মৃত্যুর পর
মৃন্ময় ভট্টাচার্য
গত কয়েকদিন ধরে শবীরটা ঠিক সঙ্গ দিচ্ছিল না, তবুও বউমার হাতে রান্না রেয়াজি পাঁঠার মাংস আর গরম গরম ফুলকো লুচির লোভ সামলাতে আর পারলাম না, ফলে রাত্রে প্রচণ্ড গ্যাস হয়ে বুক ধরফর করতে করতে পটল তুলতে বাধ্য হলাম।
প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি, হঠাৎ শরীরটা হাল্কা হয়ে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে বেশ সুখ অনুভব করছিলাম। পাশেই স্ত্রীর মৃদুস্বরে নাসিকা গর্জন কানে আসছিল। যখন সম্বিত ফিরলো দেখতে পেলাম আমার শরীরটা স্ত্রীর পাশে স্থির হয়ে শুয়ে আছে, আর আমি ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছি। শরীরের হাঁ মুখ দিয়ে বেশ কয়েকবার শরীরের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। তখন নিশ্চিত হলাম আমার মৃত্যু হয়েছে, কেন যে লোভ করে ওই মাংস-লুচি খেতে গেলাম! এটাই “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু” -র এক্কেবারে যথার্থ ঘটনা।
চিরকালই আমার ভোরবেলা ঘুমথেকে ওঠার অভ্যাস ছিল। আজ সকাল ছ’টা নাগাদ বউ উঠলো ঘুম থেকে। আমার দেহটাকে দেখে ভাবলো আমি ঘুমাচ্ছি। সে রোজকার মতো সকালে স্নান সেরে, ঠাকুরের পুজো করে, এক কাপ চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমি আমার মৃতদেহের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে সব দেখছি। “অনেক বেলা হয়ে গেছে, এবার উঠে পড়ো”, বলে চায়ের কাপটা বিছানার পাশে রাখা টেবিলে রাখলো।
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে যেই দেহটাকে ঠেলা দিয়েছে, বরফঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। দুই ছেলের নাম করে আর্তনাদ করে উঠলো। দোতলা থেকে দুই ছেলে ও বউমারা হুড়মুড় করে নেমে এলো। দেখছি বড় ছেলে আমার ফেলে আসা দেহটার নাকে হাত দিয়ে নিশ্বাস পড়ছে কিনা ভালো করে পরীক্ষা করছে। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। দুই বউমা মরাকান্না আরম্ভ করেছে, ছোটো ছেলে ডাক্তার ডাকতে দৌড় দিলো।
আমাদের পাশের বাড়ির সেই ত্যাঁদোড় লোকটা একেবারে ঘরের ভেতরে চলে এসেছে। আমার সাথে তার বিরোধ অনেক দিনের, ঐ আম গাছটা নিয়ে, উনি চান পাঁচিলের ধারে ফলন্ত আম গাছটা আমি কেটে ফেলি, এতে ওর উঠোন নাকি পাতা পড়ে নোংরা হচ্ছে। আমি গাছ কাটার প্রবল বিরোধী। এ নিয়ে অনেক ঝগড়া ঝাঁটি হয়েছে, এখনতো মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। আমি অবাক হয়ে সেই লোকের মুখে আমার ভূয়সী প্রশংসা শুনে অজ্ঞান হবার যোগাড়, কিন্তু সবে মৃত্যু হয়েছে বলে, মৃত্যুর পর অজ্ঞান হওয়া যায় কি না, তা আমার জানা নেই।
দুটো চোখ আমি আগেই এক সংস্থাকে দান করেছিলাম, দেখলাম বড়ছেলে সেই সংস্থাকে ফোন করে বাড়ির লোকেশন শেয়ার করছে।
পাশের পাড়ার ডাঃ ঘোষ এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে ভিজিট চাইলেন, আর বড় বৌমা আমার গতকাল বিকালে পরা শার্টের বুকপকেটে হাত ঢুকিয়ে কড়কড়ে দুটো পাঁচশো ও পাঁচটা একশো টাকা তুলে নিয়ে তার থেকেই ডাক্তারকে দুটো একশো টাকা দিয়ে, বাকি টাকাটা নিজের কাছেই রেখে একটু ফিক করে হেসে নিলো, ডাঃ ঘোষও দুশো টাকা ভিজিট নিয়ে, সকাল সকাল বাজার করার টাকাটা পকেটস্থ করে বেজায় খুশি, হাস্যমুখে বিদায় নিলেন। এই সব দৃশ্য মনে বড্ড আঘাত করে, আগেও মাঝে মাঝে পকেট থেকে দু-একশো টাকা খোওয়া যেত, ভাবতাম বয়সের কারণে হয়তো ভুল হচ্ছে। এখন দেখছি বড় বৌমা এক আস্ত পকেটমার! যেহেতু মরে গেছি, আর একশো দু'শো নয়, সবটাই ঝেড়ে দিল! ছিঃ ছিঃ।
নিকটস্থ আত্মীয় স্বজনরা একে একে আসতে শুরু করেছে। কারো কারো কান্নার নাটক দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। বাড়ি এখন জমজমাট, কোথা থেকে জলখাবার হিসাবে কচুরি, সিঙারা, রসগোল্লার হাঁড়ি এসে গেল। সবাই খোশমেজাজে গল্পে মেতেছে। দুই ভাগ্নে ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করছে। বলছে রোহিত শর্মাকে আর ক্যাপ্টেন রাখা উচিত নয়, এভাবে সেমিফাইনালে হার ওরা মেনে নিতে পারছে না।
আমারও ওই কচুরি সিঙারা খেতে খুব ইচ্ছা করছে। হাত বাড়িয়ে বারবার চাইছি, ওরা কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না, কথাও শুনতে পাচ্ছে না, বড় অসহায় অবস্থা আমার, এই জমজমাট বাড়ির মধ্যে আমি যে কি একাকিত্ব বোধ করছি, তা বলে বোঝাতে পারবো না। জীবিত অবস্থায় শুনেছিলাম শ্রাদ্ধ-শান্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাকে এই বাড়ির আশেপাশেই থাকতে হবে। ভাবছি ঐ আমগাছটাতেই কষ্ট করে এই ক'দিন কাটিয়ে দেবো।
দু-তিন জন লোক এসে চোখের কর্নিয়া দুটো তুলে, চোখে ব্যাণ্ডেজ করে দিয়ে চলে গেল। ওদিকে "স্বর্গরথ" নামের কাঁচের বাক্স লাগানো মরার গাড়িটা বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই সব আদেখলাপনা আমার অসহ্য লাগে, নিয়ে যাবে শ্মশানে, আর লিখে রেখেছে স্বর্গরথ! একেবারে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ঠিক যেমন ভোটের আগে রাজনৈতিক কারবারিরা করে থাকেন।
স্বর্গে যাবো না নরকে যাবো, তা নিয়ে আমিও ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি, শ্রাদ্ধটা না মিটলে তা জানতেও পারবো না।
ওদিকে এবার আমার মৃতদেহকে সাজুগুজু করানো চলছে, চন্দন পড়ানো হয়েছে, সঙ্গে গলায় দুটো রজনীগন্ধার মালা, গায়ে নামাবলী ও মাথার পাশে একটা ছোট্টো ভগবত গীতা রাখা হয়েছে। দুই চোখে ব্যান্ডেজে ওপর তুলসী পাতা আর নাকে তুলো না থাকলে বেশ বর বর লাগতো, উপায় নেই চম্বলের বর্বর ডাকাতদের মতো চোখ বাধা অবস্থাতেই দেহটাকে যেতে হবে পুড়তে।
আবার সেই নাটুকে মরাকান্নার গগনভেদী চিৎকার, দেহটাকে বাড়ি থেকে বার করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। আমার বউয়ের দু'চোখ দিয়ে নীরবে জল ঝরছে। এতো বছরের সম্পর্ক, কষ্ট তো হবেই। আমার ধারণা এতো জনের মধ্যে একমাত্র ওই সত্যিকারের কষ্ট পাচ্ছে।
দুই ছেলে আর ছেলের বন্ধুরা "বল হরি, হরি বোল " স্লোগান দিচ্ছে। মরলাম আমি আর হরি-র নাম নেওয়া কেন বাবা! আমার নাম নিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত!
স্বর্গরথ চলতে শুরু করলো, আমিও ড্রাইভারের ঘরের মাথায় চেপে বসলাম, আমার দেহটা কাঁচের মধ্যে সাজানো রয়েছে। দেখি শ্মশানে আবার নতুন কি নাটক অভিনীত হয়।
××××××××××××××××××××××××××
ক্রমশ