ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত ঘেঁষা পুরুলিয়া জেলার তীর্থস্থান
“চিড়কাধাম”
***********
(ভ্রমণ)
রাজকুমার সরকার
আজ থেকে প্রায় দুই শত বৎসর পূর্বের কথা, পুরুলিয়া জেলার সিন্দরী মোড় (চাস রোড মোড়) থেকে দক্ষিণ দিকে দুই কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে ভরা এলাকা। জঙ্গলে একটি ছোট্ট নদী কুলুকুলু বেগে বলে চলেছে। সেখানে শ্মশানে ‘চড়কমুনি’ নামে এক কালী সাধক থাকতেন। সম্ভবত তারই নামে বর্তমানের এই চিড়কা গ্রাম ও চিড়কাধাম। এই গ্রামেই এক শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা হয় দুই শতাব্দী পূর্বে। শংকর ভগবানের শিবলিঙ্গ রয়েছে এই চিড়কাধামে। যখন ভগবান শংকর শিবলিঙ্গ রূপে দেখা দেন, জঙ্গলে ঘেরা ওই জমি ছিল ‘হুলেকা’ গ্রাম নিবাসী গৌরীনাথ মাহাতোর। সেখানে সে সকলের গরু চরাতে যেত। জঙ্গলের মাঝে একটি গরু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি পাথরের গায়ে দুধ দিত। গরুটি বাড়িতে এসে কিন্তু দুধ দিত না। ভগবান স্বপ্নাদেশ দেন গৌরীনাথ মাহাতোকে—– তুই আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। আমাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবি না। তোর উন্নতি হবে। তখন গৌরীনাথ মাহাতো ব্রাহ্মণ ডেকে পুজো শুরু করলেন। একদিনের ঘটনা, চোর চুরি করতে এসেছে গৌরীনাথের বাড়ীতে। সিঁধ কেটে চুরি করতে যাবে ঠিক তখনই শিব স্বপ্নাদেশ দিলেন গৌরীনাথকে, তোর বাড়িতে চোর এসেছে। বাড়ির সকলে জেগে যায়। চোর পালিয়ে যায়। চোরেরা জানত গৌরীনাথ শিবের পরম ভক্ত তাই চোরেরা দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গলে চলে যায় যেখানে শিবলিঙ্গটি আছে সেখানে। চোরেরা তখন আপন মনে বলতে থাকে আমাদের চুরি করতে দিলি না,তবে তোকেই দন্ড দেব – এই বলে চোরেরা শিবলিঙ্গে কুঠারাঘাত করে। তখন শিবের মাথা থেকে দুধ বের হতে শুরু হয় ও মাথায় গর্ত হয়ে যায়। শিব স্বপ্নাদেশ দেন গৌরীনাথকে, বলেন–আমার খুব চোট লেগেছে, খুব ব্যথা করছে। গৌরীনাথ সোনারদের ঘরে গিয়ে রূপার মুকুট নিয়ে এসে শিবের মাথায় মুকুটটি মুড়ে
দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দুধ পড়া বন্ধ হয়ে যায়। শিব স্বপাদেশ দেন- তুই আমার প্রচার-প্রসার ‘বাবা গৌরীনাথ’ নামেই করবি। তোর নামেই আমি প্রসিদ্ধ হব, সকলের মনস্কামনা পূর্ণ করবো। এইভাবে প্রচার ও প্রসার ঘটতে থাকে।
দূর- দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসতে থাকেন, পুজো করতে থাকেন, সকলেই মানসিক শান্তি পান। প্রথমে চৈত্র মাসে মেলা বসত, এখন শ্রাবণ মাসে মেলা বসে। নিত্য পূজা হয় মন্দিরে। ভক্তরা সবসময়ই আসা যাওয়া করেন। ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন ভোলাবাবা। সকলের আস্থার স্থল। সকলেরই ভক্তি-শ্রদ্ধা চোখে দেখার মত। অনেকেই ধরনা দেন বাবার দরবারে। ফলও পান। ভক্তের ভগবান মনস্কামনা পূর্ণ করেন। ভক্তরা চৈত্র মাসের প্রখর রৌদ্রেও প্রচণ্ড কষ্টের মাঝেও পুজো করেন, বাবার মন পাওয়ার আশায়। দন্ডি দেন অনেকেই। সকলেই জল ঢালেন বাবার মাথায়। কেউ দামোদর নদী থেকে জল আনেন, কেউ গরগা, গোওয়াই, সুবর্ণরেখা, কংসাবতী নদী। আবার কেউ সামনের ছোট নদী থেকেও জল আনেন বাবার মাথায় দেওয়ার জন্য। সকলের মুখেই শোনা যায়-“বাবা গৌরীনাথের জয়।” প্রত্যেক সোমবার এই দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। বাবা প্রত্যেকের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। সেইজন্য চিড়কাধাম দর্শন করলে তীর্থ ভ্রমণের ফল পাওয়া যায়।
গৌরীনাথের বংশধরেরা এখন হুলেকা গ্রামে বসবাস করেন ও পরিবারের সকলে বেশ সুখেই আছেন। চিড়কাধাম সকলেই আসেন তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূরনের আশায়। বলাবাহুল্য দু’চারটি গ্রামের মতই ‘চিড়কা’ একটি গ্রাম যা আজ গৌরীনাথের নামেই ‘গৌরীধাম’ বলে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। উল্লেখ্য গৌরীনাথের নামেই এখানে নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন গৌরীনাথধাম, যেটি পুরুলিয়া থেকে কোটশিলা যাওয়ার পথেই পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া সীমান্ত ঝাড়খন্ড ঘেঁষা এই তীর্থস্থানটি ইতিমধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মন্দিরের সামনে আজ অসংখ্য দোকানপাট রয়েছে। এখানে নবদম্পত্তির বিবাহ অনুষ্ঠান রীতিমত প্রথা মেনেই হয়ে থাকে। বাঙালি পুরোহিত, বাঙালি পরিবেশে, খুব কম খরচায় বিবাহ সম্পন্ন হয়। ভক্তরা মনের আনন্দে পরম তৃপ্তি সহকারে পুজো করেন। ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের বেশীর ভাগ ভক্তরা দামোদর নদী (তেল মোচো ব্রিজ) থেকে জল নিয়ে এসে বিকেল চার-পাঁচটার সময় ‘বোল বোম’ ‘বোল বোম’ বলতে বলতে জল নিয়ে চিড়কার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দামোদর থেকে চল্লিশ- বিয়াল্লিশ কিলোমিটার পথ তাঁরা পুরো রাত ভর জল নিয়ে চলতে থাকেন ও ভোর বেলায় শিবের মাথায় সেই জল ঢেলে পুজো করেন। যাত্রাপথে তাঁরা ভূতনাথ মন্দিরেও পুজো করেন।
জোধাডিহ মোড়, আই.টি.আই মোড়, কুরা মোড়, কাশী ঝরিয়া হয়ে যেতে হয়। বেড়ানী মোড়-এ পূণ্যার্থীদের নানা রকমের পরিষেবা দিয়ে থাকেন মাড়োয়ারী সেবা সংঘ। চা, গরম জল, ঔষধ ইত্যাদির ব্যবস্থা করে থাকেন সংঘের সদস্যেরা। পিন্ড্রাজোড়াতেও একই রকমের ব্যবস্থা থাকে। নাগেন্দ্র মোড়ের পরেই চাস রোড, সিন্দরী মোড়। সিন্দরী গ্রাম পার হলেই তেমাথা, যেখান থেকে বাঁদিকে চিড়কাধাম যাওয়া যায়। এখানে কেউ কেউ বুঢ়া বাঁধ, আবার কেউ তেলী বাঁধ (মন্দিরের পশ্চিম দিকে) থেকে জল তুলে অর্পণ করেন বাবার মাথায়। মন্দিরের উত্তরে কালভৈরব, বীর হনুমান ও মা কালী (তারা মায়ের মন্দির) দর্শনীয়। যাঁরা দূর দূরান্তে সাহস পায় না তীর্থে যেতে তাঁরা গৌরীনাথের মন্দিরে জল ঢেলে পুজো করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়, যা দূরের তীর্থে যাওয়া পূণ্যার্থীদের মনস্কামনা পূর্ণের মতই।
বি:দ্র- পুরুলিয়া রাঁচি বাস রুটের মধ্যে পরে চাস মোড়। পুরুলিয়া থেকে চাস রোডের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার।
তথ্যসূত্র-
নিজস্ব পর্যবেক্ষণ
আমাদের জন্য লিখেছেন ঝাড়খণ্ডে বাংলা ভাষা আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট কবি , সাহিত্যিক ও সুতপা পত্রিকার সম্পাদক শ্রী রাজকুমার সরকার