Spread the love

প্রমা, পর্ব৬

‌‌দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায় 

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রমা দেখে সারা দালানের মেঝে জুড়ে পূজোর আয়োজন। এক পাশে পূর্ব দিক ঘেঁষে খড়ের বিঁড়ের ওপরে বসানো পাঁচখানা পরপর মাটির কলসি। মুখে মাটির সরা চাপা । কলসি গুলোর গলায় রজনীগন্ধার মালা পরানো ,কলসির মাথায় একখানা করে লাল টুকটুকে গামছা, সঙ্গে একখানা করে তালপাতার পাখা। প্রত্যেক কলসির সামনে একখানা করে শালপাতার থালা, তাতে এক ফালি করে তরমুজ গোটা কতক শসা কুঁচো পেয়ারা কুঁচো আপেল কুঁচো গোটা কত আঙ্গুর । একপাশে শালপাতার বাটিতে বেশ কিছু বাতাসা ,আর একটা বাটিতে গোটা কত নারকেল নাড়ু তার ওপর বসানো একখানা বড় জলভরা তালসাঁস সন্দেশ,পাশে থালার মধ্যে কিছু চাল, তার ওপর সবজি( একে বলে ভোজ্য) । তারপর কোশাকুশি আসন ।তার দক্ষিণ দিক করে আরেকটা আসন।

এসব দেখে প্রমা বুঝল আজ বাড়িতে নানা প্রকার খাবারের আমদানি হয়েছে। কিছু কিছু সেও পাবে, এই পুজোকে বলে কলসি দান।

 

যথাসময়ে পুরুত মশাই এসে

জোরে জোরে মন্ত্র পাঠ শুরু করে দিল একে সব মন্ত্র শেষ করে দিদাকেও ডাকলো ওই দক্ষিণ দিকের আসনে বসতে, দিদা দক্ষিণ দিকের আসনে, উত্তর দিকে মুখ করে বসে কলসিগুলো উৎসর্গ করতে শুরু করল। এক একটা কলসির জন্য বারবার একই মন্ত্র পাঠ করে যেতে লাগলো— এভাবে তারা দুজনেই খুব ঘামতে লাগলো, দারুণ রোদের তাপ, প্রদীপ নিভে যাবে বলে ,জানলা আবার পাখা দুটোকেই বন্ধ করে রেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এসব চলার পর আরতি শুরু হলো ,ঘুরে ঘুরে পঞ্চ প্রদীপের তাপ সবার মাথায় দেয়া হলো ।তারপর শান্তির জল নিয়ে,— পূজোর সমাপ্তি।

পুজো শেষে পুরোহিত মশাই প্রণামী ও একখানা কলসির সবকিছু অর্থাৎ বিঁড়ে হাতপাখা গামছা শালপাতাতে থাকা নৈবেদ্য , ভোজ্য সবই ছাঁদা বেঁধে ফিরে যাবার সময় বললে ,এই গঙ্গা জল আমার খুব কাজে আসবে ,এত জল গঙ্গা থেকে কে বয়ে নিয়ে এলো ? এর উত্তরে প্রমা বললে, কেন ? সে আর দিদা তো রোজ গঙ্গায় ভোরবেলা স্নানে যায়, তখনই নিয়ে এসেছে,—ভোরবেলা যখন ডি,ডি মন্ডল ঘাট রোড ধরে যায় মোড়ল ঘাটে, রাস্তায় কোনো লোক থাকে না গাড়ি ঘোড়া কিছু চলে না, তারা মাঠ ভেবে জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে কখনো বা ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যায়। জোয়ারের জল টলটল করে, ডুবে স্নান করার আলাদা মজা, দিদা বলে কত পাপ করেছি ঠাকুর সব পাপ ধুয়ে দাও। এ কথা শুনে প্রমার মনে প্রশ্ন জাগত পাপ মানে কি ? (মিথ্যাচার চুরি এগুলোই তো পাপ) দিদাকে তো এসব কিছুই করতে দেখিনি। জল ছেড়ে উঠে বৈশাখী কচি বেলপাতা আর কল্কে ফুল পেড়ে শিবের মাথায় জল দেওয়া শুরু— ওখানে দুটো শিব, তারপর রাস্তার দু’ধারে বট অসত্থের গাছের গোড়ায় নুড়ি পাথরের শিব, প্রত্যেক গাছের গোড়ায় ফুল আর গঙ্গাজল ছুঁড়ে ছুঁড়ে বাড়ি পৌঁছে যেতো। তখন মনটা বেশ ভালো লাগতো ! মনে হতো পুণ্য অর্জন করেছে ! বলাই বাহুল্য ডি, ডি মন্ডল ঘাট রোডে এখনো পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বট ও অশত্থের গাছ রয়েছে ।আজ বড় হয়ে প্রমা বেশ বুঝতে পারে গাছের গোড়ার নুড়ি শিবের মাথায় জল দিলে, সে জল গাছের গোড়াতেই পড়তো ওই গাছগুলো খুবই প্রয়োজনীয়।

 

এরই মধ্যে বাকি কলসির মধ্যে দিদার মেজ দেবরের ছেলে ও ছোটে দেবর এসে গেল উঠোনেই দিদা ওদের কলস সমেত সকল জিনিস দিয়ে দিল ওরা পুরনো গামছার মাঝখানে বসিয়ে ওপরটা বেঁধে ঝুলিয়ে নিল। দিদা ওদের হাতে প্রণামী দিয়ে প্রণাম করলে ওরা চলে গেল ।এরপর এলো দিদার বড় ভাই সেও একটু চা বিস্কুট খেলো, তারপর রিসকায় বসিয়ে নিয়ে সবকিছু বাড়ি চলে গেল। সবশেষে এলো ছোট ভাই। সেও চা বিস্কুট খেয়ে ওগুলো একটা বড় ব্যাগে পুরে বাসে উঠে চলে গেল।

 

সকলের আসা যাওয়ার আর পুজোর মাঝে দিনটা কেটে গেল। তখন মানুষ মানুষকে সামান্য জিনিস দান করলেও তা গ্রহণে সবাই আগ্রহী হত এবং পেয়ে খুশি হতো ।

বিকালে সরল তার পুরোহিত বন্ধুদের নিয়ে অক্ষয় তৃতীয়ার ইতিহাস আলোচনা শুরু করে দিল অক্ষয় তৃতীয়া শুরু হয় ত্রেতা যুগে, বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে পরশুরাম এ দিন জন্মগ্রহণ করেন,— তাই এই দিনটি পরশুরাম জন্মজয়ন্তী হিসেবেও পালিত হয়।

এদিন সকালে রাঙাদি যেমন পূজার্চনা করলো এই প্রক্রিয়ায় পূজার করার বিধি।

বিনোদ দা বললো ,এই দিনে সোনা গহনা কেনা বা শুভ কাজ শুরু করার বিশেষ শুভ দিন। এই দিনে স্বয়ং শিব পূজা গ্রহণ করে এবং ভক্তদের সহায়তা দান করে।

 

বর্তমানে অক্ষয় তৃতীয়া পালনের আগ্রহ একেবারেই নেই ।বাঙালি পরিবারগুলো দক্ষিণী নিয়মের বসবর্তী হয়ে ধনতেরাসে সোনা গহনা কিনে থাকে।

ফ্রিজের ঠান্ডা জলে বিভিন্ন প্রকার জুস এবং সফট ড্রিংস বাজার ছেয়ে ফেলেছে। কলসিতে ঠান্ডা জল, তাতে কর্পূর দেয়া এসব অনুভূতি বাঙালির তলানিতে ঠেকেছে।

অক্ষয় তৃতীয়ার সঙ্গে নববর্ষের গল্প চলছিল ।

মৈমনসিংহ গীতিকায় নববর্ষের আবহন ধ্বনিত হয়েছে,” আইলো নতুন বছর লইয়া নব সাজ, কুঞ্জে ডাকে কোকিল কেকা বনে গন্ধরাজ”।

পরবর্তীকালে উদার আকবর এই বর্ষবরণ রীতিকে স্বীকৃতি দেন তাই মনে হয় তিনিই প্রথম বর্ষবরণ চালু করেছেন ।

কিন্তু ইতিহাসে পাওয়া যায় নববর্ষ বহু পুরনো আমল থেকেই চলে আসছে। জমিদাররা প্রজাদের থেকে কর আদায় করত এবং প্রজাদের মিষ্টি মুখ করাতো।

বর্তমানকালে নববর্ষ এবং অক্ষয় তৃতীয়া এই দুইদিনে মন্দিরে গিয়ে নতুন খাতা পুজো এবং সেই ব্যবসা জনিত কারণে যাদের সঙ্গে আদান-প্রদান চলে, তাদেরকে মিষ্টি দেওয়ার রীতি প্রচলিত রয়েছে।

 

আজ ৫০ বছর পর অনেক বদলেছে, তখনকার গরমের চেয়ে তিনগুণ গরম বেড়েছে ।গাছপালা বন জঙ্গল একেবারেই নেই। চারিদিকে শুধু উঁচু উঁচু বাড়ি। গাছপালা বন জঙ্গল শান্ত পরিবেশ নেই, মানুষে মানুষে বেড়েছে ঈর্ষা হিংসা আকাশ দেখতে না পাওয়ার কান্না মানুষকে মানবিক থেকে অমানবিক করেছে ,কেউ কেউ মানসিক রোগীও হয়ে উঠেছে।

 

তার ওপর উন্নত ইলেকট্রনিক্স গুডস মানুষের পরিবেশ নষ্ট করছে এসি একটা ঘর ঠান্ডা করতে বাইরের পরিবেশ দ্বিগুণ গরম করে তুলছে ।গাছ কেটে বাড়ি ঘর ঘেঁষাঘেঁষি হাওয়ায় প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে ।

সিসি ক্যামেরায় মানুষকে মানুষ বন্দী করে ফেলছে ,ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার আচার-আচরণ সব মেকি হয়ে উঠছে । এ থেকে মানসিক চাপ বেশি দেখা দিচ্ছে। মানবিকতা হারিয়ে ফেলছে ।।

 

দ্রুত সকলের উচিত গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *