Spread the love


ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য:–

* কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন *

—— কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন–১৮
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )

★ অষ্টম দিনের যুদ্ধ ★
( ইরাবানের মৃত্যু – ঘটোৎকচের মায়া )

প্রাতে ভীষ্ম কূর্ম ব‍্যূহ করেন রচন।
শৃঙ্গাটক ব‍্যূহ রচেন পাণ্ডুপুত্রগণ।।
ভীষ্মশরাঘাতে পাণ্ডবসেনা কত,
আহত হইল তারা, হত কত শত।।
আজিকার যুদ্ধে দুর্যোধন ভ্রাতা কত,
ভীমহস্তে সকলে হইলেন নিহত।।
ভীষ্ম পাশে দুর্যোধন কাতর ভাতৃ শোকে
করিলেন বিলাপ গভীর মনোদুখে।।
কহেন ভীষ্ম মম কথা কর প্রণিধান।
শুভাকাঙ্ক্ষী সবে করিল কত সাবধান।।
না শুনিলে কোন কথা, না ধরিল মনে।
কর্মফল লভিবে, না ভাবিও এক্ষণে।।
তোমায় কহিলাম পূর্বে আমি ও দ্রোণ,
বলি আর বার আমি শোন দিয়া মন।
রক্ষিতে নারিব কুরু আমি কিম্বা দ্রোণ।
কৃষ্ণসুরক্ষিত জেনো পাণ্ডুপুত্রগণ।।
হস্তে যারে পাইবে ভীম বধিবে তায়।
অতএব কর যুদ্ধ স্বর্গ কামনায়।।

নাশে যুদ্ধে ইরাবান কৌরব সেনায়।
বধিলেন তিনি ছয় শকুনি ভ্রাতায়।।
ইরাবান অনুগামী যত সব সেনা,
করিতে লাগিল ধ্বংস গান্ধার সেনা।।
দুর্যোধন কহেন রাক্ষস অলম্বুষে,
ইরাবান বধিতে তুমি যাও নিমেষে।।
ইরাবানে অলম্বুষ করিল আক্রমণ।
অনন্তনাগ মূর্তি সে করিল ধারণ।।
বহু নাগ রহিল তারে করি বেষ্টন।
অলম্বুষ গরুড় রূপে করিল ভক্ষণ।।
হেন হেরি মোহগ্রস্ত হ’ল ইরাবান।
অলম্বুষ খড়্গাঘাতে নাশে তার প্রাণ।।
হেরি ঘটোৎকচ ক্রোধে করে গর্জন।
কুরুসেনা কম্পিত হল ঘর্ম বর্ষণ।।
ঘটোৎকচ প্রতি ধাবিত দুর্যোধন।
বঙ্গরাজ তাঁরে করেন অনুগমন।।
ঘটোৎকচ বর্ষিল শর অবিরত,
শরাঘাতে বঙ্গাধীপ হস্তী নিহত।
দ্রোণ ধনু ছিন্ন আর এক বাণে,
হানে আঘাত বাহ্ণিক চিত্রসেনে।।
আহত সমরে কৌরব ভ্রাতা বিকর্ণ।
বৃহদ্বল বক্ষ শরেতে হইল বিদীর্ণ।।
চলে এক মহারণ সেই রণাঙ্গনে,
হইল পরাস্তপ্রায় কুরুসেনা গণে।।
ঘটোৎকচ আর রাক্ষস অনুচর,
বধিতে অশ্বত্থামা আইলেন সত্বর।।
ঘটোৎকচ করিল এক মায়া বল।
তাহাতে দেখিল মায়া কৌরব সকল।।
দ্রোণ, শল‍্য, অশ্বত্থামা আর দুর্যোধন,
রক্তাক্ত ছেদিত দেহে হয়েছে পতন।।
কৌরব বীরগণ সকলে নিপাতিত।
ভয়ে ভীত কুরুসেনা সব পলাইত।।
হেরিয়া কহেন সেনায় ভীষ্ম সঞ্জয়,
না পলাইও তোমরা না পাইও ভয়।।
যা দেখ তা নহে সত্য সব মিথ্যা মায়া।
রক্তাক্ত পতিত দেহ সব মিথ্যা কায়া।।
না করিল বিশ্বাস কেহ ভীষ্ম কথন।
ভয়ে ভীত সেনা সবে করে পলায়ন।।
অতঃপর ভীষ্ম কহেন দুর্যোধনে,
কর যুদ্ধ যুধিষ্ঠির কিম্বা ভ্রাতা সনে।।
ইহাই রাজধর্ম তুমি স্মরিও মনে।
রাজা করেন যুদ্ধ সদা রাজার সনে।।
কহেন ভীষ্ম ভগদত্তে, করিতে গমন।
তথায় ঘটোৎকচে করিতে দমন।।
ঘটোৎকচ সাথে অভিমন্যু, ভীমসেন,
চেদিরাজ, দশার্ণরাজ অনেকে ছিলেন।।
হস্তীপৃষ্ঠে আরূঢ় ভগদত্ত সেথায়,
নিক্ষেপেন বাণ ঘটোৎকচ যেথায়।।
সেই বাণ ঘটোৎকচ সহজে ধরিয়া,
ভাঙিলেন তায় তাঁর উরুতে রাখিয়া।।
অতঃপর ক্রুদ্ধ ভগদত্ত তখন,
সবার উপরে করেন শর বরষণ।।

ইরাবান মৃত্যু সংবাদ করিয়া শ্রবণ,
ক্রুদ্ধ অর্জুন ভীষ্মে করেন আক্রমণ।।
দুর্যোধন সপ্ত ভ্রাতা ভীম শরে হত।
অন‍্য ভ্রাতা সবে ভয়ে হ’ল পলাইত।।
সন্ধ‍্যাকালে ঘোষিত হ’ল যুদ্ধ বিরাম।
উভয় পক্ষ শিবিরে লভিতে আরাম।।
********

★ নবম দিনের যুদ্ধ ★
* ভীষ্মের পরাক্রম *

শকুনি আর কর্ণে কহেন দুর্যোধন,
গুরুতর কথা কহি করুন শ্রবণ।।
ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল‍্য বলে মোর মন,
পাণ্ডবগণে তাঁরা না করেন দমন।।
জীবিত থেকে তাঁরা করেন বলক্ষয়।
হেনরূপে হবে জানি পাণ্ডবের জয়।।
ভীম সংহারিল সপ্ত ভ্রাতার প্রাণ।
হেরিয়াও দ্রোণ তায় করিল না ত্রাণ।।
কহেন কর্ণ, না করি শোক তুমি শুন,
মোর সেই পূর্ব কথা বলি আমি পুন।।
ভীষ্ম যবে যুদ্ধ হতে লইবে বিদায়,
সসৈন‍্যে পাণ্ডবে আমি বধিব হেলায়।।
ভীষ্ম জানি সদা তিনি পাণ্ডবে সদয়,
নাহি শক্তি তাঁর পাণ্ডবে করিতে জয়।।
ভীষ্ম শিবিরে ত্বরায় করহ গমন,
সম্মত কর ভীষ্মে করিতে অস্ত্র বর্জন।।
অশ্বারূঢ় দুর্যোধন করেন গমন,
ভাতৃগণ সবে করেন অনুগমন।।
গন্ধ তৈল‍্য যুক্ত দীপ লয়ে ভাতৃগণ,
করিতে লাগিল তাঁরে পথ প্রদর্শন।।
কৃতাঞ্জলিপুটে ভীষ্ম সমীপে দুর্যোধন,
কহেন তাঁরে ভক্তি ভ’রে সাশ্রুনয়ন।।
পিতামহ শত্রুহন্তা কৃপা করুন মোরে,
আপনারে মিনতি এক করি করজোড়ে।।
যেমতি ইন্দ্র দেবরাজ বধিল দানবে,
সেমতি করুন ধ্বংস আপনি পাণ্ডবে।।
আপন পন এখন করুন স্মরণ,
পাণ্ডব পাঞ্চাল ককেয় সকল হনন।।
কৃপাবশে পাণ্ডবে কিম্বা দ্বেষে মম প্রতি,
রক্ষিতে পাণ্ডবে ইচ্ছা আপনার অতি।।
তাই দিন কর্ণে রণিবারে অনুমতি।
করিবেন জয় তিনি পাণ্ডবে শীঘ্র অতি।।
ক্রুদ্ধ দুঃখিত শুনি দুর্যোধন বচন,
নাহি করিলেন ভীষ্ম অপ্রিয় ভাষণ।।
করি চিন্তা দীর্ঘকাল কহিলেন ধীরে,
বাক‍্য বাণে পীড়া দাও কেন তুমি মোরে।।
যথা সাধ‍্য করি চেষ্টা জেনো তব হিতে।
প্রস্তুত সদা যুদ্ধে প্রাণ আহুতি দিতে।।
হীনবল নহেক কভু পাণ্ডবগণ,
ইতিপূর্বে পাইলে প্রভূত নিদর্শন।।
আছে মনে নিশ্চয় খাণ্ডব দাহ কালে,
পরাস্ত হলেন ইন্দ্র অর্জুন শরজালে।।
তোমা ছাড়ি কর্ণ যবে করিল পলায়ন,
গন্ধর্ব হতে উদ্ধারিল অর্জুন তখন।।
বিরাট নগরে যবে কর গো হরণ,
অর্জুনাদিষ্ট উত্তর করিল বস্ত্রহরণ।।
শঙ্খ চক্র গদাধর সহায় যাঁহার,
সেই অর্জুনে জিনিতে কেহ নাই আর।।
মহর্ষি নারদ কহিলেন কতবার,
মোহবশে না বুঝিলে বচন তাঁহার।।
কাঞ্চনময় বৃক্ষ দেখে মুমূর্ষু লোকে।
দেখ তুমি সেই রূপ তব দুই চোখে।।
করিলে সৃষ্টি তুমিই এই মহারণ।
নিজ পৌরুষ এখন কর প্রদর্শন।।
যথা সাধ‍্য করিব যুদ্ধ এ মম পণ।
নাশিব সোমক পাঞ্চাল ককেয়গণ।।
হয় মরিয়া আমি যাইব স্বর্গলোকে,
নয় সংহারি তুষ্ট করিব তোমাকে।
শিখণ্ডী বিরুদ্ধে নাহি করিব এ রণ।
স্ত্রীত্বই তাঁহার জেনো ইহার কারণ।।
গান্ধারীপুত্র শিবিরে নিদ্রা যাও সুখে।
কালকের যুদ্ধ রবে স্থায়ী লোক মুখে।।
প্রণমি ভীষ্মে আনত শিরে দুর্যোধন,
নিজ শিবিরে তখন করেন গমন।।
ভীষ্মের লাগিল আঘাত আত্মসম্মানে।
তিরস্কৃত তিনি তাঁর এই হল মনে।।
পরদিন ভীষ্ম করি সেনা সমাবেশ,
সেনা সাজাইতে করেন মনোনিবেশ।।
সর্বতোভদ্র মহাব‍্যূহ করেন রচন।
রক্ষিতে ব‍্যূহে রহেন মহারথীগণ।।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাজাইয়া পাণ্ডব সেনা,
ধৃষ্টদ‍্যুম্ন মহা ব‍্যূহ করেন রচনা।।
ধৃষ্টদ‍্যুম্নে কহেন অর্জুন যুদ্ধকালে,
করিব আজি যুদ্ধ এক অন্য কৌশলে।।
শিখণ্ডীরে রাখ আজ সম্মুখে সবার,
ভীষ্ম সম্মুখে তিনি, আমি রক্ষক তাঁর।।
যুদ্ধকালে লক্ষিত যতেক দুর্লক্ষণ।
হইল উল্কাপাত প্রবল ভূকম্পন।।
যত শৃগাল কুক্কুর শকুনি শম্বর,
করিল শব্দ এক অতি ভয়ঙ্কর।।
তুরঙ্গ বাহিত রথে করি আরোহণ,
অভিমন্যু করিলেন শর বরষণ।।
সেই শরে কৌরব সেনা নিহত কত।
তীব্র শরাঘাতে সেনা হইল মথিত।।
অলম্বুষে দুর্যোধন দিলেন আদেশ,
যাও তুমি অভিমুন‍্যে করহ নিকেশ।।
অলম্বুষ তামসী মায়া করিল প্রয়োগ।
সর্বস্থান হইল আঁধার একি দুর্ভোগ।।
ভাস্কর অস্ত্র প্রয়োগে কাটিল সে মায়া।
শরবর্ষণে আচ্ছন্ন অলম্বুষ কায়া।।
অলম্বুষ ভয়ে হইল ভীষণ ভীত।
রথ ফেলি ত্বরিতে হইল পলাইত।।
যুদ্ধে চলে দু’ পক্ষের জয় পরাজয়।
ভীষ্মের বাণে কত পাণ্ডব সেনা ক্ষয়।।
ভীত হইল যতেক রথী মহারথী।
পলায়ন করে সবে ভয়ে ভীত অতি।।
নিহত হাজার সেনা, হস্তী, অশ্ব কত।
ভগ্ন চক্র রথ ধ্বজ দণ্ড শত শত।।
কর্দম শোণিতে রণস্থল একাকার।
বিমূঢ় সেনা সকল করে হাহাকার।।
হেরি হেন শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন অর্জুনে,
বিরাট নগরে প্রতিজ্ঞা স্মর এক্ষণে।।
করিলে প্রতিজ্ঞা তুমি সঞ্জয় সমুখে,
যুদ্ধক্ষেত্রে নাশিবে ভীষ্ম দ্রোণ প্রমুখে।।
পার্থ তুমি ক্ষত্রধর্ম করিয়া স্মরণ,
প্রতিজ্ঞা তব এক্ষণে করহ পালন।।
নতশির অর্জুন, মুখে অনিচ্ছুক ভাব।
কহিলেন, বধিয়া অবধ‍্যে কিবা লাভ।।
লভিয়া রাজ‍্য, নরক পথ পরিষ্কার।
শ্রেয়স্কর বনবাসের কষ্ট স্বীকার।।
বেশ তবে তাই হোক রাখিব এ কথা।
ভীষ্মে করিব পাতিত হবে না অন‍্যথা।।
*
অর্জুন রথ আচ্ছন্ন ভীষ্ম শরজালে,
কৃষ্ণ বুদ্ধি এক করেন হেন কালে।।
ধাবিল রথ চক্রাকারে দ্রুত ঘূর্ণমান।
শরভ্রষ্ট ভীষ্ম ব‍্যর্থ তাঁর সকল বাণ।।
উভয় পক্ষের সেনা হত কত শত।
হেরিয়া ভীষ্ম পরাক্রম সেনা ভয়ার্ত।।
হইল সূর্যাস্ত তখন নামিল আঁধার।
রণক্লান্ত সেনা শ্রান্ত ঘোষিত অবহার।।
শিবিরে সকল সেনা করিল গমন।
কুরুগণ করে সবে ভীষ্ম গুণকীর্তন।।
(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *