জাতীয় পতাকা অবমাননায় বাংলাদেশের সঙ্গে কোন আপোষ নয়
বটু কৃষ্ণ হালদার
একটি দেশ যখন স্বাধীন ভাবে গড়ে ওঠে,সেই দেশের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য স্পর্শকাতর বিষয় গুলো বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে তা হোল সংবিধান,ধর্মীয় স্বাধীনতা,বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি ইত্যাদি।তবে এগুলির মধ্যেও সর্বপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের জাতীয় পতাকা। কারণ পতাকাই হল বিশ্বের কাছে একটি দেশের প্রধান পরিচায়কের প্রতীক।আন্তর্জাতিক মানের খেলা,বৈঠক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রেও পতাকা বিশেষ পরিচয় বহন করে।মানুষ দেখে নয়,পতাকা দেখেই চিহ্নিতকরণ করা হয় যে কোন কোন দেশ অংশগ্রহণ করছে বা বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করছে।তাই পতাকা হল দেশের নাগরিকের কাছে আবেগ ও ভালবাসার অন্যতম নাম। যেকোনো দেশের পতাকাকে সম্মান করা বিশ্বের প্রতিটি ব্যক্তির নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।তাই ভারতের পতাকা হোল দেশবাসির কাছে সম্মান ও গৌরবের।জাতীয় পতাকার স্থান সর্বদা ঊর্ধ্বে।মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পতাকা মাড়ানো দেশদ্রোহী অপরাধের সমান।
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনতাপাশ থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তার গুরুত্ব অর্জন করতে শুরু করলে, একটি জাতীয় পতাকার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হয়। ১৯০৪ সালে স্বামী বিবেকানন্দের আইরিশ শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার রূপদান করেন।
স্বাধীন ভারতে জাতীয় পতাকা উন্মুক্ত আকাশে ওড়ানোর জন্য আমাদের দেশের বহু বিপ্লবীরা প্রাণ ত্যাগ করেছেন।হাসতে হাসতে ফাঁসি কাঠে ঝুলেছে। দেশ ত্যাগ করে দ্বীপান্তর বাসি হয়েছেন।
ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ চলে যাওয়ায় মুহূর্তেও জাতীয় পতাকা অশীতিপর হাতে উঁচুতে তুলে রেখেছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। জাত ধর্মনির্বিশেষে নারী-পুরুষ উভয় স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলনের জন্যই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাই পতাকা ভারতবাসীর কাছে জননী জন্মভূমির মতোই আপন। স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বলকারী সন্তানদের গায়ে পতাকা জড়িয়ে বরণ করে নেওয়া হয় ঠিক তেমনি দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া বীর সন্তান ও মহান ব্যক্তির শেষ অন্তোষ্টি ক্রিয়াতেও দেশের পতাকা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে সম্মান জানানো হয়। জাতীয় পতাকার আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্যই আজও লক্ষ লক্ষ বীর সন্তানরা মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে প্রস্তুত সেই পতাকা আজ বাংলাদেশের চক্ষুশুল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ। পাকিস্তানের বুটের তলায় বাংলাদেশের মানুষের জীবন চক্র চলতো। অবাধ্য হলেই কপালে জুটতো অকথ্য অত্যাচার।
পাকিস্তানের গোলামী, চরম অত্যাচার থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে এগিয়ে বন্ধুর মত হাত বাড়িয়ে দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন ভারতবর্ষ।
এখানে বলার আছে যে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের জন্যে কি করেছে তা বলতে পারব না,কিন্তু বাংলাদেশের জন্যে তিনি যা করেছেন তাতে বাংলাদেশের সমস্ত দেশ বাসির উচিত সর্ব জায়গায় তাঁর মূর্তি স্থাপন করে পুজো করা।
যে দেশের সহযোগিতা ছাড়া ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের জয় ছিল প্রায় অসম্ভব, সে দেশটি হচ্ছে প্রতিবেশী ভারত। সে সময়ের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে অবদান রেখেছেন তার কোনো তুলনা হয় না।
পাকিস্তান সামরিক জান্তার গণহত্যার মুখে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার ভারতে থেকেই কার্যক্রম চালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত শুধু আশ্রয় দেয়নি, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রও দিয়েছে।ভারতের দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী নেহরুকন্যা ইন্দিরা গান্ধী বাঙালিদের তার দেশে আশ্রয় ও আহার দিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য এবং শত্রুর হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য বিশ্বের বহু রাষ্ট্র সফর করেছেন।
বাংলাদেশকে সমর্থনের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেসময়ের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সেদেশ সফরকালে ইন্দিরা গান্ধীকে অসম্মান করে এবং হতচ্ছাড়া মেয়েলোক হিসেবে উল্লেখ করে বলে, ‘তাকে আমি দেখে নেব।’ তাছাড়া ক্রুদ্ধ নিক্সন মিসেস গান্ধীকে ‘বিচ’ (কুত্তি) ও বাস্টার্ড (বেজন্মা) বলেও গালি দেয়।
ইন্দিরা জানতেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখতে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি যা যা দরকার, তা-ই করবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র-চীনকে মোকাবিলা করার জন্যই ১৯৭১-এর আগস্টে অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ২৫ বছরের মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর করে ইন্দিরার ভারত। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
ভারত ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সামিল হয়।৪ ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১,৬৬১ জন ভারতীয় সেনাসদস্য শহীদ হন।যারা ইন্দিরা গান্ধীকে “আয়রন লেডি” বলে ডাকেন,তাদের জানা উচিত বলে মনে করি তিনি বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন,আজ সেই বাংলাদেশ ভারত বয়কট এর ডাক দিচ্ছে,তাহলে ভারতের কি করা উচিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান অনস্বীকার্য, সেখানে এখন কুলাঙ্গারদের রাজত্ব চলছে। বাংলাদেশের কোটাবিরোধী আন্দোলন এখন হিন্দু শূন্য করার চক্রান্ত ও ভারত বয়কটে এসে দাঁড়িয়েছে। অগ্নিগর্ভ জ্বলন্ত বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী কার্যকলাপ এতটাই চূড়ান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে যা সম্প্রীতির সীমানা একেবারে অতিক্রম হয়ে গেছে।সমাজমাধ্যমে বি ইউ ই টি ইউনিভার্সিটির (Bangladesh University of Engineering and Technology) প্রবেশপথে বিছিয়ে রাখা ভারতীয় জাতীয় পতাকা মাড়িয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবার ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ইদানিং ভারতের জাতীয় পতাকা মাড়ানো নয় প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্য সমগ্র বিশ্ববাসী দেখছে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে কোনও ক্ষমা নেই।চরমতম অন্যায় করেছে তারা। জাতীয় পতাকা কিন্তু প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক নাগরিকের সবচেয়ে বড় আবেগ। ভারতের অবশ্যই বাংলাদেশকে নিজের অবস্থানটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে আগুন নিয়ে বহু খেলছেন। হাত পুড়বে না, এতটা দক্ষ খেলোয়াড়ও নন আপনারা।
যারা বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের মাথায় পেচ্ছাব করে, যারা ভারতের পতাকা পা দিয়ে মাড়িয়ে দিতে পারে, তারা নিজের মা বাপের মুখেও পেচ্ছাব করতে পারে।
বিশ্বের কোনও পতাকাকে কোনও সুস্থ মস্তিস্কসম্পন্ন মানুষ অবমাননা করে না। বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের উচিত প্রতিটি পতাকাকে সম্মান করা, যদি কখনো কোন সময় কোন দেশের জাতীয় সঙ্গীত শুনতে পাওয়া যায় তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানানো উচিত।পাকিস্তান, এমনকি চীন ভারতবর্ষের চরমতম শত্রু দেশ, তাই বলে আজ পর্যন্ত কোথাও দেখেছেন এই ভারতের মাটিতে তাদের পতাকা পা দিয়ে মাড়ানো হচ্ছে বা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।ভারতীয়রা এই কু_ শিক্ষা,সভ্যতা,সংস্কৃতিতে যেমন অভ্যস্ত নয়, তেমনি ভারতীয় জাতীয় পতাকার অপমান মুখ বুজে সহ্য করে নেবে না।বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরা ভারতের পতাকাকে পায়ে মাড়িয়ে যে সুখ পাচ্ছে,সে সুখ বিকৃত সুখ। যে মস্তিস্কে ঘৃণা থিকথিক করে, সে মস্তিস্ক অসুস্থ মস্তিস্ক। দুঃখ এই, বাংলাদেশ নামের দেশটি অসুস্থ অশিক্ষিত অপ্রকৃতিস্থ লোকের দেশ হয়ে উঠছে। বর্তমানে নয় আগামী ভবিষ্যতের প্রজন্ম কেউ তারা অপরের সভ্যতার সংস্কৃতিকে অবমাননার শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।তাই বিশ্বের সমস্ত দেশের উচিত তাদের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে এক ঘরে করে দেওয়া।সমস্ত সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া।
আমার দেশের পতাকা যতজন পায়ে মাড়াবে,আমরা ততো তিরঙ্গাকে মাথার উপর তুলে ধরবো। দেখতে চাই কটা পায়ের ক্ষমতা আছে আমার দেশকে অবমাননা করবার। তবে ভারতের জাতীয় পতাকা অবমাননার দায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোন আপোষ করা চলবে না। বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিতে হবে বাপের ও বাপ থাকে কারণ
১৬ কোটি বাঙালি যদি ইন্ডিয়ার পতাকা পুড়াই কিংবা পায়ের নিচে রাখি তাহলে ৩২ কোটি পায়ের নিচে যাবে ভারতের পতাকা, কিন্তু ভারত যদি বাংলাদেশের পতাকা পায়ের নিচে দেয় তাহলে বুঝতে হবে ১৫০ কোটি মানুষের পায়ের নিচে যাবে এতে পায়ের সংখ্যা হবে ৩০০ কোটি ।
আমার দেশের পতাকা যেমন তাদের পায়ের নিচে দেখে আমার জ্বলছে ঠিক তেমন তাদের দেশের পতাকাও অন্য জনের পায়ের নিচে দেখে তাদের জ্বলবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়।
এখানে আবেগের খেলা নয় যা করবেন বিবেকের দিয়ে করবেন এতে উভয়ের লাভ। সবথেকে সস্তায় চাঁদে যাওয়া প্রথম দেশ যারা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পা রাখে।বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম পদাতিক সৈনিক আমাদের দেশেই। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জিডিপি development দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। ক্রিকেট খেলায় বর্তমানে সব ফর্মাটে বিশ্বসেরা।জনসংখ্যায় বিশ্বে প্রথম।তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় বর্তমানে স্বনির্ভর একটি দেশ।বিশ্বের অন্যতম পরমাণু শক্তিধর একটি দেশ।বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে সমস্ত জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে একত্রে বসবাস করে।বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওপেন কনজিউমার মার্কেটের দেশ।বিশ্বের সব থেকে লম্বা রেলপথ ও সড়ক পথ এই দেশেই অবস্থিত। সেই দেশকে বয়কট ও জাতীয় পতাকা অবমাননার ফলাফল মারাত্মকভাবে ভুগতে হবে বাংলাদেশকে। সেই দিনটা দেখার জন্য সমগ্র বিশ্বের মানুষ হয়তো অপেক্ষা করে আছে। ভারতবর্ষের উচিত বাংলাদেশকে সমুচিত কঠোর শিক্ষা দেওয়া, যাতে সমগ্র বিশ্বের মানুষ আঁতকে ওঠে। দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষের পতাকাকে অপমান করার সাহস যাতে আর কারো না হয়।বাংলাদেশ যাতে ভুলে না যায় যে এটা মহাত্মা গাঁধীর সময়ের ভারত নয়,এখন ইট ছুঁড়লে পাটকেলটি খেতে হবে। সম্প্রীতি ও শান্তি রক্ষা দায় শুধুমাত্র ভারতবর্ষের নয়।
বটু কৃষ্ণ হালদার,কলকাতা