Spread the love

মহিলা মহল
**
—–রীতা দি জানো তো তপনের বৌটার না চালচলন মোটেও ভালো না ,
আর বলিস না মিঠুর মা, সারাদিন দেখিস না চুরিদার ছাড়া মহারাণী অন্য কিছু পড়ে না।
পাশ থেকে রতনের বৌ তমালি—- ও মৌ দিদি , সেদিন দেখলাম বাবলার সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে আর হাসাহাসি করছে ।
তপনের মা সেই আড্ডার একজন প্রতিদিনের সদস্যা। তিনি বসে বসে সব শোনেন, না শুনে আর উপায় তো নেই। আড্ডা থেকে উঠে গেলেও দোষ। যে যার কাজ সংক্ষেপে সেরে নিয়ে এই আড্ডায় আসা চাই। এভাবেই মহিলা মহলের দিন কেটে যায়। তপনের মা এসব শুনতে শুনতে আজ একেবারে ওদের আপনজন, সংসারের হিতাকাঙ্ক্ষী ভেবে নিয়েছেন। তপনের বাবা বৃদ্ধ মানুষ, বেশি চলাফেরা করার মত অবস্থায় নেই। সাধাসিধে হলেও অল্পেতেই রেগে যান। তিনিও একজন ঐ মহলের কানাড়ি সদস্য (কানেশোনা সদস্য) । উপায় না থাকলে যা হয়। ঘরের উল্টোদিকে আসর, আর উনি বসে থাকেন ঘরের সামনে আরাম কেদারায়। তিনি শুনতে পান অনেক কিছু– যেমন,
কেমন বৌ রে বাবা, শ্বশুরের সাথে ঝগড়া করে, নারী হয়ে শাড়ি পড়ে না, কথায় কথায় তর্ক করে। বড় ছোট জ্ঞান নেই। দুদিন পর পর বাপের বাড়ি যাওয়া চাই, একজন তো মাঝে মাঝেই বলে ‘আমার বৌমা কিন্তু অমন না, আমার বৌমা ঘর থেকেই বের হয় না (উনার বৌমাটিও আসরের সদস্যা, গ্রামের মেয়ে)’ । তপনের মা তাঁর আদুরে ছেলেকে কাছে পেলেই বৌমাকে নিয়ে কিছু শুনিয়ে দেন, তপনের বাবা আবার অন্যরকম, যা শোনানোর সরাসরি বৌমাকেই। বৌমা তো এমনিতেই মিথ্যা , বানানো কথার ধার ধারে না, জমে ওঠে শ্বশুর বৌমার ঝগড়া। এ নিয়ে আসরের খোরাক আরো বেড়ে যায়।

প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা যার কথা নাকি আসরের সবাই মেনে চলে। শিক্ষিকা মানে তরুণের মা কাজরী , উনি অবশ্য আসরে যোগ দেন দুই জা মিলে। উনার জা আরতির যদি আসতে একটু দেরি হয় ততক্ষণ চলে আরতিকে নিয়ে সমালোচনা। আবার আরতি এলেই একদম গলায় গলায় ভাব।
পরদিন আসর সবে শুরু হয়েছে, কাজরী তাঁর জা সম্পর্কে নিন্দামন্দে ব্যস্ত।
কাজরী—

আরতির আসতে একটু দেরি হয়, এমনিতে এরকম আড্ডা সে তেমন পছন্দ করে না। যত হোক বড় জা এর আবদার, তাই আসতে হয়। মেয়েকে টিউশনিতে পাঠিয়ে তারপর সে আসে।

তপনের বৌ কেয়া মফস্বলের মেয়ে, ব্যবহারে মানবতাবাদী, ভালো কথায় খুশি হলেও মিথ্যা অথবা পিছনে নিন্দা পছন্দ করে না। কাউকে যেমন ছেড়ে কথা বলে না, তেমন কেউ কোন সাহায্য চাইলে না করতে পারে না। সে জন্য সবাই ওকে যেমন ভালোবাসে, সমীহ করে, আবার ভয়ও পায়, না জানি কখন রেগে যায়। পাড়া হোক বা বে-পাড়া আত্মীয় বা অনাত্মীয় কারো কোন অসুখ-বিসুখ হলে ডাক পড়ে কেয়া’র। এভাবে কলকাতার হাসপাতাল গুলোতে নিয়মিত জামায়াত। ডাক্তার নার্স সবার সাথে কথা বলা কেয়া’র কাজ। সেজন্য তাঁর কাছে ফোন আসে এবং সে যথারীতি বাপের বাড়ি পৌঁছে যায়, কারণ বাপের বাড়ি তো কলকাতার কাছেই। চলাফেরার সুবিধার জন্য ওঁকে চুরিদার, শালোয়ার কামিজ বেছে নিতে হয়েছে।

এ সব কারণে কেয়া ঘরের কোণের গৃহবধূ কোন দিন হতে পারেনি। তাঁর এই চরিত্রের জন্য তপন কেয়াকে খুব ভালোবাসে। তপনের অনুমতি ছাড়া কোথাও যায় না। তপন তো এটাই চেয়েছিল, সে একসময় সোস্যাল ওয়ার্কার ছিল। চাকরির জন্য আজকাল তাঁর আর সময় হয় না। তাঁর স্ত্রী সেই শূন্য স্থান পূরণ করেছে বলে সে নিজেকে ধন্য মনে করে।

কিন্তু ঐ যে মহিলা মহল! উনাদের এসব অসহ্য লাগে।

বড় ভাই ফটিক এবং ছোট ভাই নিরাপদ, বড় বউ সন্ধ্যা এবং ছোট বউ পারমিতা এরা দুই জা, দুই বোনের মতো মিলেমিশে সুখী সংসার। সন্ধ্যা কিছুদিন ধরে আসরে নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করেছে। সন্ধ্যার সাথে ওঁর জায়ের আগে বনিবনা থাকলেও ইদানীং ওহি-নকুল সম্পর্ক। সন্ধ্যার জা কারো মোটরবাইকে চড়ে কোথাও দরকারী কাজে গিয়েছিল তাই নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনায় শেষ পর্যন্ত পরকিয়া বা চরিত্রহীনা তকমা পেয়ে যায় । এভাবে প্রায় জনাকুড়ি সদস্যা নিয়ে নারী বাহিনীর আড্ডা। আসর বেশ জমজমাট।

এসব কথা সন্ধ্যার দেওর নিরাপদ’র কানে যায়, সেদিন’ই ও সুদূর জব্বলপুর থেকে অসংরক্ষিত টিকিটে ট্রেনে উঠে পড়ে। দুদিন খাওয়া দাওয়া ভুলে বাড়ি ফিরে আসে রাত আটটায়। বউয়ের সাথে কোন ঝামেলায় না গিয়ে স্বামী স্ত্রী দুজনে খোসগল্পে মেতে উঠে। আসল উদ্দেশ্য পরকীয়া সম্বন্ধে বউয়ের কাছেই খোঁজ নেওয়া। কথায় কথায় উঠলো সে কথা।
—কি গো শুনলাম তুমি নাকি কারো সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে গেছ?
— সে কি কথা, এখনও ছেলের বিয়ে দিলাম না, পরকীয়া তো করবো নাতির সাথে। সে আসুক।
— তাই নাকি! আমি তো শুনলাম তুমি অমলের মোটরবাইকে চড়ে ঘুরে বেড়াও , আড্ডা দাও,
—- ছি: ছি: কে বলল এমন কথা।
এতদিনে আমাকে এভাবে জানলে?
ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। তুমি সেজন্য হঠাৎ করে বাড়ি ফিরে এলে?
—-কি করব বলো, কাকি’ই তো সেদিন ফোন করে কত সব কথা জানালো, তাই আসল ব্যাপার জানতে সরাসরি বাড়িতে চলে এলাম।
—–ফোন করেও তো জানতে পারতে,
—–ফোনে কী আর আলোচনা হয়, একথা সে কথায় ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে।
—–তাহলে শোন, পাড়ার অনেকের সাথে একদিন গঙ্গায় যাচ্ছিলাম, কিছুদূর যাওয়ার পর মনে পড়ে, ঠাকুর ঘরে গঙ্গা জল ফুরিয়ে গেছে, পিতলের ঘটিটা নিতে হত ,তাই ঘরে ফিরে ঘটি নিয়ে একাই যাচ্ছিলাম। পথে দেখা হয় অমল ঠাকুরপোর সাথে। ও বাইকে যাচ্ছিল সদরে , আমাকে একা যেতে দেখে ও বুঝতে পারে সামনে এগিয়ে গেছে অন্যরা। তাই আমাকে বলে বৌদি বাইকে বসুন ওদের কাছে নামিয়ে দেব। আমি আর না করতে পারিনি। ওদের সামনে নামিয়ে দিয়ে অমল চলে যায় ওর গন্তব্যে। সেদিন থেকে দেখছি পাড়ার অনেকেই কেমন যেন সন্দেহ চোখে দেখে । এতদিনে জানলাম আসল কারণ।

নিরাপদ ওর বৌকে জাপটে ধরে আদর সোহাগে ভরিয়ে দেয়। পরদিন ভোরের ট্রেনে চলে যায় জব্বলপুর । আর নিরাপদ’র বউ সাংসারিক কাজে নিজেকে আরো জড়িয়ে নেয়।
মহিলা মহলের কারো পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি নিরাপদ কবে এলো আর কবে গেল।


পাড়ার অঞ্জলি দি বয়স পয়তাল্লিশোর্ধ । দুই ছেলে মেয়ে ও স্বামী নিয়ে সুখের সংসার। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছ’মাস হল ছেলে রেলওয়ের টিকিট কালেক্টর পদে চাকরি পেয়েছে। হঠাৎ করেই দেখা গেল অঞ্জলি দির পিরিয়ড বন্ধ, এ মাসে হয়নি। লোকলজ্জার ভয়ে রীতাদির কাছে পরামর্শ চাইতে গেলেন। রীতাদির পরামর্শে ডাক্তারের কাছে যান, ডাক্তার বাবু পরিক্ষা নিরিক্ষার পর জানালেন, চিন্তার কিছু নেই। মেনোপজ শুরু হয়েছে, তাই পিরিয়ড আর হবে না। রীতাদি সব শুনলেন। দূর্ভাগ্যজনকভাবে অঞ্জলি দি ঠান্ডা জ্বরে কাবু হয়ে মহিলা মহলে কদিন অনুপস্থিত। সেই সুযোগে রীতাদি বেশ গুছিয়ে আড্ডায় সবাই কে ঘটনা জানিয়ে দিলেন।
— একটা গোপন কথা আছে গো, তোমরা কি জানো?
সবাই হামলে পড়ে ‘ —-কী কথা গো রীতাদি?
——-আরে শোনো না, অঞ্জলিদির আবার হবে।
—– কী হবে গো
—— আরে এ বয়সে যা না হওয়ার তাই হবে, ছি: ছি: কী বেআক্কেলে রে বাবা। এই বয়সেও এত খাই-খাই, ছি: ছি: ছি:
—–তাই নাকি গো রীতাদি, কোন লজ্জাশরম নেই, বুড়ো বয়সেও এমন ভিমরতি।
—আর বলিস না,
আমার কাছে এসেছিল পরামর্শ নিতে, আমি বলেছি, নার্সিংহোমে অ্যাবরশান করিয়ে নিতে। কদিন ধরে তো এদিকে আসে না, সকালে খবর নিতে গেলাম, ঘরের ভিতর থেকে বলল শরীর খুব খারাপ। এবার তোমরাই বুঝে নাও। হি: হি: হি:
— তুমি হাসছো রীতাদি, আমার তো লজ্জা করছে।

মহিলা মহলের সবাই যে যার কত্তার কানে খবরটি দিয়ে দিতেই পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেল ।

এভাবে পাড়ার পুরুষ মহিলা সবার কাছে খবর পৌঁছে যায় মহিলা মহলের দায়িত্বে। অঞ্জলি দির স্বামী রাতুলের অবস্থা খুব খারাপ। সবাই ওকে দেখলে ব্যঙ্গ তামাশায় মেতে ওঠে। অঞ্জলিদি আর আজকাল মহিলা মহলের আড্ডায় যান না। রাতুলদা নিজের পাড়ায় যাতায়াতের পথ ছাড়া অন্য পথে পা বাড়ান না। লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে শেষমেশ সস্তায় বাড়ি বেচে দিয়ে ছেলের রেল কোয়ার্টারে গিয়ে উঠলেন। পাড়ায় খবর হল ” একটাই ছেলে তো , তাই বাড়ি বেচে ছেলের কাছে থাকাই ভালো”।


মহিলা মহলের আড্ডা অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে।
কোন বাড়িতে যদি দুই জা থাকে, আর দুই জায়ের মধ্যে যদি তালমিল না থাকে এবং দুজনেই মহিলা মহলের সদস্য হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা । একজন থাকলে অন্যজন অনুপস্থিত। কে কার সমালোচনা করলো দুজনের কেউ জানতে পারবে না।

সেরকম’ই দুই জা নয়না আর সুলতা। ভাগাভাগি সংসার, নয়না বাংলা অনার্স হলেও স্বামীর সংসারের মধ্যেই নিজেকে সঁপে দিয়েছে। সুলতা ষষ্ঠ শ্রেণীতেই পড়াশোনা শেষ করেছে। নয়নার স্বামী চাকরি সূত্রে বিদেশে থাকে। উপার্জন ভালোই মাস গেলে লাখ খানেক ঘরে আসে। সুলতার স্বামী প্রাইভেট ফার্মের সাধারণ কর্মী। বিয়ের কিছুদিন পর সুলতার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় পাশের বাড়ির রমলা বৌদির সাথে, তিনি আবার মহিলা মহলের একজন নিয়মিত সদস্য। সেই রমলা বৌদি ডেকে নিলেন তাঁদের আড্ডায়। কত রকম রসালো গালগল্প, পরচর্চা , পরনিন্দা নিয়ে জমজমাট আড্ডায় সুলতা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়।আড্ডার শেষে সবার আবদার একটাই আগামীকালও যেন সুলতা আজকের মতো অংশ নেয়।

মহিলা মহল সদ্য বৌ হয়ে আসা নয়নার দোষত্রুটি খুঁজে খুঁজে সুলতার কান ভারি করার কাজ শুরু করে দেয়। আর একটি বিশেষ কথা হল সুলতার শাশুড়ি অর্থাৎ আসরের জ্যেঠিমাও মহিলা মহল সদস্যা। আসরে অন্যদের আসার আগেই উনি কিন্তু আসন দখল করে অন্যদের অপেক্ষায় থাকেন।


রীতাদি—-বিবেকের বিয়েতে তোমার ছেলে তো বরযাত্রী গিয়েছিল , আমার ছেলে তরুণ কে বলেছিল, ওঁর সামনে পরিক্ষা,তাই যেতে দেইনি। কাল তো বৌভাত, দেখি কেউ যায় কিনা!

তরুণের মা —- কনের বাড়ি শুনলাম খুব কিপটে গো, সোনাদানা বা খাট আলমারি সব দিলেও নগদে এক টাকাও দেয়নি।

সন্ধ্যা —– খবর আছে গো, বিবেক আর শান্তনার মধ্যে ভিতরে ভিতরে ইন্টুমিন্টু ছিল গো।
তরুণের মা— তাই নাকি!
সন্ধ্যা– হ্যাগো, বিবেক বিয়ে করতে যেতেই শান্তনা তো বিছানায় পড়ে পড়ে কেঁদেছে গো।
সবাই একসাথে—– সে কি গো….
সন্ধ্যা—- তা ন নয়তো কী
কথাটি বিবেকের কাকি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।
সন্ধ্যা বেলা অনেকের সামনে বিবেককে বললেন
—– বিবেক বাবা, কী সব শুনলাম।
—–কী শুনেছেন কাকি?
—– শান্তনার সাথে প্রেম ছিল, বলিসনি কেন?
—– কি বলছেন কাকি! আমরা তো ভাইবোনের মত। রোজ কথা হয়, সামনাসামনি ঘর।
—— সামনাসামনি ঘর বলেই তো ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল তাই না?
—– না না সব বাজে কথা
—– বাজে কথা যদি হবে তাহলে তোর শান্তনা কালকে অত কেঁদেছিল কেন?

বিবেকের মাথা হেট হয়ে যায়, ও বুঝে পায় না, এখন কী করা উচিত।

এদিকে বিবেকের ছোট শালী যে এসেছে দিদির সাথে , বিবেকের পাশেই ছিল, সে সব শুনে তাঁর দিদির কানে দিয়ে দেয়। বিবেকের নববধূর চোখের জল আর শুকোয় না। বিবেক এত বুঝাতে থাকে, কে শোনে কার কথা। ফুলশয্যার রাতেও বলে আমাকে পছন্দ না হলে বলে দাও, কোন দাবি থাকবে না।
অনেক কষ্টে বউকে শান্ত করার চেষ্টায় ভোর হয়ে যায়। মোরগ ডাকে, কাক ডাকে, অবশেষে শালিকের কিচিরমিচির শুরু হতেই নববধূ চারুলতা শান্ত হয় ।

পরদিন শান্তনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে বিফল হয়, কারণ ও ততক্ষণে লোকলজ্জায় পিসি বাড়ি চলে গেছে। বাধ্য হয়ে বিবেক শান্তনাকে ফোন করে।

—–হ্যালো
— হ্যালো শান্তনা
—- কি বলবি বল
—- তুই যে আমার বিয়েতে কেঁদেছিলি, কেন কেঁদেছিলি তাই বল,
—– ও তুই বুঝবি না, প্রত্যেক মাসে একদিন খুব কষ্ট পাই। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, ব্যথার ট্যাবলেট না খেলে সারে না। সেদিন ট্যাবলেট ছিল না। বাড়ির সবাই তোর বিয়েতে ব্যস্ত ছিল। আর আমার কান্না শুনে কেউ বদনাম রটিয়ে দিয়েছে। ভালো থাকিস বিবেক,

—– আমার বউও কাঁদছে রে, ও ভুল বুঝেছে।
—–আমার সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিস।
—–তুই কবে আসবি?
—- না রে, ওপাড়ায় থাকা যায় না। আর আমার নামে যে বদনাম করেছে, তাকে আমার সহ্য হবে না। সেদিন সন্ধ্যা কাকি এসেছিল, আমার অবস্থা দেখেও তার টাকা ধার নিতে আসার কথা বলতে একটুও বাঁধেনি। তোর বিয়ের ☀️ বৌভাতে কিছু কিনে দেবে বলে তাঁর দুশো টাকা ধার চাই। যন্ত্রণা ও রাগ হওয়ায় আমি কোন কথা বলতে পারিনি। কাল বিকাল থেকে অনেকেই অনেক কথা বলেছে। তুই নাকি বেইমান, আমাকে ঠকিয়েছিস, এরকম নানা কথা। আমাদের বাড়ির সবাই বিরক্ত ও লজ্জায় আজ সকালেই পিসি বাড়ি পাঠিয়েছে। এখন থেকে পিসি বাড়িতেই থাকবো।

তারপর বছর পেরোতে না পেরোতে বাড়ি বেচে শান্তনাদের পুরো পরিবার চলে গেলেও মহিলা মহলের সেই আড্ডা স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছে।

পাড়ার নিশিকান্ত বাবু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী, ব্যাণ্ডেল থার্মালে পাম্প হাউস অপারেটর হিসেবে কাটিয়েছেন দীর্ঘ আঠাশ বছর। বর্তমানে সামান্য পেনশন পান। তিনি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা , বাড়ি তৈরী এবং মেয়ের বিয়ে দিতে সব টাকা ব্যয় করেছেন। তাঁর দুই ছেলে। শ্যামাকান্ত বড় এবং রমাকান্ত ছোট।
শ্যামাকান্ত ও রমাকান্ত দুই ভাই দুজনেই বেসরকারি সংস্থার কর্মী।
বড় ছেলে শ্যামাকান্ত একটু অন্য রকমের। বোকা বোকা স্বভাবের মনে হলেও বুদ্ধি রাখে অন্তত টাকা পয়সা কিভাবে জমানো যায় সে ব্যাপারে। যে জন্য বাবাকে বলেছে ও যা আয় করে তাতে হাতখরচ ওঠে না। তাই বাবাকে এক টাকাও দেওয়ার ক্ষমতা নেই।ও ভবিষ্যতের জন্য ব্যাঙ্কে রেকারিং করেছে। রমাকান্ত আবার আলাদা প্রকৃতির। ও বাবাকে বলেছে, ওর বাবা যা আয় করেন তারপরে সংসার চালাতে যে টাকা কম পড়বে সবটাই রমাকান্ত দেবে। হিসাব করে দেখা গেল মুদিখানার জিনিস কিনতেই বাবার টাকা শেষ হচ্ছে। তখন রমাকান্ত তাঁর বাবাকে জানায় বাজার খরচের সবটাই সে বহন করবে। এর মধ্যে শ্যামাকান্ত বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। পাত্রি দেখে রমাকান্ত জানিয়ে দেয় দাদার বিয়ে এখানেই হোক। এমন বৌদি হলে দাদাকে সামলাতে পারবে। যথারীতি বিয়ে হয়ে যায়। দাদার বিয়ের তিন বছর পর রমাকান্ত বিয়ে করে। রমাকান্ত যেহেতু বিদ্যা বুদ্ধিতে এগিয়ে সেহেতু অনেকেই পাত্রীর খোঁজ দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল নিজের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে পাত্রী পছন্দ করে নেয়। এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়ে যায়।
এরপরেই শুরু হয় মহিলা মহলের তৎপরতা।
রমাকান্তের বিয়ের পরদিন হবে বাসি বিয়ে। তাঁর আগেই মানে সাতসকালে পাড়ার কাকিমা জ্যেঠিমা বৌদিদের নতুন বউ দেখার পালা শুরু হয়ে যায়।

মৌ বৌদি—–দেখি দেখি একটু সরো বউ দেখবো,
সন্ধ্যা—— বউ দেখবা দেখো, কেমন লম্বা ঢ্যাং-ঢেঙে চেহারা ,
কাকি পাশ থেকে- আরে ছাড়ো তো, ও নিজেই পছন্দ করেছে, আমরা তো অনেক জায়গায় কথা বলেছিলাম, মেয়ে দেখতে যাব। মাঝখান থেকে এই মেয়েকেই পছন্দ করলো। আমরা আর কি করি বলো, ওঁর কথাতেই মত দিতে হল।
বড়দি অর্থাৎ রমাকান্তের মা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন কী একটা দরকারী কাজে,
কাজরী—-ও বড়দি শোন, এ কেমন বৌমা আনলে গো বয়স তো মনে হয় রমার থেকে বেশি। জিনিস পত্র টাকা পয়সা কিছু দিয়েছে মনে হয়, না হলে এমন বউ কেউ পছন্দ করে!
বড়দি—— কি যে কও কাজরী, রমা কইলো, ‘বিয়া করুম শ্বশুরের মাইয়ারে, জিনিস পত্তরের লগে বিয়া করোন যায় না, ট্যাহা পয়সা তো নিয়ে কামাইতে পারি। জিনিস যা লাগবো হগল তো ঘরে আছে’।
কাজরী —– শুনেছিলাম কত জায়গা থেকে বলেছিল টাকা পয়সা দেবে,

বড়দি—আর কইয়ো না, পোলায় কইলো এই মাইডারেই বিয়া করবো। মাইয়ার বাপ নাকি গরিব। হের ইচ্ছা হইছে গরিবের মাইয়া উদ্দার করবো। একখান আংটি দিছে। আর কিছু দেয় নাই।
ইতিমধ্যে রীতাদি উপস্থিত। বউ দর্শন করে বড়দির পাশেই দাঁড়িয়ে শুনছেন আর কিছু বলার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন।
রীতাদি —-বড়দি, সেদিন তো তোমাকে বললাম আমার বোনঝি ছিল, স্বাস্থ্য টাস্থো ভালো, দেনাপাওনাও ভালোই পাওয়া যেত।
বড়দি- আর কইয়ো না বড়বৌ, পোলায় কইলো হ্যাগো অনেক ট্যাহা আছে, বাইট্টা – মোটা মাইয়া অনেক ভালো জায়গায় বিয়া দিতে পারবো, আর হেই মাইয়ার বাপ গরিব।
রীতাদি—- দেখো কেমন হয় তোমার বৌমা। এত রোগা চেহারা বাব্বা না জানি কতকাল ভাত খায়নি।

গোমরা মুখে শ্যামাকান্তের বউ রত্না এদিক ওদিক করছিল, শ্বাশুড়ী গ্রুপ দেখে (রত্নারও ইচ্ছা ছিল ওর খুড়তুতো বোনের সাথে বিয়ে হলে দুবোনে এবাড়িতে রাজ করতে পারতো। চেষ্টা করেছে কয়েকবার, কিন্তু রমা একদম নাছোড়বান্দা ছিল। বেয়ান থাকবে বেয়ানের মত। তাকে কি বিয়ে করা যায়। তাই সেখানেও অমত) গোল গুঞ্জনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
ভিড় ঠেলে রমলা দি এসে হাজির— বড়দি তোমার বৌমা দেখে এলাম। মুখে তো হাসি দেখলাম না। কেমন বউ হবে কে জানে!
কাজরী—-ও রমলা দি হাতে সোনার বালা জোড়া দেখেছো? একদম পাতলা। আমার তো মনে হয় কোন অদ্দিকালে কেনা ছিল তাই দিয়ে মেয়ে বিদায় করেছে।
এরপর বড়দি’কে উদ্দেশ্য করে ‘সত্যি বলছি তোমার ছেলেটা ঠকে গেছে, এমন ছেলে আর কেমন তাঁর বউ। পছন্দ আছে তোমার ছেলের।’
রত্না এতক্ষণ শুনেই যাচ্ছিল। একটু পরেই বাসি বিয়ে সে তা ভুলে গেছে।
রত্না — মা আপনি মনে কষ্ট নেবেন না, আমি আছি তো নাকি।
বড়দি— ও বৌমা তুমি একটু ওদিকটা সামলাও আমি আইতাছি।
এই বলে বড়দি তাঁদেরকে বললেন
—– তোমরা হগলে মিলা বাসি বিয়া সামলাও। আমি যাই দেহি । এই বলে বড়দি গ্রুপ থেকে হয়তো আজকের মতো আলাদা হলেন। বড়দির মনের অবস্থা কোন পর্যায়ে গেছে তা তিনি ছাড়া অন্য কারো জানা সম্ভব নয়।

একদিকে বাসি বিয়ে হচ্ছে, অন্যদিকে মহিলা মহল নিজস্ব ঢঙে নতুন খাতা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আড্ডার সদস্যাগণ


তরুণের মা শিক্ষিকা- কাজরী
কাজরীর ছোট জা- আরতি
ফটিকের বউ- সন্ধ্যা
মৌ দিদি
রীতা দি
রমলা বৌদি
সুলতা
কাকি- কল্পনা
জ্যেঠিমা
বড়দি –
শ্যামাকান্তের বউ- রত্না

লেখকের বক্তব্য:  আমি ব্যক্তিগত ভাবে মাতৃসমা নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই কিছু ভুলত্রুটি দূরীকরণের প্রয়াসে এই ধারাবাহিক। মহিলা মহল বলতে তাঁদেরই দেখানো হয়েছে যারা এই আড্ডার সদস্য।     

(ক্রমশ লেখা চলবে যদি মা-বোনেরা আগ্রহী হন, নচেৎ এটাই শেষ লেখা হবে।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *