হাজী সাহেব
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
শুক্রবার। জুম্মার নামাজ শেষ। একে একে মসজিদ থেকে সব নামাজীরা বেরিয়ে আসছেন। বিদ্যাধরীর তীর ঘেঁষে শিরীষ বাবলার ছায়া সুনিবিড় পথ ধরে, গ্রামবাসীরা আসতে আসতে যে যার ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। আদিবাসী, তপশীলি জাতি, গরীব মুসলিম কৃষক, ও মৎস্যজীবি, অধ্যুষিত এই চৈতল গ্রামে একটিই মাত্র মসজিদ। এ গ্রামে মুসলিমদের সবাই হলেন সুন্নি। তারাই এখানে নামাজ কালাম করে। কোন শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে নেই।
মসজিদ থেকে সবাই নেমে আসার পর ধীরে ধীরে নামছেন লাঠি ঠুকতে ঠুকতে অশীতিপর বৃদ্ধ হাজী সাহেব ছামাদ মোল্যা। প্রায় কুড়ি বছর আগে উনি মধ্যচৈতল প্রাইমারী স্কুল থেকে রিটায়ার করেছেন। এখন পেনশান ভোগী। বেরিয়ে আসতে আসতে উনি দূর থেকে দেখলেন, রুক্ষ্মসূক্ষ্ম চুল, ছেঁড়া-ময়লা লুঙ্গি-জামা পরা, বছর ৪০/৪৫-এর একজন দাঁড়িওয়ালা মোমিন, মসজিদের পাঁচিলের মূল দরজার কাছে, দু’হাত জোড় করে পশ্চিমদিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এসে তিনি দেখলেন, লোকটির দু’চোখে জল।
–কি হয়েছে তোমার বাবা? তুমি কাঁদছো কেন? কোথায় তোমার বাড়ী?
–হুঁজুর আঙ্গা বাড়ী এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে। আপনাদের গা এডা মিনাখাঁ থানা। আঙ্গা বসিরহাট থানা। ফতুল্যপুর গ্রাম।
–তোমার নাম কি? এখানেই বা তুমি এলে কি করে?
–আমার নাম হামিদ, হামিদ গাজী হুঁজুর। আমার খালামা এতিম। কেউ তার নেই। আমি জোনমুজুর খাটি। আল্লাতালা কোন সাঁঝে দানাপানি জোটায়, কোন সাঁঝে জোটায় না। তার মধ্যেও হুঁজুর, দুটো চালডাল আর শাকসব্জি খালামাকে দিতে এসেছি। ভীষণ গরীব কিনা।
–খুব ভালো, খুব ভালো। আল্লার রহমে তোমার মঙ্গল হবে।
একটু থেমে হাজী সাহেব প্রশ্ন করলেন–তা বাবা, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে ওভাবে কি কোরছো?
–হুঁজুর আজ শুক্রবার, জুম্মা বার। আমার যত অভাবই থাক, কাজ কামাই দিয়ে শুক্রবারের জুম্মায় যোগ দিতাম। কিন্তু . . .
–কিন্তু কি বাবা হামিদ?
–আজ এক বছর হোল, আমি আর জুম্মা পড়তে পারি না।
–কেন? কেন, বাবা?
–সে বড় কষ্টের কথা হুঁজুর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সজল চোখে হামিদ বলে।
–আমি একটা হিন্দু বাড়ীতে কাজ করতাম। আজও করি। ঐ বাড়ীর দাদাবাবু, বৌদি, খোকনমণি সবাই আমায় খুব ভালোবাসতো। আজও বাসে। তবে, . . .
–তবে কি হামিদ?
–আল্লা আসলে হঠাৎ দাদাবাবুকে তুলে নিলেন।
–তার মানে?
–তার মানে, এই বছর খানিক আগের কোথা। দুপুর বেলা, পানি খাতি খাতি হোঠাৎ বুকে ব্যেথা। একটুস খানিক বাদেই দাদা বাবুর গা নিথর। ধড়ে আর প্রাণ নি। সব শেষ। একটু থেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস দৃষ্টিতে হামিদ বলে,–
–বড় ভালো মানুষ ছেলো দাদা বাবু, বৌদিও খুব ভালো মানুষ হুঁজুর। আমারে ওনারা মার প্যাটের ভাই-ইর মতন যত্ন আত্তি করতেন। দাদাবাবু আজ নি। কিন্তু বৌদি আমারে আজও ভাই বলেই জানে।
–সেটাই তো স্বাভাবিক হামিদ। ভালো মানুষদের কোন জাত ধর্মের বিচার নেই, বিচার থাকে না হামিদ।
তাই তো হুঁজুর, টাকীর স্বর্ণময়ীর শ্মোশানে দাদা বাবুর চিতের কাঠ আমি ভ্যানে করে বইয়ে নিয়ে যাই। চিতা যখন নিভে গেল, তখন, দাদা বাবুর এট্টা মাত্র ছেলে, সে এবং দাদাবাবুর ভাইপো ও পাঁচ ভাই চিতের আগুন নেভাতি কলসি ভরে পানি এনে চিতে নেভালো; আমিও পানি দেই দাদাবাবুর চিতেতে।
এই কোথা জানাজানি হয়ে গেলো। দাদাবাবুর বাড়ীর সবাই খুব ভালো ভাবে এটা নেলো। কিন্তু, আগুন লাগলো আমার কোপালে?
–কেন হামিদ, কেন? তুমি তো খুব ভালো কাজই করেছো, মানুষের মতো কাজই করেছো।
–আপনি বলতেছেন হুঁজুর!
–হ্যাঁ বলছিই তো। তুমি তো আল্লার রহম পাবার মতই কাজ করেছো।
হামিদ হাজী সাহেবের কাছে মাথা নীচু করে ভেউ করে কেঁদে বললো–আর আমাদের কাঁটারাটি গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব বলে কিনা আমি কাফের, আমি নাপাক, আমি মোনাফেক।
–তাই বুঝি?
–হ্যাঁ হুঁজুর। শুধু তাই না। ইমাম সাহেবের ফতোয়ায় আমার মসজিদে ওঠা বন্ধ। আমায় তিন কসম কবুল করিয়েছেন ইমাম সাহেব–আমি বাধ্য হয়ে কসম করেছি যে আসমানের নীচে কখনও কোথাও কোন মসজিদে উঠবো না। জানেন হুঁজুর, আজান শুনলি বুকির মধ্যি জাহানডা হাঁক পাঁক করি ওঠে। অন্য দিন নিজের বাড়ীতে বা ফাঁকা মাঠে নামাজ পড়ি। কিন্তু শুক্রবারে জুম্মার জোমায়েতে যাতি পরাণটা আমার হা পিত্তেস করে। কিন্তু উপায় তো নি হুঁজুর। তাই শুক্রবারে জুম্মার সময় মসজিদির বাইরে দাঁড়িয়ে আল্লাপাককে ডাকি। আজও তাই করতিছি।
অবাক হয়ে হাজী সাহেব কথাগুলো শুনছিলেন। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে হামিদের পিঠ চাপড়িয়ে উনি বললেন–কে বলেছে তুমি কাফের, তুমি নাপাক, তুমি মোনাফেক? তুমি হলে একজন খাঁটি মোমিন, একজন খাঁটি মানুষ। একটু থেমে উনি বললেন–জানো হামিদ, তোমার একটা দাদা যাকে তুমি শ্মশানে দাহ করে চিতায় জল দিয়েছিলে, তেমনি আমারও একটি দিদি ছিল। আদিবাসী মেয়ে, সোনাদি, সেনামণি মুন্ডা। আমি তখন সবে হজ থেকে ফিরেছি। শুনলাম সোনাদি নেই। ছুটলাম দিদিদের গ্রাম নিমিচির শশ্মানে। দিদির মরা মুখটা আমার দেখা হয়নি। চিতা তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে। চিতা নেভার পর আমিও দিদির সেই ছাইয়ে জল ঢেলে দিলাম। দিদির অস্থিটা খুঁজে তার ভাই মহাদেবের হাতে দিয়েছিলাম বিদ্যাধরীতে ডুব দিয়ে পুঁতে দিতে। দিদির কোন ছেলে মেয়ে ছিল না কি-না।
রসগোল্লার মতো নাটা নাটা চোখে হামিদ জিজ্ঞেস কোরলো–হুঁজুর, তা আপনাকে কেউ কিছু বলিনি? মানে এই মসজিদে ওঠার ব্যাপারে?
–হামিদ। আল্লা বলো, ভগবান বলো, God ই বলো, তিনি আছেন। তাঁর কাছে শ্মশান, কবর, কবরে মাটি দেওয়া, চিতায় জল ঢালা সবই সমান রহমের কাজ, পূণ্যের কাজ। তবে ট্যাঁকের জোরে আর টাকার জোরে কিছু লোক ফতোয়া বার করে গরীবদের উপর চাপায়। তাইতো আজ হিন্দু ধর্ম বলো, মুসলিম ধর্ম বলো; সব ধর্মের এই দূরবস্থা।
একটু থেমে উনি বললেন–জানো হামিদ, এখন হিন্দু ও মুসলিমের সংখ্যা দেশে খুব কম; এখন হিঁদু ও মোছোনমানের ছড়াছড়ি। এরাই যত বিপত্তি ঘটায়। এই মোছোনমানরাই তোমায় মসজিদে ওঠা বন্ধ করেছে: কারণ তোমার মাথায় যে আমার মতো তেল নেই; পেটে তত কালির জল নেই যেটা আমার আছে।
ওরা যে এগুলোকে ভয় পায়। যা হোক, কোন গোনা হবে না, আমি ওই গুঁড়িটার উপরে বসছি। তুমি মসজিদের ভিতরে যাও–জুম্মা পড়ে এসো: ঐ কল থেকে উজু করে নাও।
হামিদ উজু করে ভিতরে নামাজ পড়তে গেলো। ছামাদ সাহেব গুঁড়িটার উপরে বসে রইলেন। দূর থেকে মৃদুসুরে তাঁর কানে ভেসে আসছে একটি পিকনিক পার্টির মাইক থেকে নজরুলের গান–
মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম
হিন্দু মুসলমান।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত