বাংলার রাজনীতি মানে জনসেবা নয় উৎসব
বটু কৃষ্ণ হালদার
বর্তমানে ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থার পরিকাঠামো দুইটি বিষয়ের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। প্রথমত রাজনীতি,দ্বিতীয়ত ধর্ম। যেহেতু ভারত বর্ষ ভিন্ন ধর্ম সমন্বয়ে দেশ, সেহেতু যার যার ধর্ম তার কাছে প্রধান হলেও রাজনীতি হল সর্ব ধর্মের মেলবন্ধন হওয়া উচিত।রাজনীতি ছাড়া কেউ এক পা ও নড়তে পারবো না ।তাই যা শিক্ষণীয় তা অবশ্যই সৌজন্যমূলক ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন হওয়া উচিত।সেই রাজনীতি বর্তমানে ষড়যন্ত্রমূলক ও রুচিহীন হয়ে পড়ছে।বেপরোয়া হিংসায়, দুর্নীতি ও লুটপাটের খেলা রাজনীতির প্রধান মূলধন হয়ে উঠছে।
ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কুল,কলেজ,ধর্মস্থান থেকে শুরু করে পাড়ার ক্লাব, মোড়ের মাথা,চায়ের দোকান এমনকি বাড়ির আঙিনাতে রাজনীতি সদা সর্বদা বিরাজমান।জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে
রাজনৈতিক প্রভাবশালীনেতা-মন্ত্রী হাত মাথায় থাকলে যোগ্যতা,প্রতিভা,শিক্ষা কোন কিছুর দরকার পড়ে না।রাজনৈতিক দলের আঙ্গুলি হেলনে বহু শিক্ষা প্রতিভা যোগ্যতার অপমৃত্যু ঘটেছে। অন্যদিকে এই রাজনীতি হয়ে উঠছে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শদের চক্রান্ত,ষড়যন্ত্রমূলক,গালিগালাজ,হুমকি,প্রতিশোধ নেওয়ার প্রধান মাধ্যম।এমন কি ভিন্ন দলীয়কর্মীরা একে অপরের সামনাসামনি হলেই বিদ্বেষ মূলক মন্তব্যে পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে হাতাহাতি,মারামারিতে রক্তাক্ত হচ্ছে দলীয় কর্মী সমর্থকরা।আবার ভোট পরবর্তী হিংসায় বহু সাধারণ নিরীহ জনগণ মারা গেছেন। ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে রয়েছে। বহু ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভেঙে ফেলা হয়েছে।এক কথায় রক্ত,মৃত্যু হাহাকার ছাড়া বাংলার ভোট একেবারে অসম্পূর্ণ।
হিংসা বিদ্বেষ রাজনীতিতে কোনদিন কোন নেতা মন্ত্রী কে মারা যেতে দেখেছেন?না তাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় না
স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে ভোট
প্রদান একেবারেই স্বাধীন। যে কোন রাজনৈতিক দল কে সমর্থন করা গনতন্ত্র দেশের নাগরিক হিসাবে সংবিধান স্বীকৃতি।তাহলে রাজনীতিতে হিংসায় সাধারণ জনগণকে কেন বলি হতে হয়? তবে ভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে মারা গেলেও কোন উচ্চ স্তরের দলীয় নেতা-মন্ত্রী রা কিন্তু মারা যান না। মারা যান মাটি থেকে উঠে আসা নিচু তলার দলীয় কর্মীরা।যারা রাজনৈতিক দলের ঝান্ডাটাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসেন।এটাই ধারা যুগের পর যুগ প্রবাহমান।কারণ এতে এক শ্রেণীর নেতা মন্ত্রীরা নিজেদের স্বার্থে জনগণ কে শুধু ব্যবহার করে আসছে।ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে।কারণ ভোট কথার অর্থ বর্তমান সময়ে জনসেবা নয় উৎসব।এই রাজনীতির নামে সাধারণ নিরীহ জনগণকে নিজেদের মধ্যে সান্ডের লড়াই লাগিয়ে দিয়ে খুব মজা পায় এক শ্রেণীর স্বার্থবাদী জননেতারা।এই লড়াইতে হাহাকার চোখের জল রক্ত মৃত্যুর মধ্যে সিংহাসন লাভ করে মহাসুখে অট্টালিকায় দিন কাটানোর রাস্তা পাকা হয়।আর স্বজন হারানোর যন্ত্রণা গুলো বুকে চেপে রাখে।তাদের খবর কেউ রাখে না।কিন্তু তিল নিচু তলার দলীয়কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে ভিন্ন দলের উচ্চ স্তরীয় নেতা-মন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে ঠিক যোগ সুত্র বজায় রেখে চলে।
তার কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
সত্তরের দশকের গোড়ার কথা। তৎকালীন সময়ে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন দেয়াল লিখনে খুনি সিদ্ধার্থ দূর হটো, ইন্দিরা গান্ধী দেশ ছাড়ো স্লোগানে ভরিয়ে দিয়েছিল সিপিএম। তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চান সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু। সিদ্ধার্থ শংকর রায় কে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে খবর পাঠালেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধীর সবুজ সংকেত মিলতেই দুজনে গোপনে দিল্লি গেলেন। কারণ পাঁচ কান হলেই সর্বনাশ। শুরু হয়ে যাবে দলের মধ্যে কাটাছেঁড়া। সিদ্ধার্থ শংকর রায় গভীর রাতে নিজেই গাড়ি চালিয়ে জ্যোতি বসুকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বাসভবনে। তখন সিপিএম আর কংগ্রেসের সম্পর্ক ছিল সাপে নেউলের মত। কারণ সিদ্ধার্থ শংকর রায় ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক মন্ত্রী। আর নকশাল আন্দোলনের জেড়ে বাংলার রাজনীতি উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যুদ্ধরত দুটি দেশের দুই ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন স যেমন নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক রেখে চলে টেলিফোনে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যায় জ্যোতি বসুর সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের বন্ধুত্ব ছিল ঠিক তেমনি। ইন্দ্রাগান্ধির বাসভবন থেকে বেরিয়ে রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়। অনেক ঘোরাঘুরি পর সিদ্ধান্ত নেন স্থানীয় থানায় গিয়ে বুঝে নেবেন নিজেদের আস্তানা ফেরার রাস্তা। সেই কথা শুনে জ্যোতি বসু বলল বাহ কি বুদ্ধি তোমার। পুলিশ যদি আমাদের চিনে ফেলে তখন কি হবে? কারণ ইন্দিরা গান্ধীর কাছের মানুষ হিসেবে সিদ্ধান্ত রায়ের ছবি দিল্লির কাগজের ছাপা হতো। তবে জ্যোতি বসু এসব বিষয় নিয়ে কখনোই মুখ খোলেননি। বরং জীবন সারনে এসে এই বলে আক্ষেপ করেছেন, সারা জীবন কমরেড পরিবৃত হয়ে থাকলাম, বন্ধু পেলাম। তবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ বাবু কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী সম্পর্কে বলে গেছেন, রাজনীতিতে ঘা না পড়লে জ্যোতির মত বন্ধু লাখে একজন মিলবে কিনা সন্দেহ।
তৎকালীন সময়ে অটল বিহারী বাজপেয়ি দীর্ঘদিন বিরোধী আসনে বসে দলকে ক্ষমতায় এনেছে। পেয়েছেন ভারতরত্ন সম্মান। অথচ রাজনীতি দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা প্রণব মুখোপাধ্যায় ও অটলবিহারী বাজপাই দিল্লিতে দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাড়িতে থেকেছেন। সংসদে মাঠে ময়দানে একে অপরের রাজনীতির মূল্যবোধ করলেও দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের আন্তরিকতা দুই পরিবার কে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছিল। শোনা যায় দুই পরিবারের লোকজন একে অপরের সঙ্গে যোগ সূত্র অটুট রাখতেই বাংলোর মাঝে দেয়াল ভেঙে পৃথক গেট করা হয়েছিল। দুই বন্ধুর দেখা হতো মর্নিং ওয়াকে। দুজনেই নিজের পোষ্য নিয়ে হাঁটতে বের হতেন। এক সকালে প্রণব বাবুকে ডাকতে এলে বাজপেয়ীর কুকুরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রণব মুখার্জির কুকুর। দুই কুকুরের ঝগড়া থামাতে গিয়ে হাতে চোট পান অটল বিহারী বাজপেয়ী। সংসদে বাজপেয়ীর হাতে ব্যান্ডেজ দেখে প্রণব জানতে চান কি হয়েছে? তখন বাজপেয়ীর মুখেই প্রথম সকালে কুকুরের কেলেঙ্কারি কথা জানতে পারেন প্রণব মুখার্জি। এমনকি বাজপেয়ীর পালিত কন্যার বিয়েতে যাবতীয় দায়িত্ব সামলেছেন প্রণব জায়া শুভ্রা মুখার্জি।
আবার বর্তমান সময়ে মোদী _দিদির বৈঠক নিয়ে বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি তথাগত রায় সরাসরি অভিযোগ এনেছেন,যে দিদি_মোদী পরস্পরের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখেন না,তা প্রমাণ করুন।কারণ সেই কবে থেকে বাম_কংগ্রেস তাদের গোপন সেটিং ত স্বত্ব নিয়ে আন্দোলন করে চলেছে, সেটা ও নিছক মিথ্যা নয়।যা রটে তার কিছুটা কিন্তু সত্য ও বটে।
আবার ভোট এলে বাংলার রাজনীতিতে জার্সি বদলের খেলা দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ মোদ্দা কথায় যাদের বলা হয় দল বদলু। দল বদলুরা কি, সত্যি রাজনীতিবিদ নাকি স্বার্থবাদী। তবে জনসভা করতে গেলে রাজনৈতিক দল করতে হবে এমন কোন কথা নয় তা প্রমাণ করেছেন অভিনেতা সোনু সুদ সহ বহু সমাজকর্মীরা। যারা নিঃশব্দে নিজেদের পরিশ্রমের অর্থ অসহায় জনগণের সাহায্যে বিলিয়ে দেন। আর দল বদলু নেতা মন্ত্রীরা জনগণের পর পরিষেবার টাকায় নিজেদের স্বার্থে গুন্ডা, মস্তান,দেহরক্ষী পোশে।এরা ভিতরে ভিতরে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে। যেমন বর্তমানে এমন জার্সি বদলানো নেতার নাম অর্জুন সিং। শুধু অর্জুন সিং নয় এমন বহু নেতা আছে। গিরগিটির মতো রং বদলানো নেতা-মন্ত্রীদের জন্য বহু দলীয় কর্মীদের মার খেতে হয়েছে।অনেকে মারা গেছে। এদের কারণেই রাজনীতি আরো ঘৃণ্য হয়ে উঠেছে। এদেরকে টিকিট দিয়ে জেতান মানে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা।
এই বাংলায়
ভিন্ন দলের নেতা মন্ত্রীরা গোপনে সু সম্পর্ক বজায় রাখলে ও জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে রক্তাক্ত,খুনোখুনির রাজনীতি করে চলেছে।ইতিমধ্যে বহু মায়ের কোল খালি হয়েছে, তা সকলের জানা।যারা ভোট দেন ভোটের সময় একে আতঙ্কে ভোগেন।
তবে রাজনীতিতে তো অবশ্যই সৌজন্য মূলক হওয়া উচিত,কারণ উভয় দলের লক্ষ্য কিন্তু জনসেবা।তবে এ সবের অন্যতম কারণ হল রাজনীতি এখন অশিক্ষিত ও গুন্ডা মাস্তান,তোলাবাজদের প্রধান মঞ্চ হয়ে উঠেছে।শিক্ষিত,বিবেকবানদের কোন স্থান নেই।টাকার লোভে রাজনৈতিক দল গুলো সমাজ বিরোধীদের টিকিট দিয়ে দেন।যার ফলে সমাজ সেবার প্রধান মাধ্যম রাজনীতি এখন সৌজন্য বিহীন হয়ে পড়ছে।চলছে নর্দমার পচা কাদা ছোঁড়া ছুঁড়ির খেলা।তবে রাজনীতিতে খুনোখুনীর খেলা বন্ধ হওয়া দরকার।শিক্ষিত,যোগ্য ব্যাক্তিদের অবারিত দ্বার হয়ে উঠুক।আর প্রার্থীদের নূন্যতম যোগ্যতা বি এ পাশ করার দাবি জানাই।এক্ষেত্রে শুধু নেতা মন্ত্রীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই,সাধারণ জনগন কিছুটা হলেও দায়ী।তাই রাজনীতিকে কলুষিত মুক্ত করতে গেলে সাধারণ জনগনকে যোগ্য প্রার্থীদের ভোট দিতে হবে।আর অযোগ্য প্রাথীদের মুখোশটা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে।কারণ এতে আপনাদের সন্তানদের ভবিষ্যত লুকিয়ে আছে।
———————-