নিস্তার
মৃন্ময় ভট্টাচার্য
ভারী বাজারের ব্যাগ হাতে যেই বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছি, ভিতর থেকে এক তীক্ষ্ণ নারী কন্ঠের চিৎকার কানে এলো। “এভাবে পারা যায় না, আমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে। এভাবে একসাথে থাকা সম্ভব নয়, এ বাড়িতে হয় ওরা থাকবে নয় আমি থাকবো, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো।”
এই গলাটা আমি গত কুড়ি বছর ধরে চিনি, প্রেমের দশ বছর ও তার করুণ পরিণতির (পরে আমার নতি স্বীকার) ,পরের দশ বছর। আগের কন্ঠস্বর ছিল একেবারে মধুমাখা, ভজন গাইতো, আমি ভাবতাম ঈশ্বর নয়, আমারই বন্দনা করছে বুঝি । বাসরঘরেই সে ভুল ভেঙেছিল। যাক সে সব অবান্তর কথা।
এখন আমার হাত পা কাঁপছে, বাড়িতে কি এমন ঘটলো, কিছুই বুঝতে পারছি না। আজকে অফিস যাইনি, অনেকদিন বাদে, এক কেজি পাঁঠার মাংস এনেছিলাম, একটু আয়েস করে খাব বলে, সব ইচ্ছা আজ মাঠে মারা গেল।
এখন বাড়িতে ঢোকা সম্ভব নয়, আমাকে সামনে দেখলে আর রক্ষা রাখবে না। কি করি? পাশের অপুদের বাড়িতে যাব? কিছুক্ষণ বসে, পরিবেশ শান্ত হলে......। না, হাতে বাজারের ব্যাগ ও বড় সাধের মহার্ঘ্য পাঁঠার মাংস নিয়ে কোন মুখে যাব? বাড়ি না ঢুকে বাজার হাতে কেন এলাম, জানতে চাইলে কি উত্তর দেব?
কি কারণে দেবীর এই রণচন্ডী মূর্তি ধারণ, ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। ছেলেটা বড় দূরন্ত, তাই ওর মা'র আর আলাদা করে গানের জন্য গলা সাধার প্রয়োজন হয় না, বাড়িতে কাক-চিল পর্যন্ত বসতে সাহস পায় না। ছেলে ক্লাস ফোরে একটা নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, ক্লাস ফোর অবধি মর্নিং স্কুল। কিন্তু ছেলেকে তো রোজকার মতো স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসেছি, তাহলে?
আমাদের বাড়ির একটা বাড়ি পরেই অমিতদের বাড়ি, দু’বছর হলো বিয়ে করেছে, ওর বউ মিলি যেমন দেখতে তেমন মিশুকে। আমাকে দেখলেই ডেকে কথা বলে, ও নাকি বিয়ের আগে থেকেই আমার লেখার ফ্যান। ওর জন্য বাড়িতে বহুবার অশান্তি হয়েছে, একবার ভেবেছিলাম, আমার ঘরের ফ্যানেই দড়ি লটকে ঝুলে পড়ি। সেইথেকে আমি পাড়ার মধ্যে কথা বলতে একটু ভয় পাই। আজ ফেরার সময় ও ঘরের ভিতর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এলো, বললো “কেমন আছেন দাদা, নতুন কি লিখছেন? নতুন বই বেরোলে আমাকে অবশ্যই একটা দেবেন। একদিন বাড়িতে আসুন না, অনেক গল্প শুনবো।” আমি ভয়ে বারেবারে দূর থেকে আমার বাড়ির ব্যালকনির দিকে দেখছিলাম, আর “হ্যাঁ”,”আচ্ছা”, “অবশ্যই” প্রভৃতি এক কথার উত্তর দিয়ে পালাবার পথ খুঁজছিলাম। ভয় হচ্ছে জানলা দিয়ে আমার বেটার হাফ তা দেখে ফেলেনি তো? সে কারণেই কি…….!
গতকাল আমাদের দশম বিবাহবার্ষিকী ছিল, অফিসে কাজের চাপে, একদম ভুলে মেরে দিয়েছি, বাড়ি ফিরেছি রাত দশটায়। তখন থেকেই গুম মেরে আছে, ছেলের সামনে আগ্নেয়গিরির লাভা ছিটকে বেরোয়নি। অনেকবার বললাম কাল অফিস যাব না, বিবাহবার্ষিকী পালন করবো। তবুও মুখটা বাংলার পাঁচ থেকে ছয় করতে পারিনি। এখন ছেলে স্কুলে, আমাকে একা পাওয়ার অপেক্ষায় ড্রাগন তার চূড়ান্ত রিহার্সাল দিচ্ছে নাতো?
ভেবে ভেবে পেটটা কনকনিয়ে উঠছে, প্রত্যেক বাঙালির মতো সারা বছর আমের আশা (আমাশা) নিয়েই বেঁচে থাকি। আর ভারী ব্যাগ হাতে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। “জয় মা” বলে কলিং বেল না বাজিয়ে “অমৃতা” বলে আর্তনাদ করে উঠলাম।
অমৃতা "কি হয়েছে, কি হয়েছে" বলে দৌড়ে এসে গ্রীলের গেট খুলে দিল, আমি কোনোমতে ব্যাগ নামিয়ে জামার বোতাম খুলতে খুলতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ছুটলাম। বাথরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অমৃতা বললো " তুমি কি দেখেছো, বেসিনের তাকে রাখা লিকুইড সোপটার কি দশা হয়েছে? পুরো ফুটো করে দিয়েছে, সব সোপ মেঝেতে গড়াচ্ছে। আর পারা যাচ্ছে না, যতই গণেশের বাহন হোক, এবার ওদের মারার ব্যবস্থা করতেই হবে।"