিত্র আকারের মাছ। নানান প্রজাতির মাছ এখানে দেখতে পেলাম। রঙিন মাছ। মাছের হাট।মাছ চাষ। মাছ নিয়ে কারবার এখানে। না দেখলে এর মহিমা বোঝা যাবে না।এই বুড়িবালামের ধারেই বাঘা যতীনের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়।তা জানতে পারলাম ওখানেই গিয়ে।এখানে আমাদের গাইড দাদা-বৌদি।
অন্য একদিন ঘুরতে গেলাম পঞ্চলিঙ্গেশ্বর।বালেশ্বর শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পথ।বাসে নামলাম পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মোড়ে।সেখান থেকে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর একটু হাঁটা পথ।
যেতে যেতে ডানদিকে নজর পড়লো ও.টি.ডি.সি’র একটি পান্থশালা।দু ধারে দোকানপাট, খাবার হোটেল।গিয়ে দেখি ঝর্ণার মত জল পড়ছে পাহাড় থেকে এই পাহাড়টির নাম দেবগিরি।জলের মধ্যে বিরাজ করছেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর।পাঁচটি লিঙ্গ রয়েছে কাছাকাছি পাঁচটি জায়গায় সেজন্যই নাম পড়েছে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। আমরা পাঁচটি লিঙ্গকে স্পর্শ করে প্রণাম করলাম। অনেক আডভেঞ্চার।স্লিপ কেটে পড়ার ভয় আছে।একটু এক্সপার্ট না হলে বিপদ হতে পারে।আর যাঁরা রিক্স নিতে চায় না তারা দূর থেকেই প্রণাম সারছেন।পাশেই পুজোপাট করার জন্য একটি মন্দির রয়েছে সেখানেই পুজো করেন সবাই। একটু উপরে উঠে জঙ্গলের মধ্যে ঠাকুর আছেন তাঁকে প্রণাম করলাম। অদ্ভুত সবুজ বনানী, পাখিদের কলতান নিয়ে গেল আমাদের অন্য জগতে।
বালেশ্বর থেকে ‘রেমুনা’ সাত কিলোমিটার। সেখানে রয়েছে খীরোচরা মন্দির। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। কৃষ্ণ ঠাকুর ছেলেবেলায় খীর চুরি করে খেয়েছিলেন তাই এখানে মন্দিরটির নাম- খীরোচরা মন্দির। এখানে একটি মঠ রয়েছে।অনেক সাধু -সন্ন্যাসীর দেখা পেলাম। এখানে রয়েছে আরও একটি মন্দির তারিণী মায়ের মন্দির।
তারপর ফিরে এলাম বালিয়া।দাদার এক বিহারী বন্ধু ছিল,থাকতো সেখানের ‘ওরাটবাজার’ এলাকায়।এক কথা পাঠক-পাঠিকাদের জানিয়ে রাখি সেখানে ঝাড়েশ্বর মন্দির রয়েছে।শিবের মন্দির। শিবরাত্রির দিন খুব ভিড় হয়ে।বেশ বড় মেলা বসে। বন্ধুটির সাথে একদিন পরিচয় করিয়ে দিল দাদা।নাম- লক্ষণ।সে কোলকাতার মঙ্গলি হাট থেকে অনেক ছোটোখাটো জিনিস নিয়ে আনতো এবং সেখানে এক জায়গায় মাটিতে সাজিয়ে বিক্রি করতো।সেফটি পিন,প্লাস্টিকের সাবান কেস,আয়না, চিরুনি, চা ছাকনি ও আরও কত কি…..খুব সুন্দর ব্যবহার। দাদার সাথে ভালো বন্ধুত্ব ছিল সব মনে পড়ে।এভাবেই আমাদের কয়েকটা দিন কেটে গেছিল এখনও বেশ মনে পড়ে……এই ছিল আমাদের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ।