প্রবন্ধ
এর্নেস্তো চে গুয়েভারা
(স্পেনীয়: Ernesto Guevara de la Serna)
শংকর ব্রহ্ম
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});চে গুয়েভারা ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না (স্পেনীয়: Ernesto Guevara de la Serna)। তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত। মৃত্যুর পর তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});১৯২৮ সালের ১৪ ই জুন এর্নেস্তো গুয়েভারা রোসারিও, আর্জেন্টিনায় জন্ম গ্রহণ করেন। পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই তার চরিত্রে অস্থির চপলতা দেখে তার বাবা ‘এর্নেস্তো গেভারা লিঞ্চ’ বুঝতে পেরেছিলেন যে আইরিশ বিদ্রোহের রক্ত তার এই ছেলের ধমনীতে বহমান। খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্র মানুষের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তার ভেতর তৈরি হতে থাকে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তার বাবা ছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রবাদীদের একজন গোড়া সমর্থক, সেই সংঘর্ষে আহত সৈনিকদের তিনি প্রায়ই বাড়িতে এনে রাখতেন। তার মা ‘সেলিয়া ডে লা সার্না’-ও ছিলেন তাদের একজন সমর্থক।
তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে গুয়েভারা সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় এইসব অঞ্চলের সর্বব্যাপী দারিদ্র্য তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এই ভ্রমণকালে তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হলো একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। এবং এর একমাত্র সমাধান হল বিপ্লব। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে গুয়েভারা রাষ্ট্রপতি ‘জাকোবো আরবেনজ গুজমান’-এর নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সি আই এ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র বৈপ্লবিক আদর্শ চেতনা বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর পরিচয় হয়। চে গুয়েভারা তাদের ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ‘ফুলগেনসিও বাতিস্তা-কে উৎখাত করার জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। অনতিবিলম্বেই চে গুয়েভারাঃবিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তার পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কিউবার বিপ্লবের পর চে গুয়েভারা নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও তোপচিদল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন করেন, এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটনর দায়িত্ব নেন। এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান। ফলতঃ এই বাহিনী পিগস উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। চে গুয়েভারা ছিলেন এক বিশিষ্ট লেখক ও ডায়েরি-লেখক। বিশিষ্ট কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চে গুয়েভারার ডাইরী বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। গেরিলা যুদ্ধের উপর চে গুয়েভারা একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। চে গুয়েভারা কিউবান ভাষায় লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ, ধারণা করা হয় ছদ্মনামে কিংবা নামহীন অবস্থায় লিখেছেন আরও ২৫টি। এছাড়া তিনি লিখে দিয়েছেন পাঁচটি বইয়ের ভূমিকা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০-এর কাছাকাছি লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে সংগৃহীত আছে সত্তরটির মতো। তার লেখালেখি নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে নয় খণ্ড রচনাবলি।
তরুণ বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তার অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করেন। প্রথমে কঙ্গো-কিনসহাসায় তার বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশ নেন। এখানেই সি আই এ-মদতপুষ্ট বলিভীয় সেনাদের হাতে বন্দী ও নিহত হন।
চে গেভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত ও নিন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা , প্রবন্ধ , তথ্যচিত্র , গান ও চলচ্চিত্রে তার চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তার নাম প্রকাশিত হয়। আবার গেরিইয়েরো এরোইকো নামে আলবের্তো কোর্দার তোলা চে গুয়েভারার বিখ্যাত আলোকচিত্রটিকে “বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ আলোকচিত্র” হিসেবে গণ্য করা হয়।
হাপানিতে সারা জীবন ভোগা সত্ত্বেও তিনি দারুন কুস্তিগীর ছিলেন। তার খেলধুলার পছন্দ তালিকায় ছিল সাঁতার, ফুটবল,গলফ, শুটিং। চে গুয়েভারা সাইক্লিংয়ের ( সাইকেল চালানোর) একজন অক্লান্ত পরিশ্রমী খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি রাগবি ইউনিয়নের একজন অতি আগ্রহী সদস্য ছিলেন এবং বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয় রাগবি দলের হয়ে খেলেছে।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
রাগবি খেলার ক্ষিপ্রতার জন্য তাকে “ফিউজার” (“fuser”) নামে ডাকা হতো। তার বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা তাকে ডাকত চানচো (Pig) বলে, কারণ তিনি অনিয়মিত স্নান করতেন এবং সপ্তাহে একবার মাত্র পোশাক পাল্টাতেন।
একই পোষাক পরে থাকতে পছন্দ করতেন। তার ট্রেডমার্ক ছিল জলপাই-সবুজ রঙের সামরিক পোষাক।
বারো বছর বয়সে দাবা খেলা শেখেন তার বাবার কাছে এবং স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন। বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে সারাটা জীবন তিনি কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন। বিশেষ করে পাবলো নেরুদা, জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান। তিনি ভাল কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। তিনি স্মৃতি থেকে আবৃতি করতে পারতেন রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর “if-” কবিতা এবং জোসে হার্নান্দেজ-এর “Martin Fierro” কবিতা। গুয়েভারা পরিবারে ছিল ত্রিশ হাজারেরও বেশি বই যা গুয়েভারাকে করে তোলে একজন জ্ঞানপিপাসু ও অক্লান্ত পাঠক। যার মধ্যে কার্ল মার্ক্স, উইলিয়াম ফক্নার, এমিলিও সলগারির বই। পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরু, আলবেয়ার কামু, লেনিন, রবার্ট ফ্রস্ট-এর বইও তিনি পড়তেন।
চে গেভারা ১৯৪৮ সালে বুয়েনোস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে লেখাপড়ায় এক বছর বিরতি দিয়ে আলবের্তো গ্রানাদো নমক এক বন্ধুকে সাথে করে মোটর সাইকেল চড়ে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেরুর সান পুয়েবলোর কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বিশেষ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা। সেখানে কয়েক সপ্তাহ কাজও করেন।
তার ভ্রমণের সময়ে তিনি কুষ্ঠরোগীদের বসতিতে বসবাসকারী মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সহচার্য দেখে অভিভূত হন। এই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর দিনলিপি (The Motorcycle Diaries) তিনি লিখেছেন, ‘মানব সত্তার ঐক্য ও সংহতির সর্বোচ্চ রূপটি এ সকল একাকী ও বেপরোয়া মানুষদের মাঝে জেগে উঠেছে’। তার এই দিনলিপি নিউয়র্ক টাইমস-এর “বেস্ট সেলার” (সর্বাধিক বিক্রীত) তালিকায় স্থান পায় এবং পরে একই নামে (The Motorcycle Diaries) চলচ্চিত্র বের হয়, যা পুরস্কৃত হয়েছিল।
মাচু পিকচুতে যাওয়ার পথে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের চরম দারিদ্র্য দেখে মর্মাহত হন। কৃষকরা ধনি মহাজনদের অধীনে থেকে ছোট ছোট জমিতে কাজ করত।
এই ভ্রমণ তাকে নিয়ে যায় আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, পানামা ও মিয়ামির মধ্য দিয়ে বুয়েনোস আইরেসের দিকে। ভ্রমণের শেষ দিকে তিনি এই মত পোষণ করেন যে দক্ষিণ আমেরিকা আলাদা আলাদা দেশের সমষ্টি নয় বরং এক অভিন্ন অস্তিত্ব যার একান্ত প্রয়োজন মহাদেশব্যাপী স্বাধীনতার জাগরণ ও স্বাধীনতার পরিকল্পনা। পরবর্তীতে তার নানা বিপ্লবী কর্মকান্ডে এই একক, সীমানাবিহীন আমেরিকার চেতনা ফিরে আসে বারবার।
১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে চে গুয়েভারা গুয়াতেমালার উত্তরে ভ্রমণ করেন।
১৯৫৩ সালের ৭ই জুলাই, চে গুয়েভারা আবারও বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এবং সালভাডরের উদ্দেশ্যে বের হন। গুয়েতেমালা ছাড়ার আগে ১৯৫৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর কোস্তারিকা থেকে তার পিশেমশাইকে সব কিছুর বৃত্তান্ত লিখে জানিয়ে ছিলেন। চিঠিতে তিনি ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণের কথা লিখেছিলেন। তিনি এভাবে তার সংরক্ষণশীল আত্মীয়দের আতঙ্কিত করতে চেয়েছিলেন।
তার দাম্পত্য সঙ্গী ছিল
হিলডা গাডি (১৯৫৫-১৯৫৯)। চিচেন ইতজাতে হিল্ডা গাদেয়ার সাথে চে গুয়েভারা, মধুচন্দ্রিমায় যান।
তার মৃত্যুর পর ‘আলেইডা মার্চ’-কে বিয়ে করেন। (১৯৫৯-১৯৬৭) মৃত্যু আগ পর্যন্ত তার সঙ্গেই কাটে তার।
তার সন্তানেরা হলেন – ইলদা (১৯৫৬-১৯৯৫ মারা যান), আলেইদা (জন্ম ১৯৬০), কামিলো (জন্ম ১৯৬২), সেলিয়া (জন্ম ১৯৬৩), এর্নেস্তো (জন্ম ১৯৬৫)।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে চে গুয়েভারা মেক্সিকোতে পৌঁছান এবং সদর হাসপাতালে অতিপ্রতিক্রিয়া (অ্যালার্জি) বিভাগে চাকুরি করেন। পাশাপাশি ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভির্সিটি অব মেক্সিকোতে চিকিৎসা বিষয়ে প্রভাষক (Lecturer) এবং লাতিনা সংবাদ সংস্থার চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালের জুন মাসে তার বন্ধু ‘নিকো লোপেস রাউল’ কাস্ত্রোর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন এবং পরে তার বড় ভাই ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে চে গুয়েভারা পরিচিত হন। কাস্ত্রোর সাথে তার প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় এবং চে গুয়েভারা বলেন যে কিউবার সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তিত। তারপর তিনি ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলন দলের সদস্য হন। সেই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন এই আগ্রাসী তৎপরতার আশু (Immediate) সমাপ্তি প্রয়োজন।
বিপ্লবের পরিকল্পনামাফিক কাস্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালানো। ১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পৌঁছানোর সাথে সাথেই বাতিস্তার সেনাবাহীনী কর্তৃক আক্রান্ত হন। তাদের ৮২ জন সহচর মারা যায় অথবা কারাবন্দী হয়, মাত্র ২২ জন সে যাত্রায় বেঁচে যায়। গুযেভারা লিখেছিলেন সেটা ছিল সেই রক্তক্ষয়ী মুখামুখি সংঘর্ষের সময়, যখন তিনি তার চিকিৎসা সামগ্রীর সাথে একজন কমরেডের ফেলে যাওয়া এক বাক্স গোলাবারুদ নিয়েছিলেন, যা তাকে পরিশেষে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিণত করেছিল।
সিয়েররা মস্ত্রা পর্বতমালায় বিদ্রোহীদের ছোট্ট একটা অংশ পুনরায় সংঘবদ্ধ হতে পেরেছিল। সেখানে তারা ২৬শে জুলাই আন্দোলনের গেরিলা এবং স্থানীয় লোকজনদের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন।
সিয়েরা থেকে দল উঠেয়ে দেবার সময় কাস্ত্রোর একটি সাক্ষাৎকার নিউয়র্ক টাইমসে প্রকাশ করা হয়। যার আগে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীর মানুষ জানত না তিনি বেঁচে আছেন কি না! সেই নিবন্ধে কাস্ত্রো ও বিপ্লবীদের কাল্পনিক ছবি ছিল। চে গুয়েভারা সেই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন না কিন্তু কিছু দিন পরে তিনি তাদের এই বিপ্লবের খবর পড়ে সেই বিপ্লবের গুরুত্ব বুঝতে পারেন।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});আত্মবিশ্বাসের অভাবের সাথে সাথে রসদ সরবরাহও কমে এসেছিল পাশাপাশি ছিল প্রচণ্ড মশার উৎপাত তাই চে গুয়েভারা সেই সময়টাকে যুদ্ধের সবচেয়ে ব্যথার সময় বলে অবহিত করেছিলেন।
যুদ্ধচলাকালীন চে গুয়েভারা বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর অখণ্ড অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কূটনীতি এবং অধ্যবসায়ের কথা জানিয়ে ছিলেন। চে গুয়েভারা গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি সেঁকানোর জন্য চুল্লি প্রস্তুত এবং নিরক্ষর সঙ্গীদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালা তৈরি করেছিলেন। তাছাড়াও তিনি একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, সামরিক প্রশিক্ষণের কর্মশালা আয়োজন এবং তথ্য সরবরাহের জন্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তিন বছর পর তাকে ’’কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’’’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। তারপর তিনি তার বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে কাজ করেছেন। চে গুয়েভারা শৃঙ্খলার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, কর্তব্যে অবহেলাকারীদের তিনি নির্দ্বিধায় গুলি করতেন। তার এই প্রচন্ড মানসিকতা তাকে তার ইউনিটকে অন্য সবার থেকে ভয়ংকর করে তুলেছিল। তাই গেরিলা অভিযানের সময় গুপ্তঘাতকদের মৃত্যুদন্ড দেবার দায়িত্ব ছিল তারই উপর। চে গুয়েভারা এমন একজন কঠিন প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও সৈন্যদের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং কাজের ফাঁকে তাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও করতেন।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চে গুয়েভারা কিউবার শিল্প বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এসময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় কিউবান নোটগুলোতে তার স্বাক্ষরে শুধু “চে” লেখা থাকতো। ১৯৬৫ সালে আলজিয়ার্স সফরকালে সোভিয়েত সরকারকে সাম্রাজ্যবাদের দোসর আখ্যা দেয়ার ফলে দেশে ফেরার সাথে সাথে তার মন্ত্রীত্ব চলে যায় । এরপর তিনি বিপ্লবের পথে নিয়মতান্ত্রিক (constitutional) রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চে গুয়েভারা বিশ্বের বিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাই তিনি কিউবার প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান করার জন্য নিউ ইয়র্ক শহরে যান। ১১ই ডিসেম্বার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯তম অধিবেশনে আবেগ অভিভূত বক্তৃতায় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত বৈষম্যের কঠোরনীতি দমনে জাতিসংঘের দুর্বলতার কথা বলেন। এটাকে বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের কোন পদক্ষেপ আছে কি না জানতে চেয়ে প্রশ্ন তোলেন। গুয়েভারা তখন নিগ্রো জনগণের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কঠোর নিন্দা জানান। ক্রোধান্বিত গুয়েভারা ‘সেকেন্ড ডিক্লেরেশন অব হাভানা’ নামক একটি আবেগপূর্ণ ঘোষণার উল্লেখ করে তার বক্তৃতা শেষ করেন। তিনি বলেন যে তার এই ঘোষণার জন্ম হয়েছে ক্ষুধার্ত জনগণ, ভূমিহীন কৃষক, বঞ্চিত শ্রমিক ও প্রগতিশীল মানুষের দ্বারা। বক্তব্যের শেষ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সারা বিশ্বের শোষিত জনগোষ্ঠীর একমাত্র চিৎকার এখন, হয় স্বদেশ অথবা মৃত্যু।’
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});১৯৬৫ সালে চে গুয়েভারা আফ্রিকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং কঙ্গোতে চলমান যুদ্ধে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগাবার প্রস্তাব দেন। আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ‘আহমেদ বিন বেল্লার’-এর মতে, চে গুয়েভারা আফ্রিকাকে রাজতন্ত্রের দুর্বল ঘাঁটি ভেবেছিলেন। তাই সেখানে বিপ্লবের প্রচুর সম্ভাবনা তিনি দেখেতে পেয়েছিলেন। মিশরের রাষ্ট্রপতি ‘জামাল আব্দেল নাসের’, ১৯৫৯ সালের সাক্ষাতের পর যার সাথে চে গুয়েভারার ভ্রাতৃত্বপুর্ণ সম্পর্ক হয়। তিনি কঙ্গো আক্রমণের পরিকল্পনাকে বোকামি হিসেবে দেখেছিলেন। এই সতর্কতা সত্ত্বেও চে গুয়েভারা মার্কসবাদীদের সহায়তায় আক্রমণ চালিয়ে যাবার জন্য তৈরি হন। ১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি, তার সেকেন্ড কমান্ড ভিক্টর বার্ক এবং বারো জন সহচর নিয়ে কঙ্গোয় পৌছান। তার কিছু দিনের মধ্যে প্রায় ১০০ জন আফ্রো-কিউবান তাদের সাথে যোগ দেয়।এখানে তিনি কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া লুমুম্বা ব্যাটেলিয়ন সংগঠনের দায়িত্ব নেন।
চে গুয়েভারা অবস্থান সম্পর্কে তখন লোকজন জানত না। ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৬৭ এর শুরুর দিকে জামবিক স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিনিধির সাথে ডার এস্ সালাম নামক স্থানে দেখা হয়। সেখানে চে গুয়েভারা তাদের বিপ্লবী কর্মকান্ডে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে হাভানায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে পদযাত্রায় এক মন্ত্রী বলেন যে চে গুয়েভারা লাতিন আমেরিকার কোন জায়গায় বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপর প্রমাণিত হয় যে তিনি বলিভিয়ায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। কাস্ত্রোর আদেশে তিনি মন্টেন ড্রাই ফরেষ্ট নামক দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষন চালান যেখানে বলিভিয়ার স্থানীয় সমাজতান্ত্রিকরা তাকে সাহায্য করেছিল।
ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জঁ-পল সার্ত্র্ এবং সিমোন দ্য বোভোয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন মার্চ ১৯৬০ সালে। স্প্যানিশ ছাড়াও, গেভারার ফরাসী ভাষায় দক্ষতা ছিল।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর ভাষ্য মতে তারা চে গুয়েভারাকে ৭ই অক্টোবর গ্রেফতার করে এবং তার মৃত্যু হয় ৯ অক্টোবর ১৯৬৭ সাল বেলা ১.১০ টায় (৩৯ বছর বয়সে)। মৃত্যুর এই সময়কাল এবং ধরন নিয়ে মতভেদ এবং রহস্য এখনও আছে। ধারণা করা হয় ১৯৬৭ সালের এই দিনটিতে লা হিগুয়েরা নামক স্থানে নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয় বন্দী চে গুয়েভারাকে। পরে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী ঘোষণা করে যে বন্দী অবস্থায় নয়টি গুলি চালিয়ে সেই আর্জেন্টাইন ‘সন্ত্রাসবাদী’কে মেরে ফেলতে পেরেছে এক মদ্যপ সৈনিক। তবে আরেকটি মতামত হচ্ছে এই দিন যুদ্ধে বন্দী হলেও তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় কিছুদিন পর। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে পরবর্তীতে এইসব দাবির সপক্ষে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সে সময় লিখেছিল, ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’
পরে ১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণ-কবরে চে গুয়েভারা ও তার সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।
২০০৮ সালের ৪ই ডিসেম্বরে মায়ামি বিচে আর্ট ব্যাসল চলচ্চিত্র উৎসবে চে গুয়েভারা ‘পার্ট ওয়ান’ চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী হয়। একই সঙ্গে জীবনী, নাটক , ইতিহাস এবং যুদ্ধনির্ভর এ চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ২৪ জানুয়ারি ২০০৯-এ আমেরিকাতে। স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত এই মুভিটিতে অভিনয় করেন চে গুয়েভারার ভূমিকায় ছিলেন ‘বেনেসিও ডেল টরো’। এ পর্যন্ত ছবিটি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে তিনটি পুরস্কার ও আটটি মনোনয়ন পেয়েছে। ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারি তে চে গুয়েভারা চলচ্চিত্রের সিকুয়েল চে গুয়েভারা ‘পার্ট টু’ মুক্তি পায়।
( এনামুল হক সম্পাদিত – চে গুয়েভারার কিছু অবিস্মরণীয় উক্তি )
১). “বিপ্লব তো আর গাছে ধরা আপেল নয় যে পাকবে আর পড়বে, বিপ্লব অর্জন করতে হয়।”
২). “নিষ্ঠুর নেতাদের পতন এবং প্রতিস্থাপন চাইলে নতুন নেতৃত্বকেই নিষ্ঠুর হতে হবে।”
৩). “নীরবতা একধরনের যুক্তি যা গভীর তথ্য বহন করে”
৪). “আমি জানি তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছো, গুলি করো কাপুরুষ, তুমি শুধু একজন মানুষকেই হত্যা করবে (তার বিপ্লবী চেতনাকে নয়)।
৫). “শিক্ষা ব্যবস্থা তৃনমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে গরীব থেকে ধনী একই শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, এমন নয় যাদের টাকা আছে শুধু তারাই শিক্ষিত হবে”
৬). “সর্বোপরি, একজন বিপ্লবীকে সবসময় দৃঢ়ভাবে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে সংঘটিত যে কোনও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে”
৭). “মনুষ্য জাতির অভ্যুত্থান বিপ্লবের মাধ্যমে, শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সময়ের আবর্তে বিপ্লবের শক্তি ক্ষয়ে যায়”
৮). “আমরা কিসের জন্য বাঁচব সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যতক্ষণ না আমরা তার জন্য মরতে প্রস্তুত থাকি”
৯). “সবাই প্রত্যেকদিন চুলে চিরুনি চালায় যাতে চুল সুন্দর পরিপাটি থাকে, কেউ কেনো হৃদয় সুন্দর পরিপাটি রাখে না?”
১০). “জঘন্য বিপদ জানার পরেও আমায় বিপ্লবের রহস্য বলতে দাও, বিপ্লব সবসময়ই গভীর আবেগ আর ভালোবাসা দ্বারা পরিচালিত হয়, সত্যিকার আবেগ আর ভালোবাসা ছাড়া বিপ্লব অসম্ভব”
১১). “বাস্তববাদী হও,’অসম্ভব’কে দাবী কর”
১২). “আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধা নই, মুক্তিযোদ্ধা বাস্তবে কখনো হয় না যতক্ষণ মানুষ নিজে মুক্তিকামী হয়”
১৩). “এবং কিছু ব্যাপার পরিষ্কার, আমরা চমৎকারভাবে শিখেছি একজন সাধারণ মানুষের জীবন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির সম্পদের চেয়েও লক্ষগুণ বেশি দামী”
১৪). “নতজানু হয়ে সারা জীবন বাচার চেয়ে আমি এখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত”
১৫). “চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লড়াই, সবসময়।”
১৬). “যখনি তুমি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠো, তখনি তুমি আমার একজন সহ-যোদ্ধা”
১৭). “বিপ্লবী হতে চাও? বিপ্লবের প্রথম শর্ত, শিক্ষিত হও”
– এর্নেস্তো চে গুয়েভারা।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});—————————————————————-
[ তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া।]
—————————————————————-