উপস্থাপন–১১
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
★শরশয্যায় ভীষ্ম★
শরশয্যায় যবে ভীষ্ম করেন শয়ন,
যুদ্ধ নিবৃত্ত হন পাণ্ডব কুরুগণ।।
পাণ্ডবসেনা মাঝে ধ্বনিত তূর্যনাদ।
ভীমসেন গর্জেন তুমুল হর্ষনাদ।।
হেন শোক সংবাদ করিয়া শ্রবণ,
মূর্ছিত হলেন দ্রোণ শোকেতে তখন।।
লভিয়া চেতন তিনি শোকাহত মনে,
বিরত করেন যুদ্ধে তাঁর সেনাগণে।।
ত্যজি নিজ বর্ম সকল নৃপতি গণ,
ভীষ্ম সকাশে তাঁরা করিলেন গমন।।
কুরু পাণ্ডবগণ সবে প্রণমি তাঁরে,
দণ্ডায়মান তাঁর পাশে সব নতশিরে।।
ভীষ্ম কহেন করি স্বাগত সম্ভাষণ,
হইলাম প্রীত সবে করি দরশন।।
ঝুলিছে মস্তক মম করিতে উত্থান,
এক্ষনে মস্তকে মোর দেহ উপধান।।
কোমল উপধান আনেন রাজাগণ।
হেরি স্মিত হাস্য করেন ভীষ্ম তখন।।
কহেন নয়তো উপযুক্ত এ উপধান,
সঠিক জিনিস মোরে করহ প্রদান।।
অর্জুন তখন শিরে দিয়া তিন বাণ,
ঝুলন্ত মস্তক তাঁর করেন উত্থান।।
তুষ্ট ভীষ্ম তখন কহেন রাজাগণে,
শায়িত এবার আমি ঠিক উপধানে।।
শায়িত রহিব এখন এ বীরশয্যায়,
কাটিবে কাল উত্তরায়ন প্রতীক্ষায়।।
সূর্য করিবে যবে প্রতপ্ত সর্বলোক,
ত্যজিয়া দেহ মোর যাইব পরলোক।।
ইতর জীবের হেথা রোধিতে আগমন,
চারিদিকে মোর পরিখা করহ খনন।।
*
উৎপাটিতে শল্য তথা এলেন বৈদ্যগণ।
হেরিয়া ভীষ্ম কহেন, শোন দুর্যোধন।।
ক্ষত্রিয় প্রশস্ত গতি করেছি অর্জন।
বৈদ্যের আর নাইতো কোন প্রয়োজন।।
প্রাপ্তব্য ধন এদের করহ প্রদান।
বিদায় দাও সবাকারে করি সম্মান।।
শর সমেত মোরে করিও সৎকার।
অন্যথা না হয় যেন আমার কথার।।
সমাগত নৃপতি কুরু পাণ্ডবগণ,
সকলে করিলেন ভীষ্মে অভিবাদন।।
রক্ষিতে তাঁরে পরিখা করিয়া খনন,
সকলে নিজ শিবিরে করেন গমন।।
*
কাটিলে আঁধার রাত্রি প্রভাত কালে,
ভীষ্ম সকাশে পুনঃ আইলেন সকলে।।
ভীষ্মদেহে চন্দন চূর্ণ করিয়া লেপন,
কুসুম অর্ঘ্য তাঁরে করিলেন অর্পণ।।
হেরিলেন ভীষ্ম করি চক্ষুরুন্মীলন।
যাচিলেন বারি লাগি তৃষ্ণা নিবারণ।।
আনিল সকলে সুপেয় শীতল জল।
তার সাথে নানা খাদ্য আর মিঠে ফল।।
ভীষ্ম কন স্মিত হাসি হাসিয়া আবার।
মনুষ্য খাদ্য এখন নয়তো আমার।।
অতঃপর তিনি কহিলেন অর্জুনে।
বেদনায় শুষ্ক মুখ হইছে এক্ষনে।।
সমগ্র শরীর মোর বাণেতে গ্রথিত।
তুমি মোরে পানীয় দাও বিধিসম্মত।।
পর্জন্যাস্ত্র যুক্ত বাণ গাণ্ডীবে সন্ধানি,
অর্জুন করেন বিদ্ধ দক্ষিণ মেদিনী।।
উত্থিত ভূমি ভেদি স্বাদু নির্মল জল।
সেই জলে তৃপ্ত ভীষ্ম আত্মা সুশীতল।।
বিস্মিত যতেক নৃপতি আছিল তথা।
বিস্ময়ে কারও মুখে নাহি কোন কথা।।
ক্ষণপরে হর্ষধ্বনি ত্যজিয়া বিষাদ।
উঠিল তুমুল রবে দুন্দুভি নিনাদ।।
বিষন্ন মনে ভীষ্ম কহেন দুর্যোধনে।
জিনিতে না পারিবে তুমি কভু অর্জুনে।।
ত্যজি যুদ্ধ কর সন্ধি বচন আমার।
তাহাতে মঙ্গল জেনো হইবে তোমার।।
মুমূর্ষু লোকের যেমতি ঔষধে অরুচি,
সেমতি ভীষ্মবাক্যে তাঁরও হয় অরুচি।।
*
নীরব হইলেন ভীষ্ম তাঁর অশ্রুনীরে।
গমিলেন সকলে নিজ নিজ শিবিরে।।
হেনকালে কর্ণ কিঞ্চিত হইয়া ভীত।
ভীষ্ম সকাশে আসিয়া চরণে পতিত।।
কহিলেন ভীষ্মে তিনি করিয়া রোদন।
যদ্যপি নিরপরাধ জ্ঞাত সর্বজন।
তথাপি হইনু আমি বিরাগভাজন।।
হে পিতামহ কহেন কিবা সে কারণ।।
এক হস্তে কর্ণে ভীষ্ম করি আলিঙ্গন,
পিতৃ তুল্য স্নেহ বশে তাঁরে তিনি কন।।
যদি তুমি মম পাশে না আসিতে কভু,
তাহাতে মঙ্গল জেনো হইত না কভু।।
নারদ মুখে শুনেছি কুন্তী পুত্র তুমি।
সূর্য হতে জন্ম তব সূর্য পুত্র তুমি।।
বিরাগ নাই মোর অতি সত্য কথন।
বিদ্বেষ ত্যজ এবার তুমিও এখন।।
না কর পাণ্ডবে দ্বেষ তুমি অকারণে।
ত্যজ এবে পরশ্রীকাতর দুর্যোধনে।।
দুঃসহ বীরত্ব তব অবগত আমি।
অস্ত্র প্রয়োগে নিপুণ কৃষ্ণ তুল্য তুমি।।
সহোদর তব তারা পাণ্ডুপুত্র গণ।
তব সাথে তাহাদের হউক মিলন।।
শত্রুতার বিলুপ্তি হোক মোর মরণে।
বিরত হইও সবে এই মহারণে।।
কর্ণ কহেন তাঁরে নহে মোর অজ্ঞাত।
সূত অধিরথ ঘরে হইনু পালিত।।
দুর্যোধনৈশ্বর্য ভোগ করিনু কতদিন।
শোধিতে হইবে মোরে এবে সেই ঋণ।।
পাণ্ডবের জয়ে সচেষ্ট কৃষ্ণ যেমতি।
কৌরব লাগি যুঝিব আমিও সেমতি।।
মরিতে চাহিনা রোগে আমি যে ক্ষত্রিয়।
দুর্যোধনের আশ্রয়ে পাণ্ডব অপ্রিয়।।
তাই করিব যুদ্ধ আমি পাণ্ডব সনে।
মরিবারে চাই ক্ষত্রিয়োচিত মরণে।।
অবশ্যম্ভাবী রোধিতে আছে কোন জন।
যায়না তো করা তারে কভু নিবারণ।।
ক্ষমতা নাই মোর শত্রুতা অবসানে।
ধর্ম রক্ষিয়া আমি যুঝিব পার্থ সনে।।
কৃতনিশ্চয় আমি যুদ্ধ করিবারে।
অনুমতি পিতামহ দিন আমারে।।
কহেন ভীষ্ম হইলে তুমি নিরুপায়,
আজ্ঞা করি কর যুদ্ধ স্বর্গ কামনায়।।
ত্যজিয়া আক্রোশ রক্ষা কর সদাচার।
যুদ্ধ করিবে সদা ত্যজি অহংকার।।
শান্তি স্থাপনার্থে কত করিনু প্রয়াস।
বিফল হইল মোর সকল আয়াস।।
সাশ্রু নয়নে করি ভীষ্মে অভিবাদন।
দুর্যোধন সকাশে কর্ণ করেন গমন।।
(ক্রমশঃ)