- ✍️বিভূতি ভূষন বিশ্বাস✍️
মায়ের হাত ধরে কাঁচা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি । একে বারে অজপাড়াগাঁ ফাঁকা রাস্তা,লোকজন নেই বললেই চলে । দুটি ছোট্ট ছেলে কাঁধে হাত দিয়ে হেঁটে আসছে । আমার থেকে ছোটো হবে । আমি তখন ক্লাস ফাইবে পড়তাম । 1980 সালের ঘটনা যোগোযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো ছিলো না । ছেলে দুটি কাছে আসতেই মা জিজ্ঞাসা করল ——- রাম লক্ষণ তোমরা কোথায় যাচ্ছ ?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো আমরা রাম লক্ষণ নই । আমার নাম বিধান ওর নাম বিকাশ আমরা যমজ দুই ভাই । আমরা এখন কলকাতায় যাচ্ছি ।
মা বলল —- তোমাদের বাড়ি কোথায় ?
ওরা বলল ——- কলকাতায় ।
মা বলল —- এখানে কাদের বাড়িতে এসেছ ?
ওরা বলল —- মামা বাড়ি । ওখানে ভালো লাগছে না তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি ।
মা বলল —— কোন গ্রামে তোমার মামার বাড়ি । মামার নাম কি ?
ওরা বলল ——– তা তো মনে নেই ।
মার দিকে তাকিয়ে দেখি মার চোখ মোটা মোটা হয়ে গেছে । কারন আমাদের গ্রাম থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে কলকাতা । ছেলে দুটিকে মা ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো । ওরা আমাদের গাছে পাকা আম দেখে কি আনন্দ । আমি গাছে উঠে আম পেড়ে দিলাম । আম হাতে নিয়ে আমার মতো করে গাছে উঠতে চাইল । অনেক বার চেষ্টা করে হাঁপিয়ে গেলো তারপর কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে ঘুমিয়ে পড়ল । এখন দেখছি মা আমার থেকে ওদের বেশী খেয়াল রাখছে । দেখে আমার বড্ড হিংসা হচ্ছে । কিছু বলতে পারছি না । মা যে বলে রেখেছে আমি ওদের বড় দাদা ওদের যেন কোনরকম অসুবিধা না হয় তার খেয়াল রাখতে । দুই তিনদিন বেশ আনন্দে কেটে গেল ।
হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে পুলিশের গাড়ি এসে হাজীর । থানার বড় বাবু বাবাকে ডেকে বললেন —- থানায় খবর দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছেন । বাচ্ছা দুটিকে দেখে শুনে রাখবেন । আমরা ওদের সম্পর্কে খবর পেলেই আবার আসবো । বাবা আর মা দুজনেই বড় বাবুর দেওয়া কাগজে সই করে দিলেন । মা লেখাপড়া বেশী জানেনা তাই বড় কষ্টে নিজের নাম “তিলোত্তমা” লিখলেন । প্রায় পনের কুড়ি দিন ভাইদের সঙ্গে আনন্দে কেটে গেল । তারপর এক দিন আবার পুলিসের গাড়ি এলো । এবার লোকজন অনেক বেশী ছিলো । গাড়ি থেকে একটি মোটা মত লোক দুই ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলেন । বাবার হাতে একটা কাগজ দিয়ে ভাইদের নিয়ে চলে গেল । কাগজটিতে লেখা ছিল “মাতৃহারা পুত্রদের ফিরে পেয়ে অমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে যদি কখনো কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে এই ঠিকানায় চিঠি লিখবেন । অমি হাজির হয়ে যাবো । “
অনেক বছর কেঁটে গেল মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে । গ্রামের ডাক্তারের পরামর্শে কলকাতার মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দিলাম । ডাক্তাররা দেখে বললেন দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে । কিডনি পাল্টালে মা ভালো হয়ে যাবে । খরচ পড়বে পাঁচ লাখ টাকা । শুনে যেন মাথায় বাজ পড়ল । যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারা কোথায় পাবে এত টাকা । আমার এই দুর্দশার কথা শুনে একজন বুদ্ধি দিলেন । কলকাতার প্রতিটি ইস্কুল, কলেজ, ক্লাবে গিয়ে সাহায্য চাইলে চিকিৎসার টাকা উঠে আসবে । কথা মতো কাগজ পত্র তৈরি করে বেরিয়ে পড়লাম ভিক্ষা করতে । ভিক্ষা করতে করতে একটি ইস্কুলের নাম দেখে অবাক হয়ে গেলাম । “তিলোত্তমা উচ্চ বিদ্যালয়” এ তো আমার মায়ের নামে ইস্কুল । হেড মাষ্টারের কাছে গিয়ে কাগজ পত্র দেখালাম । উনি কাগজ পত্র দেখে বললেন । তোমাকে আর ভিক্ষা করতে হবে না । পাশেই তিলোত্তমা নাসিং হোম আছে ওখানে মা’কে ভর্তি করে দাও । বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয়ে যাবে ।
আমি যেন আশার আলো খুজে পেলাম । ওনার কথা মতো তিলোত্তমা নার্সিং হোমে মা’কে ভর্তি করে দিলাম । দশ পনের দিনের মধ্যে মা সুস্থ হয়ে উঠল । এক নার্স বলল মার দুটো কিডনি পাল্টে দিয়েছে । খুব আনন্দ হচ্ছে আবার ভয়ও করছে । কত টাকা পয়সা দিতে হয় কে জানে । মা’কে আজ ছেড়ে দিল । কাউন্টার থেকে একটি বিল আমাকে দিল তাতে লেখা আছে মোট খরচ পাঁচ লক্ষ টাকা । আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম । কে যেন আমার হাত ধরে টেনে তুলল । তাকিয়ে দেখি হেড মাষ্টর মহাশয় আর পাশে দাঁড়িয়ে ডাক্তার বাবু । ওনারা বললেন নিচে পড়ে দেখো দাদা । দাদা বলতেই অমি চমকে উঠলাম । আমার তো কনো ভাই নেই । রসিদের নিচে পড়ে দেখি পেইড লেখা পাশে নাম রাম লক্ষণ । পরে ভাইরা বলল আমরাই সেই মায়ের রাম লক্ষণ । বাবা মরার সময় তোমাদের কথা বলে গিয়েছিল । বাবার ইচ্ছাতেই ইস্কুল ও নার্সিং হোমের নাম রাখা হয়েছে । আর বাবা তার অঙ্গ সংরক্ষণ করেছিলেন । বাবার কিডনি দুটি মা কে লাগিয়ে দিলাম । দুই ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম ।
———–********———–