গল্পঃ
” দমকা হাওয়া “
প্রদীপ দে
একটা দমকা ঝড় সঙ্গে বিকট আওয়াজে বাজ পড়ার শব্দ, মৃত্যুর আর্তনাদ কে চেপে উদ্দাম উল্লাশে কোনো নারীর উচ্ছ্বসিত হাসি, অন্যদিকে গৃহবধূ সরিতা’ র তিনতলার ছাদে জলের রিজার্ভারের ঢাকনায় গলাটা আঁটকে ছটফট করতে থাকার, বাঁচার শেষ আকুতি টুকুও নিচের ঘরে এসে পৌঁছুলো না।
কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সবকিছুই নিশ্চুপ, নিস্তব্ধতা, আগের মতোই যেমন ছিল ঠিক তেমনই, কোথাও কোন পরিবর্তন নেই, শুধুমাত্র ঢালাই করা রিজার্ভারের ঢাকনা চাপা পড়ে ঝুলে পড়ে থাকা সরিতার মৃতদেহটাই যেন একটু বেমানান, এই ভোর দুপুরবেলা উজ্জ্বল সূর্যালোকে।
বাড়ির গৃহকর্তা ভূপেন বাবু সরিতাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ছাদে এসে এই ঘটনা দেখে প্রথমেই বিহ্বল হয়ে পড়েন, এবং পুলিশকে খবর দেন।
পুলিশ আসে, আসে সঙ্গে তদন্তকারী এক পুলিশ অফিসার। ওরা সমস্ত ইনভেস্টিগেশন করে বুঝে উঠতে পারেন না এই মৃত্যুর কারন কি? আদৌ মৃত্যু না আত্মহত্যা নাকি খুন। টিমের সন্দেহের তালিকায় ভূপেন এক নম্বরে থেকে যায়, কারণ তখন এই বাড়িতে কেউ ছিলেন না, এবং পারিপার্শ্বিক সমস্ত বিবেচনায় প্রাথমিক তদন্তে এটা খুন বলেই মনে হয়। ভূপেন কে পুলিশ লকআপে নিয়ে বডি ময়নাতদন্তে পাঠায়।
দুদিন বাদ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসে। এটা একটা খুন। সরিতা খুনিকে দেখে যে ভয় পেয়েছিল তার স্পষ্ট প্রমান তার দেহে ছিল। কেউ তার চুলের মুঠি ধরে রিজার্ভারে মাথাটা ঢুকিয়ে,উপরের ঢাকনা চেপে ধরে প্রথমে তাকে আঘাত এবং পরে শ্বাসরোধ করে। মৃতের চোখ বেরিয়ে পড়েছিল।
এবার প্রশ্ন হলো খুনি কে? ওই বাড়িতে ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই থাকতেন। সেদিন বাড়িতে কেউ আসেও নি। আশেপাশে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে তেমন কিছু পাওয়াও যায়নি। স্বভাবতই ভূপেনবাবুর দিকেই আঙুল উঠে গেলো। পুলিশ ভূপেন বাবুকে অনেকরকম ভাবে চাপ দিয়েও কিছু বার করতে পারলো না। ডাকা হলো গোয়েন্দা সহ সরকারী তদন্তকারী দলকে।
তিনদিনের মাথায় দুইজনের এক টিম এলো। দলের প্রধান হলেন ভাস্কর চৌধুরী, আর অন্যজন পবন সেন। থানার ওসি সুভাষ সরকার কে নিয়ে ওরা কিছু আলোচনা করে ঠিক হলো ভূপেন কে লকআপ থেকে বার করে সঙ্গে নিয়েই ওই বাড়িতে তদন্তে যাবে।
পরের দিন তারা চারজনে ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বাড়ি পৌঁছেই প্রথমেই তারা ভূপেনকে কিছু প্রশ্ন করার জন্য, সবাই মিলে নিচের ঘরে বসলো। ভূপেন তখন বাঁচার জন্য সব প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলো।
ভাস্কর — আচ্ছা ভূপেন বাবু আপনি চান না, কে এই খুনি তা জানতে?
ভূপেন — আমি কেন চাইবো না। আমিতো সরিতাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু সবাই আমাকেই খুনি বলে ধরে নিয়েছে যে! আমার কথা কেউ বিশ্বাসই করছে না যে?
ভাস্কর চোখ বুঝে রইলো কিছুক্ষণের জন্য। চশমাটা আবার চোখে পড়ে বললেন — আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমিও মনে করি এ খুন আপনি করেন নি। আপনি আপনার ফেলে আসা জীবন নিয়ে,পুরোনো কথা কিছু বলবেন।
ভূপেন মাথা নিচু করে ছিল। মাথা তুলতে দেখা গেল তার দুচোখে জল। তর্জনী আর বৃদ্ধাঙগুলি দিয়ে জলটা সরয়ে দিল, চশমাটি ঠিক করে বসিয়ে দিল নাকের উপর। অসহায় ভাবে একবার করে সকলের মুখের দিকে চাইল, যেন সাহায্য চাইছেন। সকলেই তার চোখে চোখ রেখে ইশারা করলো যেন আশ্বস্ত করছেন সকলেই।
— এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম বিয়ে হয়েছিল দেখেশুনেই। তা প্রায় ১৯৯০ সালে তখন আমার বয়স ৩২ বছর। স্ত্রী অগ্নিকা ‘কে নিয়ে সুখেই কাটছিল। ১৯৯২ সালে আমাদের পুত্র সন্তান জন্মায়। অগ্নিকা আমাকে আর তার নবজাতককে নিয়ে খুব আনন্দে ছিল। হঠাৎই বিপদ ঘটে গেল।একদিন ছেলের দুধ গরম করতে গিয়ে স্টোভ বাষ্ট করে পুড়ে যায় অগ্নিকা। নব্বই শতাংশ পুড়ে গেছিল সে,আমি তখন অফিসেই ছিলাম —–
এই পর্যন্ত বলে কেঁদে ফেলে ভূপেন, আর বলতে পারে না, গলা ভারি হয়ে যায়।
ভাস্কর উঠে ভূপেনের মাথায় হাত রাখে, শান্ত করার চেষ্টা চালায়। ওসি সুভাষ বাবু, যে এতদিন ভূপেন কে খুনিই ধরে নিয়েছিলো, তারও মায়া হয় ঘর থেকে এক বোতল জল এনে দেয় তাকে।
চোখে মুখে জল দিয়ে, ভূপেন শুর করে — বাঁচানো যায়নি অগ্নিকা ‘কে। তার অনেক আশা ছিল ছেলে আর সংসারের প্রতি। তা ছেড়ে ওকে চলে যেতে হয়। আমিও অসহায় হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা সেই সময় ছেলেটার দায়িত্ব নেয়। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই, এক বন্ধুর কাছে। ওরা আমার সেবাযত্ন করে।বছর দেড়েক কাটার পর ওরাই আমার আবার বিয়ের ব্যবস্থা করে,এক প্রকার জোর করেই। শেষে অবশ্য নিজেকে বাঁচাতে আমি আবার বিয়ে করি ১৯৯৪ সালে। তখন আমি ৩৬। সব জেনে শ্বশুর বাড়ি সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ছেলেকে ওদের মতোন করেই মানুষ করতে থাকে,
আমার বাঁধা দেওয়ার উপায় ও ছিল না।
কিছুটা সময় নেয় ভূপেন। টেবিলের উপড় থেকে আনা মা আর ছেলের ছবি দেখায় ওদের।
আবার বলতে শুরু করে — নতুন বাড়িতে এসে সরিতাকে নিয়ে সব ভোলবার চেষ্টা চালালাম। নতুন বউ সরিতাকে নিয়ে এত মত্ত হলাম যে অগ্নিকার সমস্ত স্মৃতি গুলোকে নষ্ট করে, অগ্রাহ্য করতে লাগলাম। অন্য বিপদ শুরু হলো, সরিতা এই বাড়িতে আসার পর থেকেই এক অশরীরী আত্মার গুমরানো যেন শুরু হয়ে গেল। সরিতা প্রায়ই বলতো — দেখো আমার পিছনে পিছনে যেন কেউ ঘোরে। কিরক্ম একটা গা ছমছম করে, ভয় লাগে।আমি এসব কথা এড়িয়ে যেতাম ,ওকে সাহস দেবার জন্য। কিন্তু সত্যি বলছি আমিও অগ্নিকার কান্না শুনতে পেতাম। ছাদে গেলে অথবা সিঁড়িতে যেন কেউ আমাকে তাড়া করতো – আমি তা অনুভব করতাম। একদিন মাঝরাতে আমি ঘুম ভেঙ্গে গেলে, দেখি অগ্নিকা তার সারা শরীরে আগুন নিয়ে আমাকে শাসাচ্ছে — আমি ছাড়া, এ বাড়িতে আর কোনো মহিলাকে, আমি আমার এই সংসার করতে দেব না। এটা আমার সংসার!
পবনবাবু এতক্ষণ পরে মুখ খোলে — শান্ত হোন ভূপেনবাবু। এবার একটু বাড়িটা ঘুরে দেখতে হবে।
সকলে মিলে বাড়ি দেখতে লাগলো। বাড়িটি অনেকদিন অব্যবহৃত অবস্থায় থাকায় অপরিচ্ছন্ন ছিল। নাহলে বেশ সুন্দর। ভয়ের কিছু বোঝা গেলো না। দোতলায় পৌঁছে ভূপেন বাবু ওদের তিনজনকে প্রশ্ন করলেন — কিছু দেখতে পেলেন ?
সবাই অবাক, — না কিছুতো দেখিনি?
— সে কি অগ্নিকা তো আমার পিছনেই ছিলো।
— কি বলছেন ভূপেন বাবু?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিকই বলছি। আপনারা বুঝতে পারেন নি, ও আমার সংগে সংগে উপরে উঠে এসেছে।
তিনজনে একটু হকচকিয়ে যায়।এদিক ওদিক দেখে, তারপর নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। হয়তো ভূপেনের ভয় পাওয়ার কথা ভাবে।
ভাস্কর বাবু আচমকা ভূপেনকে প্রশ্ন করে — আচ্ছা উনি কি এখন আপনাকে কিছু বলতে চাইছেন?
— হ্যাঁ , এখন আমায় বলছে ওর কাছে চলে যেতে!
— বলছে তুমি একা থাকতে পারবে না। পুরুষ মানুষেও আমার আর বিশ্বাস নেই।
তিন অফিসার কিছু না বলে ভূপেনকে নিয়ে ছাদে ওঠে।ছাদের উপরের সিঁড়ির ছোট ছাদে, জলের রিজার্ভার টায় চোখ যায়। ওঠার লোহার সিঁড়ি ছিল।
— চলুন, ভূপেন বাবু একটু উপরে গিয়ে দেখি?
— যাবেন? চলুন — ভূপেনের মুখে ভয়ের অনুভূতি প্রকাশ পায়।
চারজনে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। উপড়ে ছোট্ট ছাদ। প্যারাপিড নেই। বেশ হাওয়া বইছিল। সকলেই সাবধানে পদচারনা করছিল। তিনজনে ব্যস্ত ছিল পরীক্ষণের কাজে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া সঙ্গে বিকট আওয়াজ, যেন কোন নারীর কান্না শোনা গেল, ভাস্কর – পবন আর সুভাষ বাবুরা ভয় পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন — ভূপেন বাবু নেই —
প্যারাপিড বিহীন ছাদ থেকে নিচে তাকিয়ে, ওরা তদন্তকারী তিন অফিসার দেখলো ভূপেন বাবুর তাজা শরীরটা রক্তাক্ত অবস্থায় নিচে, একেবারে একতলার রান্নাঘরের পিছনে গিয়ে পড়েছে।
তাড়াতাড়ি নেমে তিনজনে পিছনে ছুটে যায় তারা। – ভূপেনবাবুর শরীরটাকে ছুঁয়ে দেখে, উল্টে পড়ে থাকা বডিকে চিৎ করে দেয়, ওর মাথা ভেঙ্গে গেছিল, অনেক রক্ত বের হচ্ছিল। আর কিছু করার ছিল না।
ভাস্কর বাবু রুমাল বার করে কপালের ঘাম আর চশমা মুছে নিল ,
— না আমাদের আর কিছু করার নেই, সব শেষ! হি ইজ নো মোর!
——————————————
সমাপ্ত
প্রদীপ কুমার দে
নিমতা
কোলকাতা -৭০০০৪৯