Spread the love

        ★ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য★

* কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন *

—— কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন–১৪
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )

★ দ্বাদশ দিনের যুদ্ধ ★
৫) সংশপ্তকগণের যুদ্ধ ― ভগদত্ত বধ ।

খরবেগ সলিলা গঙ্গা সরযূ যথা,
দুইপক্ষ সেনা মিলিত হইল তথা।।
হেরি সবে আগমন পার্থের রণে,
হর্ষধ্বনি করে সব পুলকিত মনে।।
কহেন অর্জুন, “হের, দেবকী নন্দন,
আসিছে ত্রিগর্ত ভ্রাতা লভিতে মরণ।।
তারা সব করে আজি হর্ষ প্রকাশন।
ক্রন্দনই ছিল উচিত তাদের এখন”।।

নিনাদিল দেবদত্ত শঙ্খ মহারবে।
শত্রুগণ কিয়ৎক্ষণ বিমূঢ় সবে।।
অতঃপর দুই পক্ষের শর বর্ষণ।
অর্জুন যুদ্ধে রত ভয়ঙ্কর ভীষণ।।
সংশপ্তক সেনাগণ রণেতে ভীত।
রণ ছাড়ি সবে তারা গমনে উদ‍্যত।।
হেরি তাই সুশর্মা কন, “হে সেনাগণ,
পলাইত নাহি হও শোন বন্ধুগণ।
দুর্যোধন কাছে মোরা করেছিনু পণ,
নাশিয়া অর্জুনে জিনিব এ মহারণ।।
দুর্যোধন সকাশে কি কহিবে এখন ?
যুদ্ধ ত‍্যজি পলাইত বাঁচাতে জীবন ?
পলায়ন কভু নয় বীর যদি হও ।
ক্ষত্রিয় তোমরা সবে রণে ব্রতী রও।।
অতএব যুদ্ধ শুরু করহ আবার।
যুদ্ধ জয় নিশ্চয় সন্দেহ নেই আর”।।
*
অর্জুন কহেন, ” কৃষ্ণ করহ শ্রবণ,
শত্রু মাঝে রথ তুমি করহ চালন।।
সংশপ্তকগণ জীবিত যতক্ষণ,
ত‍্যজিব না রণভূমি করিলাম পণ”।।
অর্জুন করেন ভীষণ শর বর্ষণ।
অতঃপর করেন ত্বাষ্ট্র নিক্ষেপন।।
প্রতি মূর্তি সৃষ্ট নানা হাজারে হাজারে।
বিমূঢ় বিপক্ষ সেনা পরস্পরে মারে।।
ভাবিল বুঝি অর্জুন হইল নিধন।
ক্ষণপরে ভাবে কৃষ্ণে করিনু হনন।।
হেনরূপে শত্রুদলে করেন পীড়ন।
শরজালে রথ তাঁর অদৃশ্য তখন।।
অর্জুন নিহত ভাবে শত্রু সেনাগণ।
সবে করে কোলাহল পুলকিত মন।।
অর্জুন বায়ব‍্য অস্ত্র করেন মোচন।
ছত্র ভঙ্গ হয় তায় শত্রু সেনাগণ।।
অর্জুন শরেতে সেনা হাজারে হাজারে,
হত হয়ে পড়ে ভূমে কাতারে কাতারে।।

গরুড় ব‍্যূহ রচিয়া দ্রোণ সেনাপতি,
সসৈন‍্যে ধাবিত যুধিষ্ঠিরের প্রতি।।
ব‍্যূহ মুখেতে স্বয়ং বিরাজেন দ্রোণ।
মস্তকে স্থিত সেথা সভ্রাতা দুর্যোধন।।
নেত্রদ্বয়ে স্থিত কৃতবর্মা – কৃপাচার্য।
গ্রীবায় কলিঙ্গ সিংহল নৃপতি প্রাচ‍্য।।
দক্ষিণে বামে যতেক রথী মহারথ।
বক্ষস্থলে তাহার রহেন জয়দ্রথ।।
ব‍্যূহ পিছে কর্ণ আর পুত্র বৃষসেন।
মাঝে রাজা ভগদত্ত হস্তিতে গমেন।।
*
অর্ধচন্দ্র ব‍্যূহ এক করিয়া রচন,
যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ‍্যুম্নে কহেন তখন,
“করহ তুমি আজিকে এরূপ কৌশল,
ব‍্যর্থ যেন হয় দ্রোণ-প্রয়াস সকল”।।
ধৃষ্টদ‍্যুম্ন কন, ” আমি থাকিতে জীবিত,
আপনারে হেরি আজ কেন বিচলিত।।
দ্রোণে আমি নিশ্চিত করিব নিবারণ।
তাই দুশ্চিন্তা নয়তো কভু অকারণ”।।
ধৃষ্টদ‍্যুম্নে সম্মুখে হেরি উদ্বিগ্ন মন,
দ্রোণাচার্য করেন তীব্র শরবর্ষণ।।
বিনাশিত সেনা তাহে হাজারে হাজারে।
পতিত রথাশ্ব হস্তি কাতারে কাতারে।।
ছত্রভঙ্গ দুই দল ক্ষণকাল পরে।
উন্মত্ত সেনাদল হানিছে পরস্পরে।।
যুধিষ্ঠিরে রক্ষিতে এলেন সত‍্যজিৎ।
পরিশেষে হলো তাঁর মৃত্যু সুনিশ্চিত।।
পাঞ্চাল, ককেয়, মৎস যোদ্ধৃগণ,
একযোগে দ্রোণে করেন আক্রমণ।।
কিন্তু তাঁরা পরাজিত হইলেন সবে।
পুলকিত কুরুসেনা বিজয় গৌরবে।।
কর্ণে কহেন হর্ষিত রাজা দুর্যোধন,
“পাঞ্চাল সেনা দেখ করিছে পলায়ন।।
মহাক্রোধী ভীমসেন সে অতি দুর্মতি।
রক্ষিতে জীবন হয়েছে নিরাশ অতি।।
কর্ণ কহেন,”জীবিত ভীম যতক্ষণ,
করিব না ত‍্যাগ কভু আমি এই রণ।।
যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রোণাচার্য আছেন যেথায়,
কর্তব্য মোদের ত্বরা গমন সেথায়।।
নতুবা হস্তি হন্তারে কোকদল যথা,
পাণ্ডব সেনাদল দ্রোণে বধিবে তথা”।।
কর্ণমুখে শুনি হেন শঙ্কিত বচন,
দ্রোণ পাশে সবে ত্বরা করেন গমন।।
*
ইন্দ্র বাহন যে হস্তি দৈত্যের নিধনে,
উত্তর হস্তি তার ভগদত্ত বহনে।।
সেই হস্তি পৃষ্ঠে তিনি করি আরোহন,
ভগদত্ত ভীমসেনে করেন আক্রমণ।।
পাঞ্চাল সেনা সহ যুধিষ্ঠির তখন,
রোধিবারে ভগদত্তে করেন গমন।।
ভগদত্ত সনে যুদ্ধে দশার্ণরাজ হত।
হেরিয়া পাঞ্চাল সেনা ভয়ে পলাইত।।
*
অর্জুন করিয়া শ্রবণ হস্তি বৃংহণ,
উচাটন মনে তিনি সারথিরে কন,
“ভগদত্ত হস্তি গর্জন ইহা নিশ্চয়,
অনলেও এ হস্তির কিছু নাহি হয়।।
সে আজ করিবে সকল সেনা নিধন।
ভগদত্ত সকাশে ত্বরা করহ গমন”।।
অর্জুন সসৈন‍্যে করেন যাত্রা যখন,
শত্রুদল পিছে তাঁর করিল গমন।।
অর্জুন ভাবিত তাঁর নিজ মনে মনে,
দুর্যোধনোদ্ভাবিত এই কৌশলী রণে,
শত্রুরে বধিতে আমি করিব যতন,
নাকি যুধিষ্ঠিরে আমি করিব রক্ষণ।।
শত্রু বধ শ্রেয় তখন ভাবিয়া মনে,
নাশিলেন সবে প্রায় ব্রহ্মাস্ত্র ক্ষেপনে।।
অতঃপর কহেন তিনি কৃষ্ণে তখন,
“ভগদত্ত সকাশে এবে করহ গমন।।
সভ্রাতা সুশর্মা পিছে করিল গমন।
অর্জুন শরে তাঁরে করেন নিবারণ।।
সুশর্মাভ্রাতা সকলে করিয়া বিনাশ,
পার্থ উদ‍্যত গমনে ভগদত্ত সকাশ।‌।
*
ভগদত্ত আর পার্থে চলে যুদ্ধ তুমুল,
সেনাদল চঞ্চল বাঁধে হুলস্থূল।।
কৃষ্ণার্জুনে ভগদত্ত করিতে নিধন,
হস্তীরে তাঁর সবেগে করন চালন।।
সরালেন রথ কৃষ্ণ দক্ষিণে সত্বর।
ভগদত্ত পিছে রথ ডাহিনে উত্তর।।
যুদ্ধধর্ম অর্জুন তখন করেন স্মরণ।
পশ্চাতে বধিতে তাঁরে না হইল মন।।
*
শরাঘাতে হস্তীবর্ম ভূমিতে লুটায়।
তাই হেরি ভীত হস্তী সেনা মাঝে ধায়।।
ভগদত্ত বৈষ্ণবাস্ত্র করেন ক্ষেপন।
সেই অস্ত্র বক্ষে কৃষ্ণ করেন গ্রহন।।
ফুল মালা হলো তাহা গলে সেই ক্ষণে‌।
হেরি তা ভগদত্তের শঙ্কা জাগে মনে।।
কহিলেন অর্জুন দুঃখিত মনে,
“শপথ ভঙ্গ করিলে কৃষ্ণ তুমি এক্ষণে।।
করিবে না যুদ্ধ তুমি করেছিলে পণ।
সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ তুমি করিলে এখন।।
সমর্থ, সতর্ক আমি অস্ত্র নিবারণে।
উচিত নহেক তব যুদ্ধ অকারণে”।।
কহিলেন কৃষ্ণ, “দোষ না হইল কোন।
আছে এক গূঢ়তত্ত্ব কহি আমি শোন।।
হইলেও এক আমি চার মূর্তি ধরি।
জগতের বিপদে হিত সাধন করি।।
এক মূর্তি করে তপস্যা একাগ্র মনে।
আন মূর্তি বিচারে সাধু অসাধু জনে।।
তৃতীয় মূর্তি করে কর্ম এই ভুবনে।
চতুর্থ সহস্র কাল নিদ্রিত শয়নে।।
সহস্র বৎসরান্তে করি গাত্রোত্থান,
যোগ্য ব‍্যক্তিগণে করি আমি বর দান।।
পৃথ্বী প্রার্থনায় দানিলাম সেই কালে,
নরকাসুরে বৈষ্ণবাস্ত্র তৎকালে।।
ভগদত্ত সেই অস্ত্র লভিলেন পরে।
নরকাসুর কালক্রমে দানিলেন তাঁরে।।
এই অস্ত্রে অবধ‍্য কেহ নাহি এ ধরায়।
করিলাম ধারণ তাহা রক্ষিতে তোমায়।।
ভগদত্ত হয়েছেন পরমাস্ত্র হীন।
এক্ষণে তাঁরে নিধন হয় সমীচীন।।
অর্জুন নারাচ অস্ত্র করেন প্রয়োগ।
আঘাতে তার ভগদত্তবাহন বিয়োগ।।
অতঃপর ত‍্যজিলেন অর্ধচন্দ্র বাণ।
বিদারিত হৃদয় ভগদত্ত নিষ্প্রাণ।।
*
তারপরে তিনি যান দক্ষিণ দিকেতে।
শকুনির দুই ভাই আইলেন রোধিতে।।
অর্জুন বধিলেন দোঁহে একই শরে।
তাই হেরি কুরুসেনা ভয়ে সবে মরে।।
শকুনি করেন মায়া সম্মোহিতে অর্জুনে।
দূরীভূত সে মায়া তাঁর শর বর্ষণে।।
তাই হেরি শকুনি হলেন ভয়ে ভীত।
অতঃপর ছাড়ি রণ তিনি পলাইত।।
*
দ্রোণ সনে ধৃষ্টদ‍্যুম্ন রণেন ভীষণ।
দোঁহাকার শরজালে আচ্ছন্ন গগন।।
অশ্বত্থামা নীলরাজে যুদ্ধ মরণ পণ।
খড়্গাঘাতে নীলমস্তক করেন ছেদন।।
*
উদ্বিগ্ন মহারথগণ হয়ে অসহায়,
রহেন তাঁরা সবে অর্জুন প্রতীক্ষায়।।
ত‍্যজিয়া প্রাণের মায়া ভীমসেন তখন,
রণিলেন দ্রোণ সনে সঙ্গে দুর্যোধন।।
ধৃষ্টদ‍্যুম্ন সেনাগণে করেন উদ্দীপ্ত।
ধাবিল সবে দ্রোণ প্রতি অতি ক্ষীপ্ত।।
দ্রোণ করেন তখন তীব্র শর বর্ষণ।
নিপীড়িত পাঞ্চাল চেদি পাণ্ডবগণ।।
হেনকালে ধনঞ্জয় আইলেন তথা।
যুগান্তকালে উদিত ধূমকেতু যথা।।
অর্জুন অস্ত্র তেজে পীড়িত কুরুকুল।
শরাঘাতে কুরুসেনা মরে বিলকুল।।
সেনা মাঝে ওঠে রব ঘোর হাহাকার।
হুটোপুটি অশ্ব হস্তী সব একাকার।।
সেনা হাহাকারে কর্ণ বিচলিত হন।
আগ্নেয়াস্ত্র বাণ তাই করেন ক্ষেপন।।
অর্জুন সেই বাণ করেন নিবারণ।
কর্ণভ্রাতৃত্রয়ে পরে করেন হনন।।
*
ভীমসেন ধৃষ্টদ‍্যুম্ন রণেন ভীষন।
খড়্গাঘাতে চন্দ্রবর্মা হইল নিধন।।
পঞ্চদশ সেনা আর বীর নিষধরাজ,
ভীম গদাঘাতে সবে নিপাতিত আজ।।
অতঃপর সূর্যাস্ত নামিল আঁধার।
দুই পক্ষ সেনা শ্রান্ত ঘোষিত অবহার।।
(চলবে)
★★★