প্রমা-৪
দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়
প্রমা আবার দিদার মাছ খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে ,আচ্ছা তুমি মাছ খাও না কেন ? মানে মাছ খাওয়া ছাড়লে কেন ? এ বাড়িতে তো কেউ ডিম মাংস পেঁয়াজ খায় না, শুধু মাছটাই খেতো। সেটাও কেন বাদ দিলে ?
সে অনেক কথা তোর দাদা মশাই মাছ ধরত, তার অনেক হুইল ছিল বড় বঁড়শী মেজ বঁড়শী ছোট বঁড়শী আর নানা রকমের ছিপ , আবার সেসব রাখার আবার সুন্দর ব্যবস্থা। সেসবে সৌখিন দাদা মশায়ের অনেক ঘটা ছিল মাছ ধরার। পুকুর জমা নেয়া থাকত, টাকা দেওয়া থাকতো, সেখান থেকে সবসময় মাছ ধরা যেত। মাছ খাওয়া হতো তিনদিন সোম বুধ আর শুক্র। ওই তিন দিনের মধ্যে একাদশী পূর্ণিমা অমাবস্যা পূজা পার্বণ পড়লে সেদিনগুলো বাদ পড়ে যেত। মাছ প্রচুর আসলেও, কষ্ট করে মাছকুটে ধুয়ে বেছে রান্না করলেও, এতগুলো পাতে দিয়ে ,—আমার জন্য কোন মাছ ই পড়ে থাকত না। কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করলো তোর দাদা মশাই ,তারপর একদিন নিজের পাতেই এক টুকরো মাছ ফেলে রাখল। আর উঠতে উঠতে বলল এই মাছটা তুই খেয়ে নিস, বুঝলি— আমি মাথা নাড়লাম।
কোথায় ছিল লালমনি জানিনা চিলের মতন সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল খোঁড়া ননদের ছোট মেয়ে টুনিকে বলল, এই বড় মামার পাতে বসে যা, এই রাঙাদি ওকে দাদার পাতে দুটো ভাত দিয়ে দাও।
তোর দাদা মশাই ভারি অবাক হলো আর আমার দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে সরে গেল ।
আমি বললাম টুনি মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছে। উত্তরে লালমনি বলল সে কখন খেয়েছে তার ঠিক নেই কো? এখন ওর আবার খিদে পেয়েছে, দিয়ে দাও দেখিনি দুটো ভাত—
তারপর থেকে ঠিকই করে নিয়েছিলাম, আর কোনদিন মাছ ই খাব না।
লালমনি এমন এক চরিত্র যে সকলকে ত্রাসে ফেলতে সক্ষম। সব সময় দাবিয়ে কথা বলে ,সবার মাথার উপর চড়ে বসে থাকতো। এই পরিবারের গৃহিণী আমি হলেও আমার স্বামীর টাকায় সংসার চললেও ,এ বাড়িতে আমি লালমনির দাসী বাঁদীর মত থাকতাম।
একবার আমার জৈষ্ঠ্য মাসের দুপুরে খুব চেষ্টা পেয়েছে এক গ্লাস জল চেয়েছি, ঝকঝকে একটা কাঁসার গ্লাসে ভর্তি জল নিয়ে সে আমার আশেপাশে ঘুরতে লাগলো, জলটা সে কিসে ঢেলে দেবে ?অথবা গ্লাসটা কোন পবিত্র জায়গায় বসিয়ে দেবে ? সব তো অপবিত্র ! আমি ভাত খেয়েছি, কাপড় কেচে ফ্রেশ হয়নি, কারণ আমি খেয়ে খড় কাটবো, বাসন মাজব ,রান্নাঘর পরিষ্কার করবো, তারপর কাপড় কেচে ফ্রেশ হয়ে গরুর দুধ দুইবো। এ সময় জল পাব কোথায় ?প্রমা, বড় চোখ করে বলল তারপর ! আর কি অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর আমার চারপাশে আর তেষ্টা সামলাতে পারলাম না, খপ করে গ্লাসটা নিয়ে জলটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললাম। আর ব্যশ তখনই লালমনি বলে উঠলো আমাকে ছুঁয়ে ফেললে,— বলেই ছুট ,—একেবারে পুকুরে গিয়ে এক ডুব, একদম আবার পবিত্রতা ফিরিয়ে আনলো ।আর গজ গজ করতে লাগলো, জ্বলে জ্বলে বলতে লাগলো নানা কটুকথা,আমি খুব লজ্জা পেলাম বটে। কিন্তু আমি কিছু বললাম না। এভাবেই রোজ পাকে প্রকারে জ্বালাতন করতো।
একবার ছোট ননদ বিমলার মেজো ছেলে কিছুতেই পড়াশোনা উড়িয়া ভাষায় রপ্ত করতে পারছিল না ,বড় ছেলে রপ্ত করে পাশ করে গেলেও মেজো ছেলের খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তাই সে ঠিক করল যে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে,—অর্থাৎ, এখানে কালাচাঁদ স্কুলে ভর্তি করিয়ে একটা পাস করিয়ে উড়িষ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ঘটনাটা বাস্তব সম্মত ছিল,এঁড়ে লাগলো মেজ ননদের,— তিনি বললেন ,তবে আমার ছোট ছিল এখান থেকেই একসঙ্গে পড়াশোনা করবে।
এই না দেখে মুখ্য সহজও সরল ওপরের দুই ছেলের মধ্যে মেজ ছেলেকে রেখে পড়াবার জন্য বন্দোবস্ত করতে লাগলো লালমনি, এই ছেলে স্বাভাবিক লেখাপড়া বহু পূর্বেই ছেড়ে দিয়েছিল। তাই স্কুলে ভর্তি হবার কোন জায়গা ছিল না। সংস্কৃত টোলে পুরোহিত বানানোর জন্য ভর্তি করে দিল। গরু ছাগলের সঙ্গে তিন বছর ধরে ওই সকল ছেলেদের স্কুলের ভাত দেবার দায়িত্ব আমার ওপর এই বর্তাল। একটু থেমে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,—
সবকিছু এই মানুষটার উপর দিয়ে গেল ,অথচ অসময়ে কেউ একবার উঁকিও দিল না।
এরকম চলতে চলতে সবাই বড় একঘেয়ে হয়ে উঠলো ,সংসারে কাজের চাপের থেকে মুক্তি দিতে তোর দাদা মশাই এর ওই সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া ।তাতেও মাঝে মধ্যে লালমনি সঙ্গী হয়ে যেত,— কাবাব মে হাড্ডি হতে ! মাঝে মাঝে জাড়তুতো দাদার বাড়ি যেতে চেয়েছি, কিন্তু ওরা আমার বরকে দেখলে ব্যস্ত হয়ে খাবার দাবার আনিয়ে এমন একটা আচরণ করতো, যে আমার আর কিছু বলার অবকাশ থাকতো না। একদিন থাকতেও বলতো না ।তোর দাদা মশাই ও রাখার কথা বলতে চাইতো না, বলতো বেকার ঘরের কথা বাইরে যাবে ,! শেষে তো এখানেই থাকতে হবে —
ছোট ননদের ছেলে ও মেজ ননদের ছেলে পাশ করে চলে গেল সরল পুরোহিতের কাজ করতে শিখে এ বাড়িতেই রয়ে গেল। টুকু যেহেতু আমার একই মেয়ে জজমান সেবার জন্য তোর দাদুর ছেলের মত হয়ে উঠল । কিন্তু এর পেছনে ছিল এক অদ্ভুত কালো হাত, যা তোর দাদা মশাইকে গ্রাস করে ফেলেছিল।।
এমনই এক অসময়ে খোঁড়া ননদের বর বলল, এই নুন পড়াটা ডালে দিয়ে দাও ।সবাই যে যার জায়গায় সরে যাবে ,তুমি একটু রিলিফ পাবে ! আর ডাল সবাইকে দিলেও তোর দাদা মশাইকে আর টুকুকে দিলাম না ওদের জন্য আলাদা দুবাটি ডাল সরিয়ে রেখেছিলাম, সবাই সবার কাজের তাগিদে সরে পড়ল বটে ,খোঁড়া ননদকে নিয়ে নন্দাই বালিতে ভাড়া বাড়ি নিয়ে চলে গেল। ওই সময়ে খোড়াননদের বর অন্য মহিলা কর্তৃক আসক্ত হয়ে পড়েছিল, বড় মেয়ে ভুন্ডির বিবাহ দ্বিতীয় পক্ষের বর দেখে দিয়ে দিল ।এমন দুর্মতি দেখে টুকুর ঠাকুরমা খোঁড়ার মেজো মেয়ে কালুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো, এসে মেজ মেয়েকে ভার দিল ওর বিয়ের সমস্ত ব্যবস্থা করে দিতে ,মেজ মেয়ে নিমতায় নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে কালুর বিবাহ দিয়ে দিল যাবতীয় খরচ বহন করলো টুকুর ঠাকুমা। এরপর খোঢড়া ননদ মারা গেল। খোঁড়ার ননদের বর আবার বিয়ে করল, ছেলে ও ছোট মেয়ে এ বাড়িতে পার্মানেন্ট ফিরে এলো। এরই মধ্যে লালমনি এসে সংসারে সকলের সঙ্গে কোঁদল করতে লাগলো । সর্বোপরি সকলকে ভয় দেখাতে লাগল ,ধমকে ধমকে সবাইকে বিরক্ত করে তুলতে লাগলো ।খোঁড়ার ছোট মেয়ে একটি অন্য জাতের ছেলের সঙ্গে বাড়ি থেকে চলে গেল। এবাড়ির নিকটস্থ এক বাড়িতে ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে লাগলো ,পাশের ঘর ভাড়া নিয়ে দাদাকেও এ সংসার থেকে বিদায় দিল। খোঁড়া দেবরকে ছোট ননদ বলল ,আমাদের উড়িষ্যায় একজন ডাক্তার এসেছে একটা ইনজেকশনই পা ভালো করে দেবে ।অবশ্য একটা রিস্ক থাকছে ইনজেকশন সহ্য না হলে বাঁচতে পারবেনা টুকুর ঠাকুমা রাজি হয়ে গেল, এত কষ্টে থাকার থেকে কিছুতো একটা হবে ।খোঁড়া দেবর ইনজেকশন নেবার সাথে সাথেই হার্ট ফেল করে মারা গেল!
মেজ ননদের তিন কন্যার বিবাহিত, একে একে দুই পুত্রের বিয়ে হয়ে গেছে ।সেজ পুত্র বৌদিদের সঙ্গে বাড়িতে থাকতে পছন্দ করত ।ছোট পুত্র কর্মসূত্রে বাইরে থাকত ।সময় সময় মেজ ননদ একাই এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করত ।তবে আমার সঙ্গে ঝগড়া তক্কো ভয় দেখানো গিন্নি পানা কখনোই করত না ,যা লালমনি সবসময় করত ,তবুও তাকে বাড়ি মাঝেমধ্যে যেতে হতো।
ওই কদিন রেহাই পেতাম।
যতই ভাবতাম আমার কষ্টের দিন বুঝি এবার শেষ হয়ে যাবে। ততই কষ্ট আমাকে ঘিরে ধরতে লাগলো—
যতই ভাবতাম পরে সব ভালো হবে, পরে আর কোন কিছু ভালো হলো না।।
প্রমা বড় এক হাই তুলে বলল, কালকে আবার শুনবো পরে ঠিক তোমার কি খারাপ হলো ?
চলবে।