ধানবাদের নিরসা অঞ্চলের “খাড়াপাথর” সম্প্রীতির এক অনুপম নিদর্শন
**********************
[ভ্রমণ]
রাজকুমার সরকার
——————–
বাঙালি বরাবরই ভ্রমণপ্রিয়। একটু সময় ও সুযোগ পেলেই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে।পরে কি হবে না হবে তা না ভেবেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে এমনও বাঙালি আছেন। আসলে না হলে যে ঘোরাও হয় না। না, আমাদের এখানে ব্যাগ গোছানোর ঝামেলা নেই। খুব কাছেই একটি ভ্রমণের জায়গা অথচ যাব যাব করে যাওয়া হচ্ছিল না। ঘর থেকে হঠাৎই একদিন মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খাড়াপাথর- এর উদ্দেশ্যে। ধানবাদের মোকো গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে শালুক চাপড়া গ্রাম। বন্ধু অসীম কুমার দে কে সঙ্গে নিয়ে ড্রাইভ করতে শুরু করলাম।
আঁকদুয়ারা হয়ে কুসুমদহা মোড়। সেখান থেকে ডানদিকে চার পাঁচ কিলোমিটার দূরেই খাড়াপাথর গ্রাম। দামোদর নদের ধারেই গ্রামটি। রয়েছে প্রাচীন ভৈরবনাথ মন্দির, আশ্রম। বেশ মনোরম জায়গা। খাড়াপাথরের ধারে কাছের গ্রামগুলোতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি রয়েছেন।খাড়াপাথরে রায় (ঘাটোয়াল) ৬০/৬৫টি ঘর, আদিবাসী ঘর ২০/২৫টি, বাদ্যকর ঘর ১০/১৫টি ও মণ্ডল ঘর একটি রয়েছে। ধানবাদ জেলার একদম সীমান্ত গ্রাম। দামোদরের ওপারে পুরুলিয়া জেলা।
পাঞ্চেত জলাধার-এর শুভ উন্মোচন করেন এক আদিবাসী মহিলা। নাম- বুধনি মেঝাইন। হ্যাঁ, পাঞ্চেত জলাধারের উন্মোচন করতে এসেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ১৯৫৯ -এ। তিনি শুভ উন্মোচনের জন্য ডেকে নিলেন বুধনি মেঝাইন’কে। জলাধার তৈরী হওয়ার ফলে জলমগ্ন হয়ে পড়ে বেশ অনেকটা এলাকা।তেলকূপিতেও জল ঢোকে। ডুবে যায় অনেক প্রাচীন মন্দির। তেলকূপি এলাকাটি জৈন স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। সেই সময় নদীগর্ভে মিলিয়ে যাই অনেক ছোট বড় প্রাচীন মন্দির।
সেইসময়ই আঁকদুয়ারা গ্রামের তৎকালীন মুখিয়া কালী প্রসাদ সিং খাড়াপাথর গ্রামের কিছু মানুষজনকে সঙ্গী করে নদী থেকে শিবলিঙ্গ উঠিয়ে নিয়ে এসে খাড়াপাথরে নদীর ধারে তুলে এনে পুজো শুরু করেন। তখন থেকে এখন পর্যন্ত সিং বাড়ি থেকে পুজোর সামগ্রী আসা এবং পুজো করার পরই মূল পুজোর শুরু হয়।চৈত্র মাসে এখানে বসে বারুনী মেলা।চৈত্রের বারো দিনে মেলা বসে।চলে বারো দিন ধরে। হরিনাম সংকীর্তন চলে চব্বিশ প্রহর।যাত্রা হয়। ছৌ-নাচ, ঝুমুর, কবিগান, অর্কেষ্ট্রা হয় ।
লোকমুখে শুনি– ‘বারো দিনে বারুনী তেরো দিনে রোহিনী।’
বর্তমানে খাড়াপাথরের বারুনী মেলার কথা এই অঞ্চলের সকল মানুষ জানেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন মেলায় আসেন।
ভৈরবনাথের মন্দিরে প্রতিদিন পুজো হয়।মহামৃত্যুঞ্জয় যজ্ঞ হয় শনিবার ও মঙ্গলবার। ৩২ঘন্টা ধরে চলে।
নদীগর্ভ থেকে তুলে আনেন এলাকার মানুষজন জৈন মূর্তিগুলি।এখানে পুজো করেন সবাই। অদ্ভুত সুন্দর সম্প্রীতির মেলবন্ধন এই খাড়াপাথর। জৈনধর্ম, হিন্দু ধর্ম, সরনা ধর্ম সব ধর্ম মিলেমিশে একাকার। এধরণের সম্প্রীতি কোথাও দেখা যায় না। আদিবাসীরা/হিন্দুরা পুজো করেন।এখানে বা এই অঞ্চলে জৈন ধর্মাবলম্বী নেই অথচ মূর্তিগুলির পুজো করেন সবাই। এই সম্প্রীতির অনুপম নিদর্শন চোখে দেখা যায় না।
দামোদর নদীগর্ভে জৈন মূর্তিগুলি খুব সুন্দর ছোট বড় বিভিন্ন আকারের। প্রায় দশ বারোটি মূর্তি রয়েছে খাড়াপাথরে। সারিবদ্ধভারে চারিদিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে দেখলাম আদিবাসী মেয়েরা ও রমনীরা ধূপকাঠি নিয়ে প্রতিটি মূর্তিকে দেখাচ্ছেন এবং পুজো করছেন। আমার দেখে খুব ভালো লাগলো।আদিবাসীরা প্রকৃতি পুজো করে। এখানে তারা সরনা ধর্মাবলম্বী হয়েও এই জৈন মূর্তিগুলির পুজো করছেন; এধরনের দৃশ্যপট কোথাও আছে বলে আমার মনে পড়ছে না বা জানা নেই। আমি বিভিন্ন সময়ে বার তিনেক খাড়াপাথর গেছি। একবার ছেলেকে নিয়ে গেছিলাম একবার স্ত্রীকে নিয়ে। তেলকূপি ছিল প্রাচীন বন্দর।এই বন্দরের সাথে মহাবীরের নাম জড়িয়ে আছে। মহাবীর ছিলেন জৈন ধর্মের ২৪তম তীর্থঙ্কর। জৈন ধর্মের প্রচারে বেবিয়েছিলেন মহাবীর তাঁর অনুগামী অনেক জৈন প্রচারককে নিয়ে। এসেছিলেন এই তেলকূপী বন্দরে যাকে তৈলকূম্পী বলা হোত।তাঁর পদধূলি পড়েছে এই তেলকূপির মাটিতে।পাঠক-পাঠিকাদের জানিয়ে রাখি- এখান থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ডে একটি পাহাড় রয়েছে যেটি পরেশনাথের নামে পরেশনাথ পাহাড়। পরেশনাথ ছিলেন ২৩তম তীর্থঙ্কর। পাঠকদের জানাই এই পাহাড়টিই ঝাড়খণ্ডের বড় পাহাড়। এই পাহাড়ের পাদদেশটি হোলো ‘মধুবন’। এখানে রয়েছে প্রচুর জৈন মন্দির। জৈন ধর্মাবলম্বীরা এখানে তাঁদের বিশেষ বিশেষ উৎসবের দিনে এখানে মিলিত হন। ভারতবর্ষের কোনায় কোনায় থাকা জৈনধর্মাবলম্বীরা এমন কি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও জৈনধর্মাবলম্বী বা অন্যান্য ভ্রমনার্থীরা আসেন মধুবন
(পরেশনাথ পাহাড়)
এই মূর্তিগুলি যেগুলো দামোদর থেকে উঠিয়ে খাড়াপাথর-এ স্থাপন করা হয় সেগুলো এগারো শতকের প্রাচীন মূর্তি। কালো রঙের মূর্তিগুলি পাথর কেটে কেটে করা হয়েছিল বা তৈরী হয়েছিল। এই মূর্তিগুলি তৈরি করেছিলেন মগধের শিল্পীরা। পাথর কেটে কেটে করা হয়েছিল তাই জায়গাটির নাম কাটাপাথর।জনশ্রুতি আছে নাকি তাল পাতা দিয়ে পাথর কাটা হয়েছিল। যাই হোক কাটাপাথরের বর্তমান নাম এখন সকলের কাছেই খাড়াপাথর।
খাড়াপাথর-এর ধারে কাছের গ্রামগুলি হোলো– আঁকদুয়ারা, শালপাতড়া, শালুকচাপড়া,কুসুমদহা,
শুশুনলিয়া,আসনলিয়া,লখীপুর, বাদলপুর, পাবোঞাঁ, কুলবনা, বেগুনবাড়ি, জয়পুর, ধবাড়ী, ডুমুরিয়া, বাঁদরাবাদ, দলদলি।
পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের জানিয়ে রাখি খাড়াপাথর আসতে হলে আসানসোল ধানবাদ রুটে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে আসতে হবে।আসানসোল থেকে বরাচক, সীতারামপুর, কুলটি, বরাকর, কুমারডুবি, মুগমা, থাপরনগর হয়ে কালুবাথান স্টেশনে নেমে বাইরে এসে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে খাড়াপাথর যাওয়া যাবে। শেয়ার গাড়ি চলে না। দশ কিলোমিটার দূরে খাড়াপাথর গ্রাম ও গ্রামের শেষপ্রান্তে দামোদর ঘেঁষা মন্দির ও আশ্রম।
খাড়াপাথর-এ রয়েছে ভৈরবনাথের প্রাচীন মন্দির। প্রতিষ্ঠা করেন কালী প্রসাদ সিং।ঢুকতেই বিশাল এক শিববাবা বসে আছেন। সুন্দর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ যে কোনো মানুষের মন জয় করে নেবে। সারি সারি তালগাছ নদীধার পর্যন্ত। অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন।দামোদর নদের ধারে সম্প্রীতির এক অনুপম তীর্থভূমি খাড়াপাথর। খাড়াপাথর-এ নদীধার পর্যন্ত পিচরাস্তা রয়েছে। দু’চাকা চারচাকা’য় অনায়াসে যাওয়া যায়। নদী ধারের দৃশ্যপট যে কোনো মানুষকে আকর্ষণ করবে। মন্দিরের বাঁদিকে এক বটবৃক্ষ। চাতাল বাঁধানো সিমেন্টের। বসতে পারেন একটু আরাম করে।বসে বসে ভেবে ভেবে আপনি অনেককিছুই লিখতে পারবেন। অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ। শান্তির জায়গা। কোনো কোলাহল নেই। পাখীর কলকাকলি টিঁ টিঁ, সিঁ সিঁ আওয়াজ আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য জগতে…
তেইশ বছর ধরে আশ্রমে রয়েছেন দিলীপ বাবাজী। না, এ বাবার বড় বড় চুল-দাড়ি নেই। সাধারণ লোকের মত। পরনে গেঞ্জি কখনও বা গেরুয়া রঙের গামছা। স্বামী ও স্ত্রী থাকেন। তাঁরাই আশ্রম দেখাশোনা করেন। আসল নাম সঞ্জয় রায়। ঘাটোয়াল। বাড়ি খাড়াপাথর গ্রাম। গ্রামের ঘরে থাকেন না। আশ্রমটিই তাঁর ধ্যান জ্ঞান সব।
দিলীপ বাবাজীর স্ত্রী পূর্ণিমা দেবী খুব অতিথি পরায়ণা। আশ্রমে গেলেই সেবা করতে বলেন। একবার সেবা করেছি।
দিলীপ বাবাজী অমাবস্যার দিন রাত্রে নদীধারে শ্মশানে থাকেন। কালীপুজো করেন।দিলীপ বাবাজী জানালেন আশ্রমে অনেকেই থাকেন যেমন ঝন্টু মাস্টার[ ঝন্টু বাউরি ],পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একজন ডাক্তার, নিরসা মদনডি’র বলরাম রায়, বলাইচক-এর ড. কেনারাম গরাই। আশ্রমে দুটি কমিটি (এক)মন্দির কমিটি (দুই) মেলা কমিটি।
আদিবাসীদের তীর্থস্থল খাড়াপাথর। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা যেমন পূর্ব পুরুষদের পিণ্ডদান করেন গয়াতে তেমনই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন তাঁদের পূর্ব পুরুষদের পিণ্ডদান করেন এই খাড়াপাথরে। আদিবাসীদের কাছে খাড়াপাথর খুব বড় তীর্থস্থান। দূর-দূরান্ত থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন এখানে আসেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মৃতদের সৎকার করার পর সাধারণত অস্থি নিক্ষেপ করতে ত্রিবেনী যান। পশ্চিমের লোকেরা এলাহাবাদে সঙ্গমে যান এবং পূর্বের মানুষেরা যান মগরা[ত্রিবেনী] অনুরূপ ভাবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা খাড়াপাথর যান অস্থি নিক্ষেপ করতে। তাঁরা খাড়াপাথরের কাছে দামোদর নদে অস্থি নিক্ষেপ করেন।
ঝাড়খণ্ডের পূর্ব মন্ত্রী মথুরা প্রসাদ মাহাতো, ধানবাদের সাংসদ পি এন সিং, ধানবাদের জেলা শাসক অফিস থেকে আধিকারিক এর এক প্রতিনিধিমণ্ডল, অশোক মণ্ডল, অরূপ চ্যাটার্জি, অপর্ণা সেনগুপ্ত সবাই এই খাড়াপাথর আশ্রমে এসেছেন। সবাই এই আশ্রমের উন্নয়ন কল্পে কিছু কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। সাংসদ তহবিল থেকে শৌচাগার তৈরি হয়।একটি আশ্রমের সেড তৈরি হয়।আরও উন্নয়ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দামোদর নদের উপর ব্রীজ তৈরির দাবি উঠেছে। এই দাবি পূর্ণ হলে এলাকার মানুষের অনেক সুবিধে হবে এবং ধানবাদ ও পুরুলিয়া জেলার একটা যোগসূত্র হয়ে যাবে।
বি:দ্র: -সঞ্জয় রায় ওরফে দিলীপ বাবাজী[খাড়াপাথর]
অসীম কুমার দে [শালুকচাপড়া]
স্বপন কুমার সিংহ ও জানকী নাথ দে [আঁকদুয়ারা]
সৌরভ সরকার [তালাজুড়ি, পুরুলিয়া]
বিতান সরকার [মোকো, ধানবাদ]
লেখাটি লেখার সময় অনেক তথ্য দিয়ে পাশে থেকেছেন। সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
পাঠকগণ এর উদ্দেশ্যে:
পত্রিকার স্বার্থে লেখা পছন্দ হলে কমেন্ট ও শেয়ার করতে অনুরোধ করছি। আপনিও লেখা পাঠাতে পারেন নিম্নোক্ত ঠিকানায়:
kabyapot@gmail.com
WhatsApp: 8100481677