চে গুয়েভারা আজও বিপ্লবীদের চোখে সমানভাবে জনপ্রিয়
বটু কৃষ্ণ হালদার
চে গুয়েভারা তুমি দীর্ঘজীবি হও/তোমার মৃত্যু আমায় অপরাধী করে দেয়”। এভাবেই চে গুয়েভারা যুগ যুগ ধরে বিপ্লবী মন্ত্রের মূল আদর্শ হয়ে উঠেছে যুব সমাজের চোখে।তাঁর বৈপ্লবিক আদর্শকে বুকে আঁকড়ে ধরে বিপ্লবীরা অক্সিজেন খুঁজে পায়।চে গুয়েভারা একজন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না ।তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত। মৃত্যুর পর তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়।১৯২৮ সালের এই দিনে আর্জেন্টিনার সান্তা ফে শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পুরো নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সের্না।
চে গুয়েভারা ছিলেন কিউবা বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় রয়েছে তাঁর নাম।
পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। ছোটবেলা থেকেই তার চরিত্রে অস্থির চপলতা দেখে তার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে আইরিশ বিদ্রোহের রক্ত তার এই ছেলের ধমনীতে বইছে। খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তার ভেতর তৈরি হতে থাকে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন। তার বাবা ছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রবাদীদের একজন গোড়া সমর্থক, সেই সংঘর্ষের সৈনিকদের তিনি প্রায়ই বাড়িতে থাকতে দিতেন।
হাপানিতে সারা জীবন ভোগা সত্ত্বেও তিনি দারুন মল্যবিদ ছিলেন।তাঁর খেলধুলার পছন্দ তালিকায় ছিল সাঁতার, ফুটবল,গলফ, শুটিং। চে গুয়েভারা সাইক্লিংয়ের একজন অক্লান্ত খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি রাগবি ইউনিয়নের একজন অতি আগ্রহী সদস্য ছিলেন এবং বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয় রাগবি দলের হয়ে খেলেছেনও। রাগবি খেলার ক্ষিপ্রতার জন্য তাকে “ফিউজার” নামে ডাকা হত। তার বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা তাকে ডাকত চানচো বলে, কারণ তিনি অনিয়মিত স্নান করতেন এবং সপ্তাহে একবার মাত্র পোশাক পাল্টাতেন।
১২ বছর বয়সে দাবা খেলা শেখেন তার বাবার কাছে এবং স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন।বয়সন্ধি থেকে শুরু করে সারাটা জীবন তিনি কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন বিশেষ করে পাবলো নেরুদা, জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান, তিনি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। তিঁনি স্মৃতি থেকে আবৃতি করতে পারতেন রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর “ইফ” কবিতা এবং জোসে হার্নান্দেজ-এর “Martin Fierro” কবিতা। গুয়েভারা পরিবারে ছিল ৩০০০০এরও বেশি বই যা গুয়েভারাকে করে তোলে একজন জ্ঞানপিপাসু ও অক্লান্ত পাঠক।যার মধ্যে কার্ল মার্ক্স, উইলিয়াম ফক্নার, এমিলিও সলগারির বই। পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরু, আলবেয়ার কামু, লেনিন, রবার্ট ফ্রস্ট-এর বইও তিনি পড়তেন।
যুবক বয়সে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছায় ভর্তি হন মেডিসিন বিষয়ে। ভালোই চলছিল তার ডাক্তারি পড়াশোনা, ব্যক্তিগত জীবন আর প্রেম।বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ মোটরসাইকেলে বের হলেন নিজ ভূখণ্ড ভ্রমণে। এ ভ্রমণ আর্নেস্তোকে বঞ্চিত মানুষদের ‘চে’ বা ‘বন্ধু’তে পরিণত করে।
দীর্ঘ মোটরসাইকেল ভ্রমণে আর্নেস্তো একদিকে যেমন দেখেন নিম্নশ্রেণীর মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, বঞ্চনা, নিপীড়ন; আর অন্যদিকে দেখেন শাসকের দুর্বৃত্তায়ন, শোষণ, অত্যাচার। এ বোধ থেকেই শুরু করেন মানব মুক্তির লড়াই। ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি, আনন্দ, সচ্ছলতা, নাম-যশের মোহকে অবজ্ঞায় দূরে ঠেলে রাস্তায় নামেন সামগ্রিক ও যৌথ সমাজে শান্তিতে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। এ শুধু রক্তের নয়, ভালোবাসারও লড়াই; না হলে বিশ্বের কোটি মানুষকে ভালোবেসে নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে নামার সাহস সবার হয় না।
এক সময় তিনি রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে’র বৈপ্লবিক আদর্শ ও চেতনা আরো বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। খুব অল্পদিনেই চে ফিদেলের বিপ্লবী সংঘের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তার পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উত্খাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও তোপচিদল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন, এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটন। এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান।ফলত এই বাহিনী পিগস উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালিস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।চে ছিলেন এক বিশিষ্ট লেখক ও ডায়েরি-লেখক। গেরিলা যুদ্ধের উপর তিনি একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। তরুণ বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তার অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করেন। প্রথমে কঙ্গো-কিনসহাসায় তার বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশ নেন। এখানেই সিআইএ-মদতপুষ্ট বলিভীয় সেনাদের হাতে বন্দী ও নিহত হন চে।
চে গুয়েভারার নাম শুনলেই চোখে ভাসে একজন রোমান্টিক-বিপ্লবীর অবয়ব। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর নিরস্ত্র অবস্থায় ৯টি গুলিতে হত্যা করা হয়েছিল বন্দি চে গুয়েভারাকে।কিন্তু স্তব্ধ করা যায়নি চে`র আদর্শকে। দশকের পর দশকজুড়ে চে হয়ে রয়েছেন তারুণ্যের প্রতীক।যে তরুণ স্বপ্ন দেখে, যে তরুণ সবার জন্য সমান একটি পৃথিবীকে আলিঙ্গন করতে চায়, তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন চে।মানবতার জয়গান গাওয়া, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা, শোষিতের পক্ষে লড়াই করে যাওয়া বিপ্লবী হলেন চে’র গুয়েভারা।
****************
বটু কৃষ্ণ হালদার,
কবর ডাঙ্গা, কল১০৪