পূজার ভেট’
প্রীতম সরকার
পূজোর মন্ডপের ভিতরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কমিটির কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করতে করতে গৌতম বললো, “এবার কিন্তু পূজো তেমন জমছে না! লোকজনের ভিড় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কি যেন বাদ থেকে যাচ্ছে! কিন্তু সেটা কি ধরতে পারছি না।”
পাশের চেয়ারে বসেছিল সুমন। সে উত্তর দিল, “কোথায় কি বাদ গেল? সবই তো করেছি। প্রতিবার যেমন পূজো হয়, তেমন জোগাড় করে দিয়েছি! কিন্তু আমারও মনে হচ্ছে, কোথায় যেন কিছু বাদ গিয়েছে!” সুমন কমিটির অন্য কর্মকর্তাদের ডেকেও একই প্রশ্ন করলেও সবাই একমত, যে অষ্টমী পেরিয়ে নবমীর সকালে পৌঁছেও পুজোর আনন্দের বৃত্ত সম্পূর্ন হচ্ছেনা!
করোনার লকডাউনের কারনে গত দু’বছর দূর্গাপুজো ছোট করে হয়েছিল। এবছর পুজোর সব কিছুই করা হয়েছে। তবুও কথায় ঘাটতি হচ্ছে কিছুতেই মনে করতে পারছেন না সার্বজনীন ক্লাবের কর্মকর্তারা।
এমন সময় হাতে লাঠি নিয়ে কোমড় বেঁকিয়ে মন্ডপে হাজির হলেন এলাকার বয়স্ক শ্যামাপ্রসাদ বাবু। গতকাল পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মন্ডপে এসে পুজোর অঞ্জলী দিয়ে গিয়েছেন তিনি। প্রতিমার দিকে তাকিয়ে প্রনাম করে গৌতমদের জটলার কাছে জানতে চাইলেন, “তা বাবারা, এবার তোমাদের পূজো এমন ম্যাড়ম্যাড়ে কেন গো! চাঁদা তো আমরা কিছু কম দিয়েছি বলে মনে পড়ছে না! তবুও বাড়ির পাশের এই পুরানো দুর্গাপুজোতে আনন্দ ঠিক মতো হবেনা, এটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না!”
“সেটা তো আমরাও চিন্তা করছি মেসোমশাই! কি যেন বাদ পড়ে যাচ্ছে! কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না,” বললো উত্তম।
বৃদ্ধ ফের বলে উঠলো, “আমি প্রথম দিন থেকেই বাড়ির বারান্দাতে বসে অনেক রাত পর্যন্ত মানুষ দেখেছি। নিজে তো এই বয়সে আর প্যান্ডেলে ঘুরতে পারিনা। তাই মানুষের ভিড় দেখেই সময় কাটাই। নবমীর সকালে এখনও তো এলো না দাঁসাই নাচের দল! দাঁসাই নাচ ছাড়া কি পূজোর আনন্দ জমে!!”
বৃদ্ধের কথাতে চমকে উঠলো সবাই!!!
সত্যিই তো! দাঁসাই নাচ ছাড়া তো পুজোর আনন্দ সম্পূর্ন হয় না। গৌতম, সুমন থেকে শ্যামাপ্রসাদবাবু পর্যন্ত, সবাই এক্ষেত্রে একমত! ছোটবেলা থেকে এখানকার সব মানুষ দেখে আসছেন দাঁসাই নাচ! কিন্তু এবছর দাঁসাই নাচের দল কোথায়!
নবমীর বিকাল চারটা নাগাদ দাঁসাই নাচের একটা দল মন্ডপের সামনে হাজির হতেই গৌতম খবর দেয় শ্যমাপ্রসাদবাবুর বাড়িতে। দাঁসাই নাচ দেখার জন্য শ্যমাপ্রসাদবাবুও ছুটে এসেছেন মন্ডপে। এখন মন্ডপের ভিতরে ঘুরে ঘুরে নাচছে একদল আদিবাসী যুবকের দল। তাদের কয়েকজনের হাতে রয়েছে বড় বড় করতাল, কারো গলায় ঝুলছে মাদল। তবে প্রত্যেকের মাথার পাগড়িতে রয়েছে ময়ূরের পালক, গাছের ডাল। একজনের হাতে রয়েছে লাউ দিয়ে তৈরি ভুয়াং নামের এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র। কয়েকজন আদিবাসী পুরুষ আবার মহিলাও সেজেছে!
নাচ শেষ হতেই শ্যমাপ্রসাদবাবু ভুয়াং হাতে ধরা আদিবাসী লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি রে, এবার এত দেরি হলো তোদের পুজো মন্ডপে নাচতে আসতে! আমরা তো ভেবেছিলাম, তোরা সব ভুলে গিয়েছিস। আর আসবিই না!”
আদিবাসীটি জবাব দিল, “তা কি হয় বাবু! পুজোয় লাচবো বলে আগেও দল বেঁধে গোটা ভাদ্র মাস ধরে তৈরি হইলাম! কিন্তু গেলো দু’বছর করোনার জন্য আমাদের নাচতয়ে দেয়নি। এবার সুযোগ পেয়েছি! মা দূগগাকে আনন্দ দিবক লাই! ইটাই তো আমাদের মা’কে দেওয়া ভেট।”