- কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন *
—— কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন–১৩
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
★ একাদশ দিনের যুদ্ধ ★
- ৩৷ অর্জুনের জয় *
চর মুখে সংবাদ পাইয়া যুধিষ্ঠির,
রক্ষিতে নিজেরে করেন মনস্থির।।
কহেন অর্জুনে, “সব করিলে শ্রবণ,
করিবারে রক্ষা মোরে করহ যতন।।
দ্রোণ পণে স্থিত তথা ছিদ্র সূক্ষ্ম অতি।
ছিদ্র সে মোদের লাগি করিবারে গতি।।
অতএব কর রণ থাকি মোর পাশে,
চেষ্টা কর অবিরত শত্রু ইচ্ছা নাশে”।।
করি শ্রবণ পার্থ তখন কন যুধিষ্ঠিরে,
শান্ত বিনম্র কথন অতি ধীরে ধীরে।।
“দ্রোণ হত্যা গুরু হত্যা ঘোর পাপ অতি।
তাই তাঁরে বধ করে কেন করি ক্ষতি।।
যতক্ষণ আছে মোর এই দেহে প্রাণ,
আপনারে ততক্ষণ দিব আমি ত্রাণ।।
★
বাজিল শঙ্খ, মৃদঙ্গ, নিনাদ তুমুল।
সেনাদল চঞ্চল লাগে হূলুস্থূল।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণ রত তীব্র মারণ রণ।
উভয় পক্ষ সেনা রণে মরণ পণ।।
দ্রোণ বাণে পাণ্ডু সেনা হত কত শত।
যুধিষ্ঠির-বাণ ছোটে করিবারে হত।।
সহদেব শকুনি, সাত্যকি কৃতবর্মা,
শিখণ্ডী ভূরিশ্রবা, ধৃষ্টদ্যুম্ন সুশর্মা,
নকুলে মাতুলে রণ অতীব তুমুল।
শরাঘাতে সেনা সব মরে বিলকুল।।
অভিমন্যু বৃহদ্বলে চলে মারণ রণ।
শরাঘাতে বৃহদ্বলের হইল পতন।।
অভিমন্যু জয়দ্রথে বধিবারে ধায়।
পরাজিত জয়দ্রথ খড়্গাঘাতে তায়।।
শল্য তাই অভিমুন্যে বধিতে উদ্যত।
অভিমুন্য বাণে শল্যসারথি নিহত।।
নাহি পথ শল্যের করেন অবতরণ।
গদাযুদ্ধ লাগি গদা করেন গ্রহণ।।
অবতরি রথ অভি গদাযুদ্ধে রত।
ভীমসেন আসি তারে করেন বিরত।।
শল্য ভীমে গদাযুদ্ধ চলে মহারণ।
গদার আঘাতে গদায় অগ্নিস্ফূরণ।।
এমনে চলিল যুদ্ধ অতি দীর্ঘ ক্ষণ।
অতঃপর ভূপতিত হন দুই জন।।
কৃতবর্মা আসি শল্যে করেন তোলন।
নিজ রথে তিনি তাঁরে করেন গ্রহণ।।
ত্যজিলেন রণভূমি কৃতবর্মা সনে।
উত্থিত ভীমসেন তার পর ক্ষণে।।
★
কুরুসেনার পরাজয় হয় অবিরত।
কর্ণপুত্র বৃষসেন তাহে বিচলিত।।
রণস্থলে আইলেন করিবারে রণ।
শতানীক সাথে চলে যুদ্ধ ভীষণ।।
দ্রৌপদী-পঞ্চপুত্র আইলেন ত্বরিতে।
শতানীক ভ্রাতা পাশে তাঁরে রক্ষিতে।।
পাণ্ডব সঙ্গী পাঞ্চাল মৎস কেকয়।
অস্ত্র হাতে উদ্যত সব যোদ্ধৃ সৃঞ্জয়।।
কুরুসেনা ছত্র ভঙ্গ সকলে মর্দিত।
ভয়ে ভীত কুরুসেনা কত পলাইত।।
হেরি তাই বিচলিত দ্রোণ সেনাপতি।
কর যুদ্ধ সেনাগণ কেন হেন মতি।।
রণ ত্যজি পলায়ন সেতো মন্দ অতি।
যুদ্ধক্ষেত্রে মরণ সে বীরোচিত গতি।।
অতএব কর যুদ্ধ কোন ভয় নয়।
ক্ষত্রোচিত রণে ঠিক হবে আজ জয়।।
অতঃপর ধাবিলেন লক্ষ্য যুধিষ্ঠির।
বন্দী করিবেন তাঁরে এই মনোস্থির।।
সেনাগণ পুলকিত হেরি তাঁর রণ।
যুধিষ্ঠির ধৃত হলে খুশি দুর্যোধন।।
হেনকালে অর্জুনের সহসা উদয়।
ভয়ঙ্কর বাণে তাঁর মনে জাগে ভয়।।
শরাঘাতে কুরুসেনা হত কত শত।
হেরি তাই কত সেনা ভয়ে পলাইত।।
দ্রোণ সাধ নাহি পূরে পার্থ আগমনে।
কহিবেন কিবা তিনি আজি দুর্যোধনে।।
ক্ষণ পরে সূর্যাস্ত নামিল অন্ধকার।
স্তব্ধ রণ সেক্ষণে ঘোষিত অবহার।।
★★★
★সংশপ্তক পর্বাধ্যায়★
৪) সংশপ্তকগণের শপথ।
সেই দিন যুদ্ধ যবে হলো সমাপন,
আলোচনা করে রাতে সব কুরুগণ।।
পরাজিত দ্রোণ লাজে কন দুর্যোধনে।
“ব্যর্থ আমি সুখ নাই অতি দুখ মনে।।
কহিলাম পূর্বে যদি থাকে ধনঞ্জয়।
সব আশা নাশ হবে করিবারে জয়।।
কৃষ্ণার্জুনে জয় করা দেবসাধ্য নয়।
পার্থ যদি থাকে রণে কভু নয় জয়।।
দূরে তারে যাও নিয়ে তুমি বুদ্ধিবলে।
যুধিষ্ঠির হবে ধৃত জেনো তার ফলে।।
পার্থে কেহ দাও ডাক কাল মহারণে।
যুধিষ্ঠিরে তাল বুঝে হরি সেই ক্ষণে”।।
সেনাপতির হেন কথা করিয়া শ্রবণ,
ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা কহেন তখন।।
“অর্জুন করে সদা কত অপমান।
মোরা সব দিব তারে যোগ্য প্রতিদান।।
প্রিয় কাজ কাল এক করিব সাধন।
ডাক দিয়ে যুদ্ধে তারে করিব হনন।।
করিলাম পণ মোরা আজি এই ক্ষণে।
যথা শক্তি করি চেষ্টা বধিব অর্জুনে।।
হয় এই ধরা হইবে অর্জুন বিহীন,
নতুবা তাহাই হইবে ত্রিগর্ত হীন”।।
করিয়া হোম সুশর্মা শপথে উদ্যোগী।
পঞ্চ ভ্রাতা সকলে তার হইল সঙ্গী।।
অযুত রথে ললিত্থ, মদ্রক নৃপতি।
আইলেন সেই সাথে মাবেল্লক নৃপতি।।
হোম করেন সবে করি অগ্নি প্রজ্বালন।
কৌপিন কবচ তাঁরা করেন ধারণ।।
ব্রাহ্মণে করিয়া ধেনু বস্ত্র বিতরণ,
অগ্নি সম্মুখে করেন শপথ গ্রহণ।।
“অর্জুনে না বধি যদি কভু ফিরি মোরা,
মিথ্যাবাদী ব্রহ্ম ঘাতী হইব তবে মোরা।।
হইয়া পাপে মহা পাপী গুরু দার গামী,
আমরা সকলে হইব নরক গামী।।
শরণাগত ত্যাগে, রাজবৃত্তি হরণে,
বেদ বিদ্বেষ আর গৃহ দাহ করণে,
মহাপাপে পাপীর হয় যে নরক বাস,
আমাদেরও হয় যেন সেই নরক বাস।।
আর যদি করি মোরা অর্জুনে বিনাশ,
সেই পুণ্যে স্বর্গ মোদের হইবে নিবাস।।
হেন রূপে করি পণ সকলে তখন,
পার্থ নাশে তাঁরা সবে করেন গমন।
পার্থে তাঁরা রণ তরে করেন আহ্বান।
সাধ্য কি অর্জুনের করেন প্রত্যাখান।।
আহূত পার্থ তখন যুধিষ্ঠিরে কন,
শত্রু নাশি আসি ফিরে অতি অল্প ক্ষণ।।
আহূত হইলে গমি এই ব্রত মম।
অনুমতি দিলে বধি শত্রু পশু সম।।
যুধিষ্ঠির কন, “পূর্বে কহিনু তোমায়,
দ্রোণ চাহেন করিবারে বন্দী আমায়।।
সিদ্ধ না হয় যেন তাঁহার অভিপ্রায়।
অতঃপর কর তব মন যাহা চায়”।।
অর্জুন কন,”সত্যজিৎ পাঞ্চাল বীর,
রক্ষা লাগি রহিলেন ইনি মহাবীর।।
রণক্ষেত্রে যদি তাঁর না হয় মরণ,
দ্রোণ ইচ্ছা না হইবে কভুও পূরণ।।
সত্যজিৎ রণে কভু হইলে নিহত,
ত্যজিবেন রণস্থল হইয়া মিলিত।।
যুধিষ্ঠির অর্জুনে করিয়া আলিঙ্গন,
অনুমতি দেন তাঁরে করিবারে রণ।।
( চলবে )
★★★
কবি কৃষ্ণপদ ঘোষের ” কুরুক্ষেত্রে আঠেরো দিন ” চৌদ্দ মাত্রার পয়ার ছন্দে পৌরাণিক কাব্য আমরা আধুনিক কালে আধুনিক পৌরাণিক স্বাদ পাচ্ছি ! খুব কঠিন কাজ উনি করছেন ! পুরো লেখাটি পৌরাণিক ছবি সহ গ্রন্থ হিসেবে বেরুলে আমরা নতুন সুখে পৌরাণিক কাব্যকে পাবো ! আমি তো কিনবোই যত দাম হোক ! তবে, কবিকে আরো নিখুঁত করে দেখে তবে মুদ্রণে দিতে হবে ! ছবি গুলি অবশ্যই মানানসই হতে হবে, দেখলে যেন প্রাচীন সময়ের দৃশ্য গুলি অনুভব করতে পারি ! বইটি ঠিই মত লেখা ও ছবি হলে পুরস্কৃত হবার যোগ্য হয়ে উঠবে ও বাংলার অনেক ঘরে জায়গা করে নেবে ! কবিকে খুব সতর্ক হতে হবে ! কারণ কাজ বিকৃত করে দেওয়া ও এগুনোর সুস্থ পথকে নানা ভাবে বিপন্ন করে দেওয়ার লোকজনের অভাব নেই !
কথাটা আমার অনেক অভিজ্ঞতা ও কান্নার ফলাফল !
নতুন নিয়মে তিনি মহাভারত এর কাহিনীকে কাব্যের গুণে আমাদের উপহার দিচ্ছেন ! এই জাতীয় কাজকে আন্তর্জাতিক পত্রিকা kabyapot.Com প্রকাশ করছেন ধারাবাহিক ভাবে, এটা খুবই স্বস্থিকর ব্যাপার ! কবি পৌরাণিক বিষয়ের কাজকে আরো বাড়িয়ে তুললে, বাংলাভাষা আরো উজ্জ্বল হবে, আমরা অনেক তৃপ্তি পাবো ওই প্রাচীন রসের কাব্যে !
এ সবের মজা আলাদা !
কবিতার আধুনিকতা মানে পুরোনো রসকে অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে আসা নয়, নতুন -নতুন রচনা শৈলী ও বিষয়ের ঘ্রান দিয়ে আধুনিকতর কবিতা বা কাব্য হচ্ছে ও হবে , কিন্তু পুরানো চিন্তন ও রসের জৌলুসকেও আধুনিক সময়ে সাহস করে তুলে ধরা খুব কঠিন ব্যাপার !
এই কবি সেটাই করছেন ! কবিকে শুভেচ্ছা জানাই !
— ঋদেনদিক মিত্রো
( Ridendick Mitro )
পেশা : ইংরেজি ও বাংলা ভায়ায় কবি -ঔপন্যাসিক-গীতিকার-নিবন্ধকার ! কলকাতা, ভারত !
শ্রদ্ধেয় ঋদেনদিক মিত্র মহাশয়,
আমার লেখা “কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন” পৌরাণিক কাব্যের উপর আপনার লেখা মন্তব্য পড়ে খুবই কৃতজ্ঞ ও অনুপ্রাণিত হলাম। আপনাদের সকলের শুভেচ্ছা এবং ভালো লাগাই আমার পাথেয়।
কাব্যটির প্রথম দিকের কয়েকটি অধ্যায়ে কিছু কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিশেষতঃ (৮+৬) মাত্রার পয়ার ছন্দে।
যাই হোক আমি ত্রুটি সম্পাদনা ক’রে মূল কাহিনীকে যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে পাঠককুলের গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করছি। তারপর সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা।
——– নমস্কারান্তে
কৃষ্ণপদ ঘোষ।